জৈব কৃষিতেই আগামীর সম্ভাবনা

ড. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

পৃথিবীব্যাপী ফসল উৎপাদন, ফসল তার কৌলিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য পরিবর্তন করে উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল প্রয়োগ করা হয়, সেখানে মাটির খাদ্য বা স্বাস্থ্য উপেক্ষিত। মাটির স্বাস্থ্য হলো মাটির ভৌত, রাসায়নিক জৈবিক গুণাগুণের সর্বাধিক সমন্বয়, তা রক্ষা করা এবং সামগ্রিক মান সংরক্ষণ উন্নয়ন করা একটি মূল আন্তর্জাতিক লক্ষ্য। একসময় মাটির উৎপাদনশীলতায় অবদান রাখে এমন গুণগত মানের বৈশিষ্ট্যাবলি রক্ষায় কাজ করা হতো। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় গুণগত মানকে খুব কম বিবেচনা করা হতো। অথচ আজ এটা প্রমাণিত যে মাটি ইকোসিস্টেম পরিষেবাদি সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করে। মাটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কাজ যেমন নিরাপদ পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করে। জনস্বাস্থ্য মাটি-পানি-বায়ু পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ধারাবাহিকতার ওপর নির্ভর করে, যা মাটিতে প্রক্রিয়াগুলোর দ্বারা দৃঢ়ভাবে সংহত হয়। ফিল্টারিং, বাফারিং রূপান্তরকরণের মতো মাটির কাজগুলো ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ এবং খাদ্যশৃঙ্খলের বিনষ্টের বিরুদ্ধে মানুষসহ পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। মানুষের কর্মকাণ্ড মাটির বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন ভূত্বকের ক্ষয়, মাটির কাঠামোর অবনতি, ক্রাস্টিং, পুষ্টি হ্রাস, ভারসাম্যহীনতা, অ্যাসিডিকেশন, লবণাক্তকরণ, জৈব পদার্থের হ্রাস, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিকে প্রভাবিত করে। মাটির অবক্ষয় ফসলের ফলন, পুষ্টির মান এবং উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা কমিয়ে খাদ্য সুরক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে। মাটিতে খনিজ পুষ্টি উদ্ভিদ গ্রহণ করে, যা মানবদেহে খনিজ সরবরাহের প্রধান উৎস। মাটি থেকে গাছ যে খনিজগুলো শোষণ করে, মানুষ সরাসরি তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বা প্রাণীকে খাওয়ানো হয়, পরে মানুষের খাদ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার মানুষের অন্ত্রে নানান ধরনের অণুজীব রয়েছে, অণুজীবগুলো নিদিষ্ট ধরনের অনুপুষ্টিনির্ভর, আর অণুজীবগুলো যথাযথ পুষ্টি না পেলে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত হয়, দীর্ঘমেয়াদে শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়ে তীব্র ঘাটতি হলে রোগ আকারে প্রকাশ পায়। বিজ্ঞানীরা মাটির স্বাস্থ্য মানুষের স্বাস্থ্যের সরাসরি সম্পর্ক চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তার উন্নয়নে কাজ করেছেন।

মাটির জৈব-পদার্থ কোনো দেশের মাটির অবস্থা বোঝার নির্দেশক। বিবিএসে প্রকাশিত বাংলাদেশের ফসলি জমির উর্বরতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ৩০টি AEZ-এর . মিলিয়ন হেক্টর জমির ৭০ ভাগের জৈব পদার্থের পরিমাণ ভাগের নিচে (আদর্শমান .-., সর্বোচ্চ ) মাটিতে ১৭টি পুষ্টি উপাদান থাকে কিন্তু দেশে তিন ধরনের পুষ্টি উপাদান (নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম) কেন্দ্রিক রাসায়নিক সার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন ফসলে ব্যবহারবিধি নির্ধারণ করে তা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দেখা গেছে, ছয় দশক আগে ফসলি জমিতে হেক্টরপ্রতি . কেজি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হতো, বর্তমানে তা ৭৫ গুণ বেড়ে প্রতি হেক্টরে প্রায় ৬৬০ কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। কখনো কখনো স্থানীয় সারবিক্রেতার পরামর্শে কৃষকরা রাসায়নিক সার ব্যবহারের সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে বহু বেশি ব্যবহার করছেন, ফলে বৃদ্ধির গতি অব্যাহত আছে। আবার সার ব্যবহার নির্দেশিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে সময়ে সময়ে জৈব সারের ব্যবহার কমিয়ে ফসলের জাতভেদে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে, অর্থাৎ কৃষকদের রাসায়নিক সার ব্যবহারে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান অব্যাহত আছে। তাছাড়া গভীরভাবে চাষ, মাটিতে বালাইনাশকের (আগাছানাশক দানাদার) ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও মাটির জৈব পদার্থ হ্রাস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। এতে যদিও আশাতীত খাদ্যোৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু দুঃখজনক যে এর অপপ্রয়োগে আমাদের জমির স্বাস্থ্য উর্বরতা বহু গুণে কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির উৎপাদিকা শক্তি সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে। বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার কৃষিজমি হলো গ্রহের বৃহত্তম কার্বনের জমাধারগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বর্ধিত কার্বণ সিকোয়েস্ট্রেশনের (সিএস) সম্ভাবনা রাখে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বর্ধমান বায়ুমণ্ডলীয় ঘনত্বকে প্রশমিত করার একটি সম্ভাব্য উপায় সরবরাহ করে। মাটির জৈব পদার্থ অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় জমির কার্বন সংবন্ধন তো করেনি, অধিকন্তু মাটি কার্বন ঋণাত্মক পর্যায়ে আছে, ফলে দেশের মাটির স্বাস্থ্য আজ বিপন্ন। মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করতে জৈব সারকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কোনো তড়িৎ বিজ্ঞান পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি।

জৈব সার হলো খনি থেকে প্রাপ্ত শিলার খনিজ এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ প্রাণিজ উপকরণ থেকে তৈরি দ্রব্য। এতে রয়েছে পশুর মল, গোয়ানো (পাখির বিষ্ঠা থেকে উৎপান্ন জৈব সার), গুঁড়া করা শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সেল চূর্ণ, সূক্ষ্মভাবে গুঁড়া করা মাছ, ফসফেট শিলা এবং কাঠের গুঁড়ার মতো উপাদান। অজৈব বা সিন্থেটিক সারগুলোতে কিছু জৈব উপাদান থাকতে পারে। তবে জৈব সারের সঙ্গে প্রধান পার্থক্য হলো তারা মাটিকে প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ না করে কেবল উদ্ভিদকে খাওয়ানোর জন্য দ্রুত কাজ করে এবং অত্যধিক মাত্রায় পরিবেশনের ফলে মাটিতে বিষাক্ত লবণ গঠনে অবদান রাখে। জৈব সার পাউডার, তরল বা কঠিন হতে পারে, যা প্রতিটি আলাদাভাবে প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া একক অণুজীব বা বহু অণুজীবসমৃদ্ধ জৈব-উপাদানের মিশ্রণও জৈব সারের অন্তর্ভুক্ত। এসব সার মাটিতে গাছ লাগানোর আগে কন্ডিশনার হিসেবে, আবার গাছের গোড়ায় সব সময়, কিছু কিছু সার পাতায় প্রয়োগ করা হয়। অণুজীবসমৃদ্ধ জৈব সার প্রয়োগ করা হয় মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করতে বা গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সহজলভ্য করতে। অর্থাৎ জৈব উপাদানগুলো ভেঙে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। তাছাড়া জৈব সার মাটির কাঠামো বা ভৌত অবস্থার উন্নতি, মাটির পানি পুষ্টি উপাদান ধারণক্ষমতা বাড়ায়। অধিকন্তু সময়ের পরিক্রমায় জৈব সার মাটি, গাছকে স্বাস্থ্যকর শক্তিশালী করে। 

একটা বিভ্রান্তি সবার মাঝে বিরাজ করে যে জৈব সারে কিছুই নেই, তা ব্যবহার করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। আসলে জৈব সারে মাটি গাছের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭টি পুষ্টি উপকরণের সব মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় অণুজীব থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো যাচাই-বাছাই করে ওপরে বর্ণিত কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত প্রতি টন জৈব সারের পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বিশ্লেষণ (শুষ্ক নমুনা) করে দেখা যায় যে পরিপক্ব গোবর সার, কেঁচো সার, মুরগির বিষ্ঠা আবর্জনা/কিচেন মার্কেট কম্পোস্ট সারে ৩০-৭০ কেজি ইউরিয়া, ১৭-৯০ কেজি টিএসপি, ১০-৪২ কেজি এমওপি, ক্যালসিয়াম সালফেট -১৩ কেজি, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট .-. কেজি, জিপসাম ১১-২০ কেজি পরিমাণ পাওয়া যায়। তাছাড়া, অনুপুষ্টি সার যেমন জিঙ্ক সালফেট .০৫-. কেজি, কপার সালফেট ৪০-৩৬৬ গ্রাম, মাঙ্গানিজ সালফেট ৩৫-৯৫ গ্রাম, বোরিক এসিড ১৪৫-২৪০ গ্রাম, অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ২৪-৯৫ গ্রাম পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১৭টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানের প্রায় সবই আছে। অধিকন্তু প্রতি গ্রাম জৈব সারে মোট ব্যাকটেরিয়া, অ্যাকটিনুমাইসিটিজ, ছত্রাক, এজোটোব্যাক্টর, রাইজোবিয়াম, ফসফেট সলিবুলাইজার, নাইট্রোব্যাক্টর ১০২-১০৬ লগ থাকে।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি মতামত প্রদান করেছে যে মাটির হারানো গুণ ফিরে এনে খাদ্যোৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্থায়িত্বশীল করতে পরিবেশগত চাষাবাদ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি চাষবাসের মূল উপকরণ জৈব সার। মাটিতে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে জৈব সার পদ্ধতি যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। জৈব সার পদ্ধতি হলো জৈব সারের উপকরণ সংগ্রহ, উৎপাদন, গুণাগুণ নির্ধারণ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, প্রয়োগ পদ্ধতি মাত্রা নির্ধারণ, জমিতে প্রয়োগ, জমি ফসলে জৈব সারের প্রভাব।

বাংলাদেশে কী পরিমাণ জৈব সার প্রয়োজন তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে সব জমিতে জৈব সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। দেশে উঁচু, মাঝারি উঁচু মাঝারি নিচু মিলে ৭৫ ভাগ কৃষিজমি হয়। তাতে প্রতি হেক্টরে ১০ টন সাদামাটা হিসেবে, ৬০-৬২ মিলিয়ন টন (১০-১২ শতাংশ আর্দ্রতার ভিত্তিতে) চাহিদা রয়েছে। চাহিদা শুধু কঠিন বা সলিড জৈব সারের বেলায় প্রযোজ্য। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় জৈব সারের উপকরণ কোথায় পাওয়া যাবে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জৈব সার তৈরির উপকরণের উৎসগুলোর যথার্থতা যাচাই করা হয়। দেখা যায় যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎ?সের পশুপাখির মল (গরু, মুরগি, হাঁস), শহরাঞ্চলের জৈব বর্জ্য, গৃহস্থালির আবর্জনা, কাঁচা বাজারের বর্জ্য, নিটিং শিল্পের বর্জ্য, চিনিকলের পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা জৈব সারের কাঁচামালের পরিমাণ বছরে ১৩০-১৫০ মিলিয়ন টন। সে পরিমাণ কাঁচামাল যথাযথ প্রক্রিয়ায় কম্পোস্ট করলে তা থেকে ৪৫-৫৫ মিলিয়ন টন (১০-১২ শতাংশ আর্দ্রতার ভিত্তিতে) জৈব সার উৎপাদন সম্ভব। দেশে নগরায়ণ শিল্পায়ন প্রবৃদ্ধির মুখে মানুষের আয় বেড়েছে, পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। ফলে এসব উৎ? থেকে কাঁচামালের পরিমাণও ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। আবার এসব কাঁচামালের উপজাতের সঙ্গে সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশ্রিত করে তরল জৈব সার, জীবাণু সার প্রভৃতি মূল্যবান সার উৎপাদন করা সম্ভব।

দেশে জৈব সার উৎপাদনের প্রক্রিয়া এখনো সেকেলে, অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো রকম যত্ন ছাড়াই খোলা জায়গায় স্তূপাকারে ফেলে রেখে এদের কম্পোস্ট করা হয়। এর ফলে জৈব সারের কাঁচামালে থাকা গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নষ্ট হয়। মিউনিসিপ্যালিটিসের বর্জ্য, অন্য বর্জ্যের সঙ্গে সংগ্রহ করে ফেলে রাখা হয়। দেশের পোলট্রি খামারগুলোর মল বা উপজাত কোনো প্রকার ব্যবহারই হয় না। কাঁচা বাজারের মাছের নাড়িভুঁড়ি পুষ্টির ভাণ্ডার। আবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় কোটি ৩০ লাখ পশু (গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া) কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্ট অংশ যেমন পশুর হাড়, শিং, ভুঁড়ি, পাকস্থলী রক্ত ইত্যাদি সব ফেলে দেয়া হয়। থেকে নানান ধরনের জৈব উপকরণ উৎপাদন করা সম্ভব। তবে আশার কথা হলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন করছে। এদের সংখ্যা প্রায় ৪০-৫৫টি। খাতে বিনিয়োগ করার জন্য নতুন নতুন উদ্যোক্তাও এগিয়ে আসছে। দেশে কেঁচো সার উৎপাদনে একটা বিপ্লব হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দেশে এখন ২০-২২ হাজার কেঁচো সার উৎপাদক রয়েছে। এরা বছরে ২৫-৩০ হাজার টন কেঁচো সার উৎপাদন করে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ২০-২৫ কোটি টাকা। তবে বর্তমান ব্যবস্থাটির আধুনিকায়ন প্রয়োজন, যাতে উদ্যোগীরা আকর্ষণ অনুভব করে। তার জন্য জৈব সারের বাস্তবভিত্তিক চাহিদা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য কৃষিজমিতে প্রথমত জৈব সার ব্যবহার প্রয়োজনে আইন করে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটা করতে হবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থে। কারণ আমি আগেই দেশের কৃষিজমির বেহাল দশার কথা উল্লেখ করেছি তা সমাধানে জৈব সার ব্যবহারের বিকল্প নেই।

অমিত সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে স্ব-উদ্যোগী তরুণদের সম্পৃক্ত করা যায়। বাংলাদেশে জনমিতিক পরিস্থিতি চলছে, আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত তরুণ বা যুবা পুরুষ মহিলার সংখ্যা বাড়বে, অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়বে। জনসংখ্যাকে কাজ দেয়া বা নতুন নতুন কাজের সুযোগ করে দেয়া সরকার বা নীতিনির্ধারকদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এটা ঠিক যে দেশে কৃষি পেশা সাংস্কৃতিকগত কারণে কখনো মর্যাদাবান আকর্ষণীয় ছিল না। কৃষি ছিল খোরপাশ প্রকৃতির। ফলে কৃষিকাজ পদ্ধতিতে তেমন আধুনিকতার ধারা তৈরি হয়নি। এখনো কৃষক তার জমিতে ধান উৎপাদনের জন্য কয়েক ধরনের রাসায়নিক সার কীটনাশক ছাড়া জমির বা উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানোর জন্য তেমন কোনো বিনিয়োগ করেন না। তবে গত কয়েক দশকে মানুষের জীবনমান মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দেশে অনেক স্ব-উদ্যোগী তরুণ বা যুবা আছেন, যারা কৃষি খাত নিয়ে ব্যাপক স্বপ্ন দেখেন। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে পেশা হিসেবে তা গ্রহণ করতে আগ্রহী। অনেক তরুণ এরই মধ্যে নানা ধরনের ইনোভেশন সম্পাদন করেছেন। উদ্যোগী যুবাদের আগ্রহকে শক্তি ধরে জৈব সারের চাহিদা পূরণে খাতে বিনিয়োগে সম্পৃক্ত করা এখন সঠিক পদক্ষেপ। সে লক্ষ্যে জৈব সার উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, গুণগত মান বাড়ানো, পরিববহন বিতরণ, প্রয়োগের একটি সংঘবদ্ধ কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন এবং তাতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার থাকতে হবে। সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ বাজেট থাকা দরকার। জৈব সারের প্রাপ্যতা বাড়াতে এর উৎপাদনের দিকে নজর দেয়া দরকার। নিম্নে জৈব সার উৎপাদনের একটি রূপরেখা দেয়া হলো:

বৃহৎ শিল্প প্রণোদনা: কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সক্ষম বা বছরে ২০ হাজার টন জৈব সার উৎপাদন করতে সক্ষম এমন বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ বিনিয়োগকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। দেশে জৈব সার উৎপাদনের জন্য বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। উৎসাহীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার নিমিত্ত প্রণোদনা ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা এমন হবে যাতে তারা মোট চাহিদার অন্তত ২০ ভাগ উৎপাদন বিপণন করার দক্ষতা থাকে। করপোরেট বিনিয়োগকারীদের বেলায় তাদের সিএসআর ফান্ডের অর্থ খাতে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। এদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদন পর্যায়ে, যেমন সিটি করপোরেশন/মিউনিসিপ্যালিটিস কর্তৃক বিনা মূল্যে জৈব বর্জ্য সরবরাহ, ইকুইটি ফান্ড থেকে ঋণ, কর মওকুফ, আধুনিক কম্পোস্ট মেশিন ব্যবহারের জন্য উৎপাদন প্লান্ট তৈরিতে সহজ শর্তে জমি লিজ ব্যাংক সাপোর্ট ইত্যাদি বিপণনে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

মাঝারি শিল্প: কমপক্ষে কোটি টাকা বিনিয়োগে সক্ষম বা বছরে দুই হাজার টন জৈব সার উৎপাদন করতে সক্ষম এমন বিনিয়োগকারীদের মাঝারি বিনিয়োগকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। দেশে অনেক উঠতি বিনিয়োগকারী আছেন, যাদের কিছু কারিগরি বিপণন দক্ষতা রয়েছে। এদের শ্রেণীভুক্ত করে খাতে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। পুঁজির স্বল্পতা হেতু এদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এদের জন্য অন্তত ২০ ভাগ উৎপাদন বিপণন করার ব্যবস্থা থাকবে। এদেরও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদন পর্যায়ে যেমন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটিস কর্তৃক বিনা মূল্যে জৈব বর্জ্য সরবরাহ, ইকুইটি ফান্ড থেকে ঋণ, কর মওকুফ, উৎপাদন প্লান্ট তৈরিতে সহজ শর্তে লিজ ইত্যাদি বিপণনে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

ক্ষুদ্র শিল্প: কমপক্ষে লাখ টাকা বিনিয়োগে সক্ষম বা বছরে ২০০ টন জৈব সার উৎপাদন করতে সক্ষম এমন বিনিয়োগকারীদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। ব্লক পর্যায়ে চাষীর বাড়িতে চাষী নিজে বা গ্রামীণ স্ব-উদ্যোগী তরুণদের জৈব সার উৎপাদন বিপণনে সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর ব্যবস্থা। কারণ ব্লক পর্যায়ে চাষীর বাড়িতে বা স্ব-উদ্যোগী তরুণদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জৈব সার প্লান্ট স্থাপন করে কেঁচো সার, কম্পোস্ট সার তৈরি এবং প্রতি টন সার উৎপাদনে কারিগরি সহায়তা প্রণোদনা প্রদান করা সহজ নিরাপদ। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে, মাঠ পর্যায়ে জৈব সারের কাঁচামালের জন্য -গরুর-খামার কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। কর্মসূচির একটি সহজ হিসাব যেমন একটি মধ্যম আকৃতির গরু সারা বছর প্রায় ছয় টন গোবর দুই টন চেনা দেয়। একজন কৃষক বা একজন তরুণ উদ্যোক্তার যদি পাঁচটি গরু থাকে, তাহলে বছরে ৩০ টন গোবর ১০ টন চেনা পাওয়া যাবে। যদি গরু চড়ানোর সময় অপচয় (পদ্ধতিগত) শতকরা ৪০ ভাগ ধরা হয় তবে ১৮ টন গোবর ছয় টন চেনা পাওয়া সম্ভব। পরিমাণ গোবর থেকে বছরে সহজেই ২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ৯০ কেজি ফসফরাস ২০০ কেজি পটাশিয়ামসহ সব ধরনের অনুপুষ্টি পর্যাপ্ত পরিমাণে অণুজীবও পাওয়া যাবে। তা থেকে বছরে আড়াই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তাছাড়া গরুগুলো উপযুক্ত সময়ে বিক্রি করে সেখানে আরো দেড় লাখ টাকা সর্বমোট লাখ টাকা আয় সম্ভব। দেশে প্রায় ১৪৫০০টি ব্লক রয়েছে। প্রতি ব্লকে -১০ জন উদ্যোগী তরুণ নিলে খাতে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এরা মোট চাহিদার ৬০ ভাগ পূরণ করার সুযোগ করে দিতে হবে। মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য জমিতে অণুজীবের পরিমাণ বাড়াতে হয়। সে অণুজীব আবার স্থান ফসলভেদে ভিন্ন হয়। সেজন্য অণুজীব সার তৈরি বিপণনে একটু বেশি শিক্ষিত তরুণেরা এগিয়ে আসতে পারে। তার জন্য সরকার স্থানীয় টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছোট ছোট ল্যাব স্থাপনে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দান করতে পারে।

রাসায়নিক সার উৎপাদনের জন্য বড় বড় শিল্প-কারখানা বিশাল বিনিয়োগ করে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জৈব সার উৎপাদন বিপণনের কোনো স্থায়ী কাঠামো নেই। যদিও দেশে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানি ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়েছে। এরা প্রায় এক লাখ টন জৈব সার জোগান দিতে সক্ষম। জৈব সারের ওজন নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি আছে। যেমন ভাগ আর্দ্রতা বাড়লে প্রতি টনে ১০ কেজি ওজন বেড়ে যায়, সেখানে কৃষকদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে। সে জন্য জৈব সার ভলিয়ম বা আয়তন আকারে বিক্রি করা যেতে পারে। জৈব সার নিয়ে আরো একটি নেতিবাচক ধারণা আছে যে এর ফলাফল প্রদর্শন বিলম্ব হয়। তবে গবেষণার মাধ্যমে এর উন্নয়ন করা সম্ভব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রয়োজনের তুলনায় জৈব সারের কাঁচামাল কম। তবে প্রণোদনার আওতায় আনা হলে কাঁচামালের জোগান আরো বেড়ে যাবে। কারণ পশুপালন, মৎস্য চাষ, আগাছা বা সামুদ্রিক আগাছা সংগ্রহে নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসবে। এটা একটা ক্ষুদ্র শিল্পে পরিণত হবে। রাসায়নিক সার বিশেষ করে -৫টি পুষ্টি উপাদান সহজপ্রাপ্য করার নিমিত্ত ৮০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। হিসাব করে দেখা গেছে একটি পুষ্টি উপাদান সরবরাহকারী এক কেজি রাসায়নিক সারে ১৬০ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। সে যুক্তিতে ১৭টি উপাদান প্রয়োজনীয় অণুজীব মূল্য কষে এক টন জৈব সারের প্রচলিত বাজার দাম ৭০০০ টাকা। সরকার প্রতি টনে ৫০০০ টাকা ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিতে পারে। সেজন্য মোট সারের চাহিদা পূরণে বছরে ৩০০০ কোটি টাকার সংস্থান থাকা প্রয়োজন। এটা রাসায়নিক সারে কৌশলে ভর্তুকি বা অংশীজনদের সরাসরি দেয়া যেতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার: জৈব সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার নিমিত্ত সব অংশীজনের (উৎপাদন থেকে ব্যবহারকারী) পর্যন্ত ডাটাবেজ করে এর মাধ্যমে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত করলে কর্মসূচিটির সুফল নিশ্চিত হবে। জৈব সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যেমন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি স্থায়ী কর্মসূচি থাকা দরকার, যার মাধ্যমে জৈব সার ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের ব্যাপক উদ্বুদ্ধকরণের কর্মকাণ্ড থাকবে। উদ্যোগী তরুণদের সম্পৃক্তকরণ কার্যক্রম, জৈব সার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ২৫ ভাগ রাসায়নিক সার কম দেয়ার নিমিত্ত রাসায়নিক সার ক্রয়ের বেলায় মূল্য প্রণোদনার সুযোগ কার্যকর করা, পাশাপাশি জমিতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে জমির জিপিএস তথ্য সংগ্রহ করে তা কৃষি তথ্য সার্ভিসের কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড করা। তাছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট তালিকাভুক্ত চাষীদের জমির মাটির নমুনা সংগ্রহ বিশ্লেষণ করার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রক্রিয়াটির সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। প্রক্রিয়াটি প্রণোদনা বা ভর্তুকি খাত থেকে ব্যয় করার ব্যবস্থা থাকবে। তাছাড়া কভিড-১৯- অনলাইন মার্কেটিংয়ের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা জৈব সার বিক্রি করতে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন দেশে এখন ছাদকৃষি ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ব্যবহার করার জন্য কোনো আদর্শ মিডিয়া দেশে নেই। জৈব সার দিয়ে মিডিয়া তৈরি করে তা অনলাইন অর্ডার নিয়ে গ্রামে বসেই সে ব্যবসা করা যেতে পারে। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে তরুণদের সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার সুযোগ তৈরি হবে।

খাদ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষিজমিতে জৈব সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য রাসায়নিক সারের ভর্তুকি থেকে ২৫ ভাগ জৈব সারের উৎপাদন প্রয়োগ পর্যন্ত প্রদানের নিম্নবর্ণিত প্রস্তাব প্রদান করা হলো: জৈব সার উৎপাদনে বড়, মাঝারি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি তাদের কারিগরি-আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি স্থায়ী কর্মসূচি থাকা, স্ব-উদ্যোগী তরুণদের সম্পৃক্ত করে প্রতিটি কৃষি ব্লকে জৈব সারের কারখানা গড়ে তোলা, বিপণন, সকল স্তরে আইসিটি জিসিএস ব্যবহার করে জৈব সার প্রয়োগ নিশ্চিত করা, জৈব সারের মান উন্নয়নে গবেষণা জোরদার করা। সর্বোপরি মাটিতে জৈব সার প্রয়োগকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করার জন্য প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগানো। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে মাটির স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন হবে, শহরের বর্জ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করায় বর্জ্য কমে যাবে পরিবেশ দূষণ কমবে। উদ্যমী তরুণদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়ন হবে। অধিকন্তু জৈব সারের পদ্ধতির মাধ্যমে দেশে জৈব কৃষির অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

 

. মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জৈব কৃষি গবেষক, বারি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন