এক বিশ্বনেত্রীর উন্নয়ন উপাখ্যান

ড. শামসুল আলম

বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। আর বাংলাদেশের রূপান্তরের রূপকার শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় আপন মহিমায় স্থান করে নেয়া একজন সফল বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক নানান ইস্যুতে তাঁর বিচক্ষণ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ একদিন তাঁর হাত ধরে উন্নয়নের সব ধাপ অতিক্রম করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে এক কাতারে শামিল হবে। সেটাও বেশিদূর নয়। এখন থেকে মাত্র দুই দশকের প্রান্তসীমায় বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশ।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকদের জন্য শেখ হাসিনা হয়ে গেছেন একজন অনুকরণীয় নেতৃত্ব। তিনি দেশ-বিদেশের নেতাদের কাছে হয়ে গেছেন আস্থা ভরসাস্থল। তার একাগ্রতা, দৃঢ়তা দূরদর্শী নেতৃত্ব দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গা চুক্তি, সমুদ্র বিজয়, নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মহাকাশ বিজয়, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা সমুজ্জ্বল হয়েছে।

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট ইডেন গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহসভাপতি হয়েছিলেন। তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য এবং ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সব গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের কালো নীতির ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ফলে থেমে যায় বাংলাদেশের অগ্রগতি। শেখ হাসিনা তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছয় বছর ভারতে অবস্থান করেন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক প্রতিকূল পরিবেশে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পর পরই তিনি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারাভোগ বরণ করতে হয়। তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়।

শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যান। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ অর্জন করেছে গণতন্ত্র বাক-স্বাধীনতা। ১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সংগঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপির ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তত্কালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সব সময়ই আপসহীন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১২ জুন, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

২০০৯-২০ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যসমূহের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন বিশ্বনেত্রী

২০০৯-২০১৩ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উত্পাদনক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষি কার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিত্সাসেবার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮. থেকে ২০১৯-২০ সালে ২০. শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ ইত্যাদি।

২০১৪ সালের জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২০১৪ সালের পর জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন, (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় ,০৮৪ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সময়ে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু এবং ৮১% সার্বিক অগ্রগতি সম্পন্ন হয় জুন ২০২০-এ।

এমডিজি অর্জন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণা (এমডিজি) সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর এবং তা অর্জনে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, তার সফল বাস্তবায়ন নিবিড় পরিবীক্ষণের ফলে বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই এমডিজির অধিকাংশ অভীষ্ট সাফল্যজনকভাবে অর্জন করেছে। বিশেষত দারিদ্র্য ক্ষুধা নির্মূল, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অগ্রপথিক। এর স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক পদক এবং পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এর মধ্যে এমডিজি- অর্জনে জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা কর্তৃকDiploma Award’, এমডিজি- অর্জনে জাতিসংঘ কর্তৃকUN MDG Awards 2010’ , এমডিজি- এর সাফল্যSouth-South Awardঅন্যতম।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর জানুয়ারি ২০১৯ শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে এবং চতুর্থবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

টেকসই উন্নয়নে এসডিজি

প্রধানমন্ত্রীর নীতি-নির্দেশনায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় বিভাগভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, অর্থায়নকৌশল নির্ধারণ, তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি নিরূপণ, এসডিজি স্থানীয়করণসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিবিড় পরিবীক্ষণের ফলে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অগ্রসরমাণ একটি দেশ। গত ২২ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২০-এর মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রতিবেদন অনুসারে বেশকিছু সূচকের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা এরই মধ্যে অর্জিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জনের পথেই রয়েছে।

রূপান্তরের সাফল্যগাথা

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষাকে কটাক্ষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেনতলাবিহীন ঝুড়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ শাসনে আজ দিন বদল হয়েছে। তারই স্বীকৃতি দিয়ে আরেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে।ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মতে, ‘শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন সমৃদ্ধির পথে আছে।ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারী-পুরুষের সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য বিশ্বের বুকে অনুকরণীয়।বিশ্বনেতাদের এসব প্রশংসা নিছক বাক্যবিলাস নয়, বরং বাংলাদেশের বিস্ময়কর রূপান্তরের স্বীকৃতি, যার রূপকার বাংলার অবিসংবাদী নেতা শেখ হাসিনা।

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর

জুলাই, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। ১৭ মার্চ ২০১৮, জাতির পিতার ৯৮তম জন্মদিনে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রাথমিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক তিনটি সূচকের যেকোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে।

প্রবৃদ্ধি, আয় দারিদ্র্যসীমা

১৯৯৭-২০০২ সালের পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় . শতাংশ, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে অর্জিত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল . শতাংশ এবং সপ্তম পরিকল্পনা মেয়াদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে . শতাংশ। এর মধ্যে কেবল ২০১৮-১৯ সালে হার ছিল .১৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। করোনাকালে বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনীতির ব্যাপক সংকোচনের মুখে বাংলাদেশের অর্জিত প্রবৃদ্ধি . শতাংশ ছিল সারা বিশ্বে সমীহ জাগানিয়া।

মানব উন্নয়ন

শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। তিনি তাঁর দল দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যত্মুখী একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো শিক্ষিত জনশক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৯৯৪) বলেন, ‘একটি জাতিকে গড়ে তোলার প্রথম সোপান হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমরা যদি বাংলাদেশের চির অবহেলিত দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে শিক্ষাই হচ্ছে তার পূর্বশর্ত।প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বল কাঠামো এবং কারিগরি শিক্ষার অপ্রতুলতাকে শিক্ষার প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের মান ২০০০ সালে .৪৫ থেকে ২০১৭ সালে .৬১- উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির হার ২০০৫ সালে ৮৭. শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ৯৭. শতাংশ, ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীর হার ২০০৯ সালে ৪৫. শতাংশ থেকে কমে ২০১৮ সালে ১৮. শতাংশ হয়েছে। প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের উপবৃত্তি চালু করার ফলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষা খাতে জিডিপির শতাংশেরও কম ব্যয় করে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বে অনন্য। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনুকরণীয়। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণের ফলে ধারাবাহিকভাবে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। সন্তান প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতির হারে চমকপ্রদ অগ্রগতি হয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার ২০০৫ সালে ৩৪৮ থেকে কমে এখন ১৬৫, পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ২০০৫ সালে ৬৮ থেকে কমে ২০১৯ সালে ২৮ এবং প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি ২০০৪ সালে ১৫. শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে ৫৯ শতাংশ হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য

১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা আজ সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। উপজেলা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। স্থাপন করা হয়েছে হূদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল। অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। বিগত ১১ বছরে ২০ হাজার ১০২ জন নতুন চিকিত্সক এবং ২১ হাজার ৬৯৭ জন নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের কাজ চলছে।

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছেজাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১ তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি() কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি() উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ জেলা হাসপতালগুলোয় হাজার শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩-এ। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেরও বেশি জনশক্তি।

টেকসই কৃষি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

শেখ হাসিনার উন্নয়ন ভাবনায় সর্বদাই গ্রামের কৃষক আর কৃষি প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর ভাষায়, হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় আমাদের গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব ওলটপলট হয়ে যায়। শহরমুখিতা বাড়ে, অনেকেই বিদেশে চলে যায়। দেশের মাটি এত উর্বরএকটি বীজ ফেললেই অঙ্কুর হয়, গাছ হয়, ফল হয়। অভাব শুধু উদ্যোগ আগ্রহ সৃষ্টির। পরিস্থিতি বদলাতেগ্রামকেই প্রাধান্য দিতে হবে...গ্রামকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার নতুন নতুন কর্মপন্থা বের করতে হবে...ফসল কীভাবে দ্বিগুণ করা যায়, মাটিতে কোন সার কী পরিমাণে দিতে হবে, গাছের যত্ন কীভাবে করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে তা কাজে লাগাতে হবে।রূপকল্প ২০২১- কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য ঘাটতি দূর করা এবং দেশকে খাদ্য উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল তা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এরই মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কৃষি খাতে চমকপ্রদ অর্জন সরকারের কৃষিনীতি, কৃষি উপকরণ সরবরাহে ভর্তুকি, উন্নত শস্যজাত উদ্ভাবনে গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম এবং সর্বোপরি কৃষি খাতে বর্ধিত বিনিয়োগের ফসল। তাঁর আমলেই অর্জিত হয়েছে প্রধান খাদ্যশস্য ধানের সর্বোচ্চ উত্পাদন ৩৮ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন টন (জুন ২০২০)

রফতানি, রেমিট্যান্স রিজার্ভ

তৈরি পোশাক খাতের রফতানি বিশ্বে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে রফতানির গতি শ্লথ হয়ে এলেও তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক দশকে অব্যাহতভাবে সরকারের নীতিসহায়তা কাজে লাগিয়ে বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। সরকারের কারিগরি শিক্ষার প্রসার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করার ফলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়েছে। জনশক্তি রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সও বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৫-০৬ সালে . বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৮-১৯ সালে ১৮. বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০০৫-০৬ সালে . বিলিয়ন ডলার থেকে জুন ২০১৯-২০ সালে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

সবার জন্য বাসস্থান, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ

উন্নয়নের সুফল জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসনীয়। দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে গ্রহণ করা হয় আমার বাড়ি আমার খামার আশ্রয়ণ প্রকল্প। রূপকল্প ২০২১-এর একটি প্রধান মাইলস্টোন ছিল ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া। বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনসংখ্যার অনুপাত ২০০৫ সালে ৪৪. শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ৯২. শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

পদ্মায় সেতু, ঢাকায় মেট্রোরেল

বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণের সংযোগ সেতু পদ্মা বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক। প্রমত্তা পদ্মার বুকে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে কতই না নাটকীয়তা। একটি ধারণাগত দুর্নীতির অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নজিরবিহীনভাবে ঋণের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। নিয়ে বিশ্বব্যাংক জল ঘোলা করলে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জানান দেয় তার আর্থিক শক্তি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃঢ়তার কথা। যেন শাপেবর পাওয়ার মতো বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সেতুর ৮১ শতাংশ কাজ এখন সম্পন্ন। আগামী বছর খুলে দেয়া হবে জনতার জন্য। এর সঙ্গে খুলে যাবে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। এছাড়া ঢাকা শহরে আধুনিক নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে যানজট নিরসনে জাপানের সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল প্রকল্প বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেক দিক উন্মোচন করেছে।

জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উন্নয়নের ছোঁয়া আজ সর্বত্র

রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কৃতিত্বের স্বাক্ষর বিরাজমান সর্বত্রজলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেমন সফল, তেমনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। ২০১৫ সালে সমুদ্র বিজয় আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে শেখ হাসিনার দূরদর্শী বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করে। প্রতিবেশী মিয়ানমার ভারতের সমুদ্রসীমা নিয়ে আইনি বিরোধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এলাকাভুক্ত সমুদ্রের অংশ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল মহীসোপানসহ মোট ,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ওপর স্বত্বাধিকার লাভ করে। সমুদ্রের নীল জলরাশি তার সম্পদ আহরণে উন্মুক্ত অধিকারের সুযোগ কাজে লাগাতে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১- সুনীল অর্থনীতির কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালে বিশ্বের অন্যতম জটিল দীর্ঘায়িত সীমান্ত সমস্যার সফল সমাপ্তি হয়। ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময় করে বাংলাদেশ পায় ভারতের ১১১টি ছিটমহল। চুক্তির ফলে ৬৮ বছরের রাষ্ট্রহীন ছিটমহলের ৫১ হাজারেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পায়, নতুন আশা নিয়ে জীবন শুরু করে তারা। মহাকাশে বাংলাদেশের পতাকাখচিত পদচিহ্ন এঁকে দেয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- বাংলাদেশের রূপান্তরের আরেক মাইলফলক, যা ২০১৮ সালে মহাকাশে উেক্ষপণ করা হয়।

নারী শিশু উন্নয়নে সাফল্য

নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছেজাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ নারী শিক্ষাকে উত্সাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও।জাতীয় শিশু নীতি-২০১১প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দুস্থ, এতিম, অসহায় পথশিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘেরসাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডে

সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য

সন্ত্রাস দমনে সরকার সাফল্য অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ উদ্যোগের ফলে দেশে নাশকতার হার অনেক কমে এসেছে। দেশের মানুষ এখন শান্তিতে বসবাস করছে। এছাড়া জঙ্গি দমনেও সরকার ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। জঙ্গিরা হোলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি পৈশাচিক ঘটনাও ঘটিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার শক্ত নেতৃত্বে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে গভীর সমুদ্রের তলদেশে অপটিক্যাল ফাইবার নির্মাণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু, উপজেলা শহরে ব্যাংকের এটিএম বুথ নির্মাণসহ সহজলভ্য ইন্টারনেট সেবা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। দেশের তৃণমূল প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার অভিপ্রায়ে দেশের প্রায় সব ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এসব পোর্টাল রয়েছে। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ কোটিরও বেশি মোবাইল সিম ব্যবহূত হচ্ছে আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় কোটি। দেশের সাড়ে তিন সহস্রাধিক ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ফোরজি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পর এখন ফাইভজি প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে -পেমেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতে সাফল্য

দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে

বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা শতকরা ৯৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উত্পাদনের পরিমাণ ৫১০ কিলোওয়াট থেকে ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়েছে। টেকসই বিদ্যুৎ উত্পাদন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রামপাল, মাতারবাড়ী, পায়রা মহেশখালীতে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। পাবনার রূপপুরে হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের অর্জন

নিরাপত্তা খাতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ কোটির বেশি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তৃত করতে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত দুস্থ মহিলা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ ভাতার হার আওতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। করোনাজনিত আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করা এবং গ্রামে বসবাসরত দরিদ্র, দুস্থ অসহায় মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে পল্লী সমাজ সেবা কার্যক্রমের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

জলবায়ু মোকাবেলায় সাফল্য

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও অন্যান্য দেশের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।রূপকল্প: ২০২১বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিশেষ নজর রেখে প্রকল্প গ্রহণ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্প কার্বন নিঃসরণ কৌশল অনুসরণ করছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন

শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন ডিগ্রি পুরস্কার প্রদান করে। তিনি বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ডিগ্রি সম্মাননা পেয়েছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি যা পেয়েছেন বাংলাদেশ তো নয়ই, দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো নেতার পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি নেতৃত্ব ব্যক্তিত্বের কারণেও বিভিন্ন স্বীকৃতি অর্জন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি, ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, স্কটল্যান্ডের অ্যাবারটে বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের বিশ্বভারতী এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্রাসেলসের বিশ্ববিখ্যাত ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া ফ্রান্সের ডাওফি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে ইউনেসকো তাঁকেহুপে-বোয়ানিশান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা দূরদর্শিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রানডলপ ম্যাকন উইমেন্স কলেজ ২০০০ সালের এপ্রিল মর্যাদাসূচকPearl S. Buck ’99পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে সম্মানজনকসেরেস’  মেডেল প্রদান করে। সর্বভারতীয় শান্তি সংঘ শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালেমাদার তেরেসাপদক প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক রোটারি ফাউন্ডেশন তাঁকে Paul Haris ফেলোশিপ প্রদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় কংগ্রেস ১৯৯৭ সালে তাঁকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু স্মৃতি পদক প্রদান করে।

২০১৪ সালে ইউনেসকো তাঁকেশান্তির বৃক্ষএবং ২০১৫ সালে উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাঁকে রিজিওনাল লিডারশিপ পুরস্কার এবং গ্লোবাল সাউথ-সাউথ ডেভেলপমেন্ট এক্সপো-২০১৪ ভিশনারি পুরস্কারে ভূষিত করে। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে অব্যাহত সমর্থন, খাদ্য উত্পাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নে অবদানের জন্য আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫ সালে তাঁকে সম্মাননা সনদ প্রদান করে।

২০১৫ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কারচ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ-২০১৫পুরস্কারে ভূষিত করে। তিনি জাতিসংঘেরএজেন্ট অব চেঞ্জ পুরস্কার’, ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়নপুরস্কার, আবহাওয়া পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কারচ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থএবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্যআইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কারপেয়েছেন। এছাড়া রাজনীতিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালনেপান ওম্যান ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড’, নারী শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্যশান্তি বৃক্ষ পদক’, ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘেরমিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাওয়ার্ড’, ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’, ‘কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’, ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’, ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক’, ‘ডক্টরস অব হিউম্যান লেটার্স’, ‘নেতাজি মেমোরিয়ালপদকসহ অর্ধশতাধিক পদক পেয়েছেন।

সংবেদনশীল মানবতাবাদী এক লেখিকা

রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের উন্নয়নের পথে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এরই মধ্যে রূপকল্প ২০৪১ গ্রহণ করে ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং উচ্চ-মধ্য আয়ের সোপানে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করছে। এক অনন্য অনুকূল সময়, যখন অতীত সাফল্য অর্জন নিয়ে ভাবনার পাশাপাশি আগামী দুই দশকের সম্ভাব্য সমস্যা সমাধান সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণেরও সময়। বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্য প্রমাণ করেছে যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সঠিক পরিকল্পনা কৌশল নিবেদিত প্রচেষ্টায় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত, বলিষ্ঠ অবিচল নীতি-নেতৃত্বে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনা তাঁর উন্নয়নকামী জীবন দর্শন, কর্মনিষ্ঠা সার্বিক অবদানে প্রমাণ করেছেন যার জন্মই আজন্ম বাংলাদেশ। চুয়াত্তরতম জন্মদিনে জয়তু শেখ হাসিনা।

 

. শামসুল আলম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন