নভেল করোনাভাইরাস ঠেকাতে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি নয়, চাই টিকা

মু. মাহবুবুর রহমান

হার্ড ইমিউনিটি— ইংরেজি এ শব্দ শুনে মনে হতে পারে এর মানে হলো Hard Immunity। উচ্চারণ এক হলেও এখানে হার্ড হলো Herd; Hard বা শক্ত নয়। আর ইংরেজি শব্দ Herd-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে পাল বা একদল প্রাণী বা জনগোষ্ঠী। ডিকশনারি খুঁজলে দেখা যাবে Herd শব্দের অর্থ হচ্ছে পশুর পাল। আর Immunity মানে হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। পশুর পাল মূলত ভেড়ার পালের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ধারণা থেকে হার্ড ইমিউনিটির উত্পত্তি এবং প্রচলন হয়েছে বলে জানা যায়। ভেড়ার পালের মোটামুটি ৮০ শতাংশের টিকা বা সংক্রমণের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে পালের বাকি ২০ শতাংশসহ সবাই নিরাপদে থাকে। হার্ড ইমিউনিটি শব্দটির উত্পত্তি শতবর্ষ আগে হলেও এটি খুব ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়নি। এটি বেশি আলোচনায় এসেছে বর্তমান নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ সংকটে।

আর করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ আলোচনার ক্ষেত্রে Herd-এর মানে অবশ্যই একদল মানুষ বা কমিউনিটি কিংবা দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশকে বোঝায়। কাজেই হার্ড ইমিউনিটির সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি, এটি হচ্ছে এক ধরনের ‘কমিউনিটি ইমিউনিটি’ বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা; যা কোনো সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে তৈরি হয়। ফলে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা যারা শারীরিকভাবে দুর্বল, তাদেরকেও হার্ড ইমিউনিটি সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয় বলে ধরে নেয়া হয়। এপিডেমিওলজিস্টের ভাষায়, এই পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি, যা হার্ড প্রটেকশন নামেও অভিহিত। হার্ড ইমিউনিটির আরো কিছু নাম আছে, যেমন হার্ড ইফেক্ট, সোস্যাল ইমিউনিটি, পপুলেশন ইমিউনিটি ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক করোনাকালীন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। কারণ এখন পর্যন্ত কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি।

এখন আলোচনা করা যাক কীভাবে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের দুটি উপায় আছে। একটি টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থাত্ কৃত্রিমভাবে। আর অন্যটি হলো, অধিকাংশ মানুষ ওই রোগে আক্রান্তের পর সুস্থ হয়ে উঠলে অর্থাত্ প্রাকৃতিকভাবে। নভেল করোনাভাইরাসের যেহেতু টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, কাজেই কোনো এলাকার বা দেশের অধিকাংশ মানুষ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলেই কেবল প্রাকৃতিকভাবে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

এখন জেনে নিই আমাদের শরীরে কীভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি তৈরি হয়। শরীরে কোনো জীবাণু প্রবেশ করলে সেটাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া পালন করে থাকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আর এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালনকারীর নাম অ্যান্টিবডি। কোনো জীবাণু বা ভাইরাস বা সংক্রামক প্যাথোজেন আমাদের শরীরে যেকোনো উপায়ে ঢুকে পড়লে তার প্রতিরোধে আমাদের রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা প্লাজমা বা রক্তরসে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এ অ্যান্টিবডি ওই জীবাণুকে মেরে ফেলে এবং আমরা সুস্থ থাকি। আমরা বর্তমান করোনাকালীন যে প্লাজমা থেরাপির কথা শুনছি, সেটারও মূলনীতি এটা। অর্থাত্ যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন, তার প্লাজমায় থাকা অ্যান্টিবডি দিয়ে আক্রান্ত কাউকে সুস্থ করার প্রচেষ্টা।

অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে আমাদের শরীরে যেসব জীবাণু প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে, তাদের ধ্বংস করে থাকে আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং আমাদের অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করে। যেকোনো রোগের টিকা দিলেও তা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

কাজেই একবার কোনো জীবাণু বা জীবাণুর টিকা শরীরে প্রবেশ করলে সেই জীবাণুটাকে শ্বেত রক্তকণিকা তার স্মৃতিতে রেখে দেয়। পরবর্তী সময়ে একই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত শ্বেত রক্তকণিকা অ্যান্টিবডি তৈরি করে জীবাণুকে ধ্বংস করে দেয়। আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে একবার কোনো সংক্রামক রোগে আপনি আক্রান্ত হলে ভবিষ্যতে আপনার সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ আপনার শরীরে অ্যান্টিবডি আছে। আবার সেই রোগের টিকা নিলেও আপনার শরীরে তৈরি হবে রোগ প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি।

ফিরে আসি হার্ড ইমিউনিটির আলোচনায়। নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, আবার নেই করোনা চিকিত্সার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধও। ফলে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক সংক্রমণের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন সম্ভব কিনা, সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। একটি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির এ পদ্ধতি নিয়ে অবশ্য ভিন্ন মতও রয়েছে।

ব্রিটেনের গবেষকদের মতে, একটি জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০ শতাংশ মানুষ যদি নির্দিষ্ট কোনো রোগ বা সংক্রমণের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের মাধ্যমে বাকি ৪০ শতাংশ সংবেদনশীল মানুষের মাঝে আর ওই রোগ ছড়াতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলছে, এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে কমপক্ষে ৭০ শতাংশের মাঝে। আর তাহলেই তৈরি হবে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি।

তবে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক (জুন ২০২০) গবেষণা থেকে জানা গেছে, একটি এলাকায় ৪৩ শতাংশ মানুষ যদি নিজের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করতে পারে তাহলেই সেখানে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে। আর এই হার্ড ইমিউনিটি যে এলাকায় রয়েছে, সেখানে করোনা প্রবেশের সুযোগ কম পাবে। অর্থাত্ আগের গবেষণায় যেখানে বলা হয়েছিল, একটি এলাকার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি থাকলে তবেই সেখানে করোনার গ্রাস গাঢ় হতে পারে না, সেখানে বর্তমান গবেষণা বলছে সেই পরিসংখ্যান ৪৩ শতাংশ।

আবার উল্টো ফলও আছে। জুলাইয়ে প্রকাশিত স্পেনের এক নয়া সমীক্ষায় প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটির সম্ভাব্যতা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। চিকিত্সাসংক্রান্ত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত ৬০ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, স্পেনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি হলেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশের। অর্থাত্ অধিকাংশ মানুষের দেহেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। অথচ হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব অনুযায়ী, যেসব এলাকায় সংক্রমণের মাত্রা বেশি হবে, সেসব জায়গায় মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির হারও বেশি হবে। এক্ষেত্রে গবেষকদের একাংশের ব্যাখ্যা, স্পেনে কভিড-১৯-এর প্রভাব মারাত্মক হলেও নির্দিষ্ট এলাকায় অনেক বেশি মানুষ একসঙ্গে সংক্রমিত হননি। ফলে জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমিউনিটিও তৈরি হয়নি। কাজেই প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটির যেটা মূল ধারণা, যথেষ্টসংখ্যক মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এর সংক্রমণ ঠেকানো যাবে, সেটা স্পেনের নতুন এ গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

ইউরোপে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে স্পেনের এটিই সবচেয়ে বড় জরিপ বলে ধারণা করা হয়। চিকিত্সাসংক্রান্ত জার্নাল ল্যানসেট সাময়িকীর ওই গবেষণায় আরো বলা হয়, প্রায় একই ধরনের গবেষণা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রেও হয়েছে। এতে দেখা গেছে যেখানে সংক্রমণের হার ব্যাপক, সেসব এলাকায়ও অনেক মানুষ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।

নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সামাজিক সংক্রমণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে আরো কিছু সমস্যা আছে। যেমন দেহে নভেল করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি থাকার কারণে কেউ আবার নতুনভাবে সংক্রমিত হতে পারে কিনা বা এটি কতক্ষণ ভাইরাস থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

প্রকৃতপক্ষে করোনা প্রতিরোধে প্রাকৃতিক হার্ড ইমিউনিটি তৈরির ভরসায় আর থাকতে চাইছেন না বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কভিড-১৯ নির্মূলে নির্দিষ্ট ওষুধের অভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধে কৃত্রিম ভ্যাকসিন বা টিকাই হচ্ছে একমাত্র অবলম্বন। মোদ্দাকথা হলো, হার্ড ইমিউনিটি তৈরির জন্য সংক্রমণ নয়; ভ্যাকসিনটাই আসল। আর যতদিন টিকা বা ভ্যাকসিন না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং রোগ শনাক্ত করে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমেই সামনের দিনে করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

মু. মাহবুবুর রহমান: ফার্মাসিস্ট, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন