মহামারী, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আন্তর্জাতিকতার গোলকধাঁধায় মানুষ

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

লাদাখ-গালওয়ান, জম্মু-কাশ্মীর,তিব্বত-ম্যাকমোহন, নেপালের নতুন মানচিত্র, হংকংয়ের আন্দোলন, ইদলিব-সানা, গাজা-পশ্চিম তীর, উইঘুর-রাখাইন, ইরাক, আফগানিস্তান কথিত আরব বসন্তের মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া বা আলজেরিয়া, সুদানসহ অগুনতি নতুন-পুরাতন সমস্যা ‘দীর্ঘজীবী হও’ এর আশীর্বাদের কবলে পড়ে গেছে বা পড়ে আছে।

সবকিছুই নির্ভর করছে বিশ্বমোড়লদের ‘সমবায় সমিতি’ ধরনের জোট বা জোট বহির্ভুত স্বার্থ-চিন্তার অমানবিক ঐক্যের নিরন্তর খেলার গতি-প্রকৃতির ওপর।

বিশ্ব খেলোয়াড়দের বিভাজিত জাত, ধর্ম, বর্ণ, আন্তঃমহাদেশ, পূর্ব-পশ্চিম ভাবনা-মতবাদ-উচ্চারণ-আচরণ সবই বাহ্যিক রূপ।

এখানে আমেরিকা-ইসরায়েল-সৌদি আরব (তার মরু মিত্ররাসহ) রাশিয়া-চীন-ভারত-ব্রিটেন-ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেকে বহু লোকপ্রিয় ভেদাভেদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন সমীকরণে একে অপরের সহযোগী।

 তাদের প্রকাশ্য-গোপন স্বরূপ-স্বার্থ এক ও অভিন্ন। সবখানেই নিপীড়ন-অত্যাচার-যুদ্ধ বা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, কোনো কিছুই মানুষের জন্য নয়। অথচ জনগণকে কৌশলে এসবের নির্মম ভুক্তভোগী ও সফলভাবেই একধরনের মনস্তাত্বিক অংশীজন করে ফেলা হয়েছে।

তবু মানুষেরা, নিপীড়ন-কূটকৌশল-অন্যায় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয় না। বরং অন্যায্যতার সর্বগ্রাসী শিকারের একাত্মতায় ভুল আবেগ ও বিতর্কে শামিল হয়ে যায়, নিজেদের কোনো কল্যাণ ছাড়াই জান্তে-অজান্তে।

স্বার্থ-স্বরূপ অভিন্ন হলেও দেশ ভেদে এসব লুটপাট-অন্যায়ের দৃশ্যমান চালচিত্র প্রতিনিয়ত মানুষের কাছে উত্তেজক বস্তুর মতো হাজির করা হয়। করোনাকালেও এ খেলার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকে এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, চিকিৎসাকে ছাপিয়ে ওগুলোতেই মানুষ মনোযোগী হয় বেশি।

দখলদারিত্বের কারিগররা সুচতুরভাবে, করোনায় করণীয়কেও মহাবিতর্কের বিষয়বস্তু বানিয়ে আসল দায়িত্ব থেকে সরে আসতে সক্ষম হয়। মানুষও তার ন্যায্য চাওয়া আর বুঝে উঠতে পারে না। লকডাউন, কারফিউ, জরুরি অবস্থা, জোনিং, স্যানিটাইজার, ছুটি, ভ্যাকসিন, ওষুধ, জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি, টেস্ট, মাস্ক, পিপিই, আইসিইউ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, ভাইরাস ছড়ানোর পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা ও চিন্তার গোলকধাঁধায় জনগণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে এসবের বিতর্ক হয়ে যায় মুখ্য, গৌণ হয়ে পড়ে চিকিৎসার মৌল চাহিদা।

বিশ্বজুড়ে মানুষও খেয়ে না খেয়ে, চিকিৎসার বিশ্ব বেহাল রূপের মধ্যেও এসব বিষয়-ঘটনার ‘আনন্দ’ ও বিতর্কের ভাগীদার বনে যায়।

মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে- মরছে! এ খবর এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে, পানসে! বাংলাদেশে ত্রাণ-দান-অনুদান-প্রণোদনা-বাজেটের বাস্তবতা এসবও এখন আর তেমন কোনো আলোচ্য বিষয় নয়! এমনকি এক মৌসুমেই দুই দফার বড় বন্যা- এটাও যথাযথ গুরুত্বের জায়গায় নেই। 

মৃত্যু-ক্ষুধা-দারিদ্র্য-আশ্রয়হীনতা-বন্যা-মহামারী-চিকিৎসা কোনো কিছু নিয়েই মানুষ খুব বেশি বিচলিত বলে মনে হচ্ছে না। 

বরাবরের মতো এখানকার মানুষেরা উত্তেজক বিষয়বস্তু পেয়ে গেছে- রিজেন্ট সাহেদ ও জিকেজি সাবরিনা কাণ্ডে। 

তুমুল উত্তেজনা-বিতর্ক! এ জাতীয় ঘটনা, ঘটনার পরম্পরা, বিতর্ক- এগুলোরও একটা ভাইরাসধর্মী রূপ আছে। সাধারণ মানুষ এগুলোতে মশগুল থাকে এবং সীমানা-পরিধি-ফলাফল উপলব্ধি করতে করতেই নতুন বিষয়ে ঢুকে যায় এবং যথারীতি আগেরটা বিস্মৃতিতে তলিয়ে যায়। 

এই ঘূর্ণাবর্ত ও আপাত তৃপ্তির মধ্যেই মানুষের প্রাপ্যতার সীমারেখা নিয়ন্ত্রিত থাকে। এ পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকান দার্শনিক নোয়াম চমস্কি বলেন— ‘জনগণকে নিষ্ক্রিয় এবং বাধ্যগত করে রাখার বুদ্ধিদীপ্ত উপায় হচ্ছে, মতামতের গ্রহণযোগ্যতার সীমাটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু সেই সীমানার ভেতর তুমুল বিতর্ক করার সুযোগ দেয়া।’ বিশ্বজুড়ে এই সীমাবদ্ধতার চর্চাই চলছে। 

বড় পরিসরে লাদাখ, কাশ্মীর, ইদলিব, উইঘুর, রাখাইনসহ আরো বহু আরোপিত বিশ্বসংকটের দক্ষ অথচ অকল্যাণের অসাড়, অনুগত, সীমাবদ্ধ কর্মকাণ্ড, উত্তেজনা ও বিতর্ক বিরাজমান। আমাদের ‘উত্তেজনা, পরিতৃপ্তি, আনন্দ ও বিতর্ক’ গুলো কি আমাদের মতো করে সেসবেরই চাতুর্যময় প্রতিচ্ছবি?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন