আলোকপাত

জীবন, জীবিকা ও জাতীয় বাজেটের গতিপথ

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, মো. শাহ পরান মোস্তফা ওয়ালিদ পাশা, আদরিনা ইবনাত জামিলী আদিবা, ওয়াহিদ হালদার, ফাহিম শাহরিয়ার

পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে কভিড-১৯-এর মধ্যেই দেশের ৪৯তম জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়েছে। এরই মধ্যে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকোচন শুরু হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের পর প্রবৃদ্ধির এত বড় পতন আর দেখা যায়নি। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই সংকোচন অর্থনীতির গতানুগতিক কারণ তথা চাহিদা জোগান হ্রাসের কারণে ঘটছে না। বরং করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী সরকার কর্তৃক সকল প্রকার অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের ফলে অর্থনীতি মন্দায় পতিত হয়েছে। তাই বিচক্ষণতার সঙ্গে সরকারকেই বিপর্যয় মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিতে হবে। সমস্যা আগেকার মতো নয়, তাই প্রচলিত কায়দায় সমাধানও কাজ করবে না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় তাই নতুন ধরনের পথনির্দেশের আবশ্যকতা রয়েছে।

দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়

২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার দশমিক শতাংশ নির্ধারণ প্রশ্নবিদ্ধ। জিডিপি উৎপাদনশীল খাতের অবদান ৩১ শতাংশের ওপরে। করোনার কারণে অবদান ১২ দশমিক শতাংশ কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি দশমিক শতাংশ কমে যাবে। হিসাব বলছে, প্রবৃদ্ধির প্রকৃত হার দশমিক শতাংশ।

বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রস্তাবিত দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অবাস্তব। নভেল করোনাভাইরাস অতিমারীর এখনই সমাপ্তির কোনো সম্ভাবনা নেই এবং তা আবার পুনরায় প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে। পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত জিডিপি অর্জনের জন্য অর্থনীতি বর্তমানের চেয়ে শতাংশ দ্রুত হারে বৃদ্ধি করা দরকার, যা কোনো দেশ অর্জন করতে পারেনি। তাছাড়া রেমিট্যান্স আয় এবং পোশাক শিল্প থেকে রফতানি আয় করোনার কারণে অনেক কমে যাবে। বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে আটকে আছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় ৮৩ শতাংশ কমে গেছে। 



সঠিক মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক নীতি কাঠামো দরকার

বাজেটে কতগুলো মূলনীতির আলোকে মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার নীতি কাঠামো প্রণয়ন প্রত্যাশা করা হয়েছে। সরকার কভিড-১৯ মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ব্যবসার জন্য ঋণ সুবিধা তৈরি, চরম দরিদ্র অনানুষ্ঠানিক খাতের স্বল্প বেতনের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা জাল কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ এবং অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি চারটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কৌশল নির্ধারণ করেছে। প্রথমত, জীবন জীবিকায় প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টিকারী জনসেবামূলক খাত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোয় বরাদ্দ দেয়া। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত পরিবর্তনের পরিমাণ দশমিক শতাংশ, যা জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ এবং বাজেটের দশমিক শতাংশ। এছাড়া শিক্ষা প্রযুক্তির দশমিক শতাংশ এবং সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে দশমিক শতাংশ পরিবর্তন থাকলেও জনসেবামূলক খাতে বরাদ্দ অপর্যাপ্তই রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, সবার শোভন পরিমিত জীবিকার নিশ্চিতকরণ। পূর্ববর্তী বছরের মূল্যস্ফীতি সমন্বিত বরাদ্দের তুলনায় বছর সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ ৭৯০ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু এটি করোনার কারণে সৃষ্ট বিপুলসংখ্যক নতুন দারিদ্র্য এবং বেকারদের জন্য যথেষ্ট নয়। তৃতীয়ত, অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব তৈরিতে সক্ষম খাতে বরাদ্দ দেয়া। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা স্বাস্থ্যের বর্তমান বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির দশমিক শতাংশ এবং শূন্য দশমিক শতাংশ, যা গত অর্থবছরের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি। পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতের পুনরুদ্ধার এবং গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়। চতুর্থত, নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা মিশনভিত্তিক কর্মসূচি কৌশল গ্রহণ। শিল্প অর্থনৈতিক সেবা খাতে কেবল হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা খুব বাধা হয়ে দাঁড়াবে। পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে না। আর্থিক খাতের দুর্দশা এবং কভিড থেকে উত্তরণে বাজেটে দিকনির্দেশনার ঘাটতি রয়েছে। পঞ্চমত, উৎপাদন ব্যবস্থাকে টেকসই, জলবায়ুসহিষ্ণু, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকারী এবং সবুজ রূপান্তরযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু এটির প্রতিফলন দেখা যায়নি। ষষ্ঠত, সক্রিয় নাগরিকতার ভিত প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তায় গতানুগতিক বরাদ্দ রেখে এবং দিকনির্দেশনা না রেখে এটি করা সম্ভব নয়।  

দারিদ্র্য অসমতার অবনমনকে নজরে আনতে হবে

মহামারীর প্রভাব সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষত স্বল্প আয়ের মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বেকার, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী। লকডাউনের কারণে আয় কমে যাওয়ায় বা বন্ধ থাকায় ৪৩ দশমিক শতাংশ পরিবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার চেয়ে কম আয় করবে। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতিতে ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পদ্ধতিগতভাবে অর্থনীতি পুনরায় সচল করতে পারলে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৪৩ শতাংশে নেমে আসবে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত এলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যেতে পারে।

করোনাভাইরাস প্রকট অসমতা আরো উন্মোচন করেছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের



আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে শূন্য দশমিক ৫০ এবং পামা রেশিও দশমিক ৯৩ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে শতাংশ হ্রাসে বেকারত্বের শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে। সুতরাং জিডিপি হ্রাসের কারণে বেকারত্বের হার শতাংশের বেশি বাড়তে পারে। ফলে মানুষের আয় কমে যাবে। এরই মধ্যে সেবা খাতের কর্মীদের বেতন ৩১ দশমিক শতাংশ হ্রাস হয়েছে। গণপরিবহন আবাসিক পরিষেবা কর্মীদের বেতন হ্রাস যথাক্রমে ৪৬ দশমিক ১৬ দশমিক শতাংশ। 

কৃষি খাতে ক্ষতি খাদ্যনিরাপত্তার অনিশ্চয়তা

কৃষক তার পণ্যের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না। করোনার কারণে বাজারে জোগান দেয়া সম্ভব হয়নি। আবার মানুষের চাহিদা কমে যাওয়ায় কৃষিপণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। দেড় মাসেরও কম সময়ে শস্য খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং মত্স্য খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মোট হাজার কোটি টাকার দুটি পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প চালু করতে চলেছে, যা ক্ষতির তুলনায় অত্যন্ত অল্প। তবে কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে কৃষি খাতের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক কৃষিপণ্য বীজ আমদানিনির্ভর হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে বার্ষিক ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন গম, থেকে ১০ লাখ টন ভুট্টা, প্রয়োজনীয় তেলের ৮০ শতাংশ এবং চিনি, ডাল, মসলা বিভিন্ন জাতের বীজ আমদানি করতে হয়। গত ছয় বছরে কৃষিতে ভর্তুকি হাজার কোটি টাকার মধ্যে আটকে আছে, যার অর্থ বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর অনুদানের অনুপাত হ্রাস পাচ্ছে। চাষাবাদে বৈচিত্র্য না থাকায় সমস্যা প্রকট হয়েছে। কৃষি এককেন্দ্রিক শস্য চাষাবাদে আটকে আছে। কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ঘাটতি রয়েছে। অর্থবছরে সরকার ভর্তুকিতে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়েছে, তবে বিশ্বব্যাপী মহামারীর মুখে এই বৃদ্ধি স্থিতিশীল খাদ্য সুরক্ষা তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। কৃষি খাতে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার বর্ধিত বরাদ্দ রয়েছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত ব্যয়ের চেয়ে হাজার ৯৬০ কোটি টাকা বেশি। করোনাকালেও কৃষিতে বাজেটের মাত্রা জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এগুলোর কিছুই করা সম্ভব হবে না। 

পুরনো কায়দার বৃহৎ শিল্পকেন্দ্রিক ভাবনা পরিকল্পনা

উৎপাদন যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। পণ্যের এবং বাজারের বহুমুখীকরণ না থাকায় সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করেছে। এক শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে করোনার অভিঘাত এখানে বেশি পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া দেশগুলোয় করোনার আঘাত সবচেয়ে বেশি পড়েছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে পোশাক রফতানি হ্রাস পেয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪৮ কোটি মার্কিন ডলার। আনুমানিক সাড়ে মিলিয়ন বাংলাদেশী পোশাক খাতে কাজ করে এবং প্রায় এক মিলিয়ন শ্রমিককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে শিল্প অর্থনৈতিক সেবার জন্য বরাদ্দ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, যা গেল অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর হাজার ১০১ কোটি থাকা থেকে কিছু কম। এই বরাদ্দ হ্রাসে মহামারী মোকাবেলা করে উৎপাদনশীল খাতের পুনরুদ্ধার পুনর্গঠন কঠিন হয়ে যাবে।

অন্যদিকে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। প্রায় ২৮ শতাংশের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলোর আরোপিত কঠিন শর্তের কারণে ক্ষুদ্র মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ঋণে সহজ প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না। এছাড়া ব্যাংকগুলোয় ঋণখেলাপি সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ নেয়ায় এখন তারল্য সংকট রয়েছে। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) জন্য ভর্তুকিযুক্ত সুদের হারে ২০ হাজার কোটি টাকার আরো একটি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিঘাত পড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের ওপর। নারী উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের সব ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা। এবারের বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে প্রধান বাধা জামানতসংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা এবং গ্যারান্টি, বাণিজ্য লাইসেন্স এবং ঋণ পদ্ধতিতে কঠোরতা এবং নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি ব্যাংকারদের মানসিকতা।

পরিবহন, পর্যটন যোগাযোগে ক্ষতি

সেবা খাতে ২০১৯-২০ বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ কমে গেছে। নির্মাণ শিল্প, পরিবহন, পর্যটন, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পর্যটন আতিথেয়তা শিল্পে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে নিযুক্ত অর্ধমিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। মহামারীজনিত কারণে খাতে প্রায় হাজার ৭০০ কোটি টাকা লোকসানের অনুমান করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে পরিবহন খাতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ব্যাংক বীমা করোনার আগেই ধুঁকছিল। এখন সরকার অর্থ নিলে আরো একবার তারল্য সংকটে পড়বে। বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়বে। সেবা খাতের পুনরুদ্ধারের বিষয়টি বাজেটে উপেক্ষিত থেকে গেছে। জনসেবা, পরিবহন, যোগাযোগ ইত্যাদি সেবা খাতে আগের তুলনায় বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে।

দরকার দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা

কভিড-১৯ সংকট সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়ায় বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে রাজস্ব সংগ্রহ শতাংশ কমে যেতে পারে। প্রকৃত খাতে ক্রমাগত ক্ষতি করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে রাজস্ব আদায়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২০ অর্থবছরের শেষ নাগাদ আদায়কৃত পরিমাণ সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজস্ব আহরণের নিম্নমুখী চলনের মুখে সরকার ব্যাংক থেকে অর্থঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে থেকেই খেলাপি ঋণ তারল্য সংকটের সমস্যায় জর্জরিত ব্যাংক খাতের জন্য ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছুই নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে বেশি (৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা) অথচ সরকারের সামনে বিদেশ থেকে তুলনামূলক কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ থাকলেও সে ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এখনো অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি, বাজেটেও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে জনপ্রশাসন খাত। খাতে ফি বছর বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে, যার অধিকাংশই ব্যয় হয় বেতন-ভাতা অন্যান্য অনুন্নয়ন খাতে। এর বাইরে নিয়মিত হারে পদের অতিরিক্ত পদায়ন পদোন্নতি এবং বেশকিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখায় একদিকে জনগণ প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ অতিরিক্ত ব্যয়ও বেড়ে চলেছে। 

কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধিতে সরকারের মনোযোগ বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি, কর জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের অকার্যকারিতার কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে অনেক কর আদায় সম্ভব হচ্ছে না। দেশে কর্মরত বিদেশী শ্রমিকদের কাছ থেকেও অনেক কর আদায় করা যেত। এগুলো না করে ইন্টারনেট, মোবাইল রিচার্জ, অনলাইন কেনাকাটার ওপর ঢালাও হারে কর আরোপ করায় স্বল্প আয়ের মানুষদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। লকডাউন কার্যকর করা এবং অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার স্বার্থে এগুলো বরং করের আওতামুক্ত রাখার প্রয়োজন ছিল।  সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কর রাজস্বের পরিমাণ ছিল লাখ ১৩ হাজার ৬৮ কোটি টাকা; যা প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় অনেক কম ( লাখ ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা)

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি

চলমান পরিস্থিতিতে নতুন আর্থিক রাজস্ব নীতি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি চলমান অতিমারী মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য ছাড়া মানবসমাজের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এমন ধারণাও করা হয়ে থাকে যে বর্তমান মহামারী ক্রমাগত পরিবেশ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসেরই ফলাফল। বর্তমান বাজেট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ছাড়াও বায়ু, মাটি পানির দূষণ রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিশ্বব্যাপী মহামারী  সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের ধরনকেই পাল্টে দিয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশার বার্তা নিয়ে আসার কথা ছিল। সরকারের সামনে গতানুগতিকতার বাইরে এসে সর্বজনের বাজেট তৈরির সুযোগ ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাজেট অন্তর্ভুক্তিহীনতার জালে জড়িয়ে রয়েছে। গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাব বর্তমান বাজেটেও পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমান মহামারী একদিকে স্বাস্থ্য খাতের দৈন্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি সর্বজনীন নিরাপত্তার ব্যবস্থার আশু প্রয়োজনীয়তার কথাও নীতিনির্ধারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যদিও বাস্তবে প্রতিফলন সামান্যই। নতুন দরিদ্রদের অবস্থার উন্নতিকরণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আদৌ কোনো অবদান রাখবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

প্রতি বছর প্রস্তাবিত বাজেট সংশোধিত বাজেটে বড় রকমের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কী প্রক্রিয়ায় বাজেট সংশোধন হয়, তার নির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। বাজেটের বিরাট অংশ প্রতি বছরই অব্যবহূত থেকে যায়। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার জন্য বাজেট প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত অংশগ্রহণ নিশ্চিতের বিকল্প নেই। বাজেট প্রক্রিয়ায় সংসদীয় পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণের সুযোগ নেই। প্রক্রিয়াটি পুরোপুরো এককেন্দ্রিক। প্রধানমন্ত্রী সবকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন। সংসদ বাজেট পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে কিন্তু পরিবর্তন করতে পারে না। সংসদ সদস্যরা দলের বাইরে ভোট দেন না। ফলে বাজেট কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই পাস হয়ে যায়। অন্যদিকে বাজেট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শক্ত নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণের দরকার। এতে জবাবদিহিতা তৈরি হবে।

সংক্রমণ দিন দিন বেড়ে চলছে। জীবন থাকলে অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা প্রকট। জীবন জীবিকা বাঁচাতে লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

 

. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ারপারসন

উন্নয়ন অন্বেষণ

মো. শাহ পরান, মোস্তফা ওয়ালিদ পাশা, আদরিনা ইবনাত জামিলী আদিবা, ওয়াহিদ হালদার ফাহিম শাহরিয়ার: গবেষক, উন্নয়ন অন্বেষণ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন