উচ্চতর প্রবৃদ্ধি বনাম ক্রমবর্ধমান বৈষম্য

আবু তাহের খান

সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় আলোচনা এই যে, বাংলাদেশ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী সদ্য সমাপ্ত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। অন্যদিকে বিবিএস-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানাচ্ছে যে, ২০১০-১৬ মধ্যবর্তী ৬ বছরের ব্যবধানে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর সারা দেশের মধ্যেই অতিদরিদ্র মানুষের ভোগ সক্ষমতা ক্রমাগত হারে হ্রাস পাচ্ছে এবং নগরে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ০ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা- দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ রয়েছে দারিদ্র ঝুঁকিতে, আয়বৈষম্যের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে যারা আবারও দরিদ্র হয়ে পড়তে পারে।

অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিবিএস-এর খানা ও আয়ব্যয় জরিপের তথ্য পর্যালোচনান্তে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আয় ও সম্পদ বৈষম্য দুই-ই ক্রমাগত হারে বাড়ছে। আর একই তথ্য-উপাত্তের প্রবণতা বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা যায় যে, রাষ্ট্রের বিদ্যমান নীতিকাঠামো অব্যাহত থাকলে এবং এ কাঠামোর আওতায় বিত্তবান সুবিধাভোগীরাই বর্তমানের ন্যায় এর উপরকাঠামোতে বসে নিজেদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পেতে থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই চরম বৈষম্যপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। বর্তমানে এরূপ চরম বৈষম্যপূর্ণ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে বিশ্বের দরিদ্র দেশ নামিবিয়া ও হাইতি, যেখানে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ৪১ শতাংশ ও ৫৯ শতাংশ। তো, বৈষম্যের বিবেচনায় বাংলাদেশকে যদি হাইতি ও নামিবিয়ার কাতারেই নামতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের এ প্রবৃদ্ধি কার স্বার্থে, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে বৈকি!

তো এই যখন প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের পাশাপাশি চিত্র এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে এতগুলো সূচকে দারিদ্র্য পরিস্থিতি যখন আবারো ঝুঁকির মুখে তখন মানতেই হবে যে, উল্লিখিত উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে দেশে পাকিস্তানী আমলের ২২ পরিবারের মতো গুটিকতক বিলিয়নেয়ার পরিবার গড়ে ওঠার বিষয়টিই এখন সর্বাধিক দৃশ্যমান হয়ে ওঠছে। তারচেয়েও উদ্বেগজনক ঘটনা হচ্ছে, এই বিলিয়নেয়াররা গড়ে ওঠছে ঋণখেলাপি, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ, মাস্তান, তদবিরকারক, মুদ্রা পাচারকারী, কর ও শুল্ক ফাঁকিদাতা, ক্যাসিনোপতি প্রভৃতি শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কালো মানুষদের মধ্য থেকে। বস্তুতঃ এই দুর্নীতিবাজ কালো মানুষেরাই এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে রাতারাতি অগাধ বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে ওঠছে। দেশের উন্নয়ন ও উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রক্রিয়ায় কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে মূল ভূমিকা রাখলেও এসবের প্রাকারন্তরিক ফলাফলের সিংহভাগই ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে ওসব কালো লুটেরাদের দ্বারা।


দেশের মোট সম্পদের কতভাগ কার মালিকানাধীন আছে, সে বিষয়ে জাতীয়ভিত্তিক কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ না থাকলেও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা যায় যে, দেশের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ সম্পদের মালিকানা এখন মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। বৈষম্যের এ চিত্র পাকিস্তানী শাসনামলের দুই স্তরের বৈষম্যের কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, যে বৈষম্যের প্রথম স্তরে ছিল ২২ পরিবারের হাতে রাষ্ট্রের সিংহভাগ সম্পদ কুক্ষিগত থাকার চিত্র যা উপরেও উল্লেখ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় স্তরে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের বিষয়টি। বস্তুতঃ এ বৈষম্যের পটভূমিতেই সংগঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং সে অর্থে বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি শোষণহীন সমতাপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিরাজ করছে, তা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ঐ মৌলচেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অপরাপর বহু রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে উচ্চতর ধারার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-যে ক্রমশই অধিকতর সম্পদশালী অথচ বৈষম্যপূর্ণ এক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে, সেটিও মুক্তিযদ্ধের অন্তর্গত চেতনাকে লালন করে না (এখানে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিরোধিতা করা হচ্ছে না)। ফলে একাত্তরের তুলনায় অনেক বেশি সম্পদ নিয়েও ২০২১ সালে বাংলাদেশ যখন তার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করবে, তখন অন্য অনেকের পাশাপাশি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়া অনেক সচেতন মানুষের বুকের ভেতরটাই হয়তো কষ্টে ভারি হয়ে ওঠবে এই ভেবে যে, কালো অর্থ ও দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন এ রকম একটি চরম বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্যই কি আমরা যুদ্ধ ও সংগ্রাম করেছিলাম?


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থা তৈরি হলো কেমন করে? পূর্ণাঙ্গ জবাবের জন্য দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। এখানে সংক্ষেপে শুধু বলি: ১৯৭৫-এর নির্মম সামরিক অভ্যুত্থানের পর তৎকালীন সামরিক শাসকেরা প্রথমেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে নামমাত্র মূল্যে সেগুলোর মালিকানা নিজেদের পক্ষশক্তি হিসেবে বেছে নেয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে তুলে দেন। পরবর্তীতে একই ধারায় বিরাষ্ট্রীয়করণের অপেক্ষায় থাকা অবশিষ্ট শিল্পকারখানাগুলোও একই শ্রেণির হাতে একই প্রক্রিয়ায় তুলে দেন ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় আসা পরবর্তী শামরিক শাসক, যেটিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগতকরণের মাধ্যমে রাতারাতি বিত্তবান শ্রেণি গড়ে ওঠার দ্বিতীয় স্তর হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। অবশ্য সম্পদ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ও এসবের মালিকানা আয়ত্ত্বকারীগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিবেচনায় এবং একই ধারাবাহিক সময়ে সংঘটিত এ স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে একটি অভিন্ন সম্পদ কুক্ষিগতকরণ স্তরের আওতায় গণ্য করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, এ উভয় সামরিক শাসনামলেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগতকরণের ধারায় আর যে যে কর্মকা- বিশেষ ভূমিকা রাখে, তারমধ্যে অন্যতম ছিল ভূমি দস্যুতা, ঋণ ক্ষেলাপ, এনজিও ব্যবসা, আদম পাচার ইত্যাদি।


বাংলাদেশে বিত্তবান শ্রেণি গড়ে ওঠার দ্বিতীয় স্তরটি শুরু হয় ১৯৯০ দশকের গোড়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে আকস্মিক বিপর্যয় নেমে আসার প্রেক্ষিতে পুরো বিশ্বব্যবস্থাটিই একচেটিয়া পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর। এককেন্দ্রিক এই নতুন বিশ্বব্যবস্থার অনিবার্য প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশেও তখন থেকে গড়ে ওঠতে থাকে একটি নতুন আমদানিকারক শ্রেণি কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া যাদের অন্যতম ব্যবসায়িক কৌশল। এরাই ক্রমান্বয়ে অর্থপাচার, শেয়ারবাজার কারচুপি, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের বিত্তবৈভবের পরিধিকে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে তোলে। ১৯৯০ দশকের গোড়া থেকে অদ্যাবধি এই শ্রেণিটিই বস্তুতঃ সম্পদ কুক্ষিগতকরণের ধারাকে সচল রেখে চলেছে।


উল্লিখিত এই দুই শ্রেণির পর তৃতীয় যে শ্রেণিটি বাংলাদেশে রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিজস্ব আঙ্গিকের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজ, মাস্তান, তদবিরকারক, টাউট-বাটপার, শালিসকারক ইত্যাদি এবং সর্বসম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা ক্যাসিনোপতিগণ। আপাতঃদৃষ্টে এরা রাজনৈতিক দলের পরিচয়দানকারী হলেও বস্তুতঃ এদের নিজস্ব কোনো আদর্শিক দলীয় পরিচিতি নেই। ১৯৭৫-এর পর থেকে অদ্যাবধি যখন যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা সে দলেরই কর্মী, সমর্থক ও নেতা বনে গেছেন। পাশাপাশি আবার এটাও ঠিক যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো জেনেশুনেই অন্যদলের নেতা ও কর্মীদেরকে নিজ দলে জায়গা করে দিয়েছে। নানা মাত্রার অনৈতিক প্রশ্রয় ও সমর্থনেই এদের অনেকের বিত্তবৈভব ফুলেফেঁপে পাহাড়সম হয়ে ওঠেছে, যার ছিটেফোঁটা ইদানিং কিছুটা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে ক্যাসিনো অভিযানের পর থেকে। অবশ্য সে অভিযানও এখন থমকে গেছে বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে, যদিচ ঘোষণা ছিল যে, এর ধারাবাহিকতায় অন্যত্র এবং অন্যক্ষেত্রেও এ অভিযান চলবে।


অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পদের মালিকানা কুক্ষিগতকরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিগত ভূমিকা ও সমর্থনের বিষয়টিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে এ ধারার চতুর্থ স্তর হিসেবে, যেটি লেখার গোড়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সম্পদের সমতাপূর্ণ বণ্টনের পক্ষে পর্যাপ্ত সুরক্ষা থাকলেও গত ৪৮ বছরের ব্যবধানে ক্ষমতায় থাকা সামরিক বা বেসামরিক প্রতিটি সরকারই সংবিধানের মৌলিক চেতনাকে উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এমনসব নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা সমাজে সম্পদবৈষম্যই শুধু সৃষ্টি করেনি, অসৎ উপায়ে অযোগ্য লোকদের দ্বারা সম্পদ কুক্ষিগতকরণের ধারাকেও ত্বরান্বিত করেছে। বোধগম্য যে, সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই এটি করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে আসা সরকারগুলোও যখন প্রায় সমান উৎসাহে একই কাজ করে, তখন সত্যিই কষ্ট লাগে। আর এ কাজে আমলারা-যে তাদের প্রথাগত মুৎসুদ্দি চরিত্রের আড়ালে সামান্য উচ্ছিষ্ঠ ভোগের বিনিময়ে রাষ্ট্রের বিশাল সম্পদ ও জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থ লুটেরাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তা অবশ্যই কষ্টদায়ক। কিন্তু তারচেয়েও বেশি কষ্টদায়ক এটি দেখা যে, নির্বাচিত সরকারগুলো বুঝেশুনেই এমনসব ব্যক্তিদেরকে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বসাচ্ছেন, যারা নিজেরাই সম্পদ কুক্ষিগতকরণকারী শ্রেণির প্রতিনিধি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। ধনী পরিবারের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দরিদ্র পরিবারের তুলনায় ১১৯ গুণ (বিবিএস : সেপ্টেম্বর ২০১৯)। প্রসঙ্গত প্রশ্ন রাখি: এই যে গত কয়েক মাসে ঋণ খেলাপিসহ বেসরকারি ব্যাংক মালিকদেরকে নানা অনৈতিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হলো, তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে নগদ ভুর্তকি বৃদ্ধিসহ বিশাল অঙ্কের ‘প্রণোদনা’ বিলানো হলো, জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থে সেসব দায় মেটানোর মধ্য দিয়ে দেশে সম্পদ বৈষম্য বাড়বে নাকি কমবে?


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থা থেকে বেরুবার উপায় কী? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রের বৈষম্যপূর্ণ এ নীতিকাঠামোর আওতায় সর্বাধিক সুবিধাভোগী কায়েমী স্বার্থভোগী আমলা, সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী -এরা কেউই বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের পক্ষে নন। অন্যদিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণীমূলক সিদ্ধান্তসমূহ যাতে বৈষম্য বিলোপের ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে যায়, তজ্জন্য আমলাতন্ত্রকে যথাযথভাবে পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের সামর্থও রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যুক্ত অধিকাংশ রাজনীতিকের নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা: যাদের জন্য এ পরিবর্তনের প্রত্যাশা, সেই সাধারণ জনগণের মধ্যেও আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা দিনে দিনে এতোটাই প্রবল হয়ে ওঠছে যে, রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বৈষম্য হটিয়ে সমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে কতোটা সংগঠিত করা যাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

উল্লিখিত পরিস্থিতিতে বৈষম্যকে যদি হটাতেই হয়, তাহলে সংবিধানই হচ্ছে এখন মূল ভরসা, যার প্রায় পুরোটাই সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে ধারণ করে আছে এবং যার নির্দেশনা অনুসরণ নীতিনির্ধারকসহ সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক। এ অবস্থায় রাষ্ট্র যদি বৈষম্য বৃদ্ধিমূলক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে সংবিধান লঙ্ঘনের কারণে এখন থেকে জনগণের পক্ষে কেউ না কেউ তার বিচারিক প্রতিকার চাইবেন--এটাই প্রত্যাশা। আর সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের কাছে অনুরোধ, এ ধরনের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ভালোভাবে যাচাই করে দেখুন, সেটি সংবিধানের সাথে যথেষ্ঠ সাংঘর্ষিকতামুক্ত কিনা। তবে সমাজ থেকে সম্পদবৈষম্য রোধের শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিক নির্দেশনাকে ব্যবহার করতে যাওয়ার আগে আমরা যেন মনে রাখি যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ইতিহাসে যত রক্ত ঝরেছে, তার প্রতিটি কণা বৈষম্য ও বঞ্চণার বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই নিরন্তর স্বাক্ষী। ফলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যখন চারদিক ছাপিয়ে উচ্চকিত হয়ে ওঠে এ তথ্য যে, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির হারের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো উচ্চতর হারে বাড়ছে বৈষম্য, বিশ্বাস করুন, তখন ওই প্রবৃদ্ধির খবর আর সাধারণ মানুষকে একদমই আকর্ষণ করে না।


আবু তাহের খান

পরিচালক

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

[email protected]


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন