ধর্ষণ: কারণ ও করণীয়

আশেক মাহমুদ

২০২০ সালে নতুন বছরে সবারই প্রত্যাশা ছিল উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা। কিন্তু বিধি বাম। বছরের শুরুতেই ঘটে যায় নির্মম হৃদয়বিদারক ঘটনা। ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী রাজধানীর শেওড়া এলাকায় বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হন। এ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ।সবারই একটাই দাবি—ধর্ষক মজনুর ফাঁসি চাই।

এটাকে কেবল ঘটনা হিসেবে দেখলেই হবে না। কেননা ২০১৯ সালে ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানা এলাকায় ধর্ষণ ও গণধর্ষণের অভিযোগে প্রায় ৫০০ (৪৯৮) মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের মামলার সংখ্যা ৩৭টি। এই যদি হয় পরিসংখ্যান, তাহলে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারী নিপীড়ন যে কী হারে বেড়ে চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। এ থেকে আরো স্পষ্ট যে ধর্ষণ এখন আর কোনো অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়; বরং এটি এখন মহামারী হয়ে গেছে।  মানুষ প্রতি ক্ষণে নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে অস্থির চিত্তে কাটাচ্ছে দিন আর রাত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ দুটি আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি ভুগছে—এর একটি হলো সড়কে হত্যা আর অন্যটি ধর্ষণ-গণধর্ষণ। আগেকার দিনে রোগ-জীবাণু মানুষকে আক্রমণ করত, সেই রোগের বিস্তার মহামারী আকার ধারণ করত। মানুষ তার জ্ঞান-বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে একসময় রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আজকের দিনে মানুষ নিজেই যখন সবচেয়ে বড় ঘাতক হয়ে গেছে, তখন তার প্রতিকার কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের আসলে বোঝা দরকার কেন ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করেছে, আর কী-ইবা করণীয় আছে এই অশুভ রোগের চিকিত্সার জন্য।

অবিচারের সংস্কৃতি: আমরা সবসময় লক্ষ করছি বিচারহীনতা অথবা অবিচারের সংস্কৃতি আমাদের কাছে এখন খুবই স্বাভাবিক একটা কিছু। অবিচার যখনই একটা সমাজে আদর্শ হয়ে যায়, তখনই অনাচারীদের দাপটে সাধারণ মানুষকে ভীত-বিহ্বল হয়ে থাকতে হয়। আইন যখন নিজস্ব গতি হারিয়ে প্রভাবশালীদের হ্যালো আর বিত্তবানদের অর্থের বৃত্তে বৃত্তাবদ্ধ হয়, তখনই জনসাধারণ নিজেদের অসহায় বোধ করে, সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কৃতিকারীরা তাদের অপকর্ম করে নির্ভয়ে ও নির্ভাবনায়। কিছুু স্পর্শকাতর ঘটনায় আন্দোলন হলে অথবা মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা বাড়লে তাকে আটক করা হয় কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে রায়ে বিলম্ব হয়। এর পেছনে দুটো কারণ, এক. আইনি ব্যবসাকে চাঙ্গা করা। দুই. জনমন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া। ফলে যত বেশি অনাচার হবে ততই আইন নিয়ে ব্যবসা হবে স্ফীত।

সিস্টেম ক্রাইসিস: আমাদের মিডিয়া, প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যে ছকে বেঁধে রাখা হয়েছে, সেই ছকের মধ্যে অদ্ভুত অমানবিকতার চর্চা রয়েছে। সব ছকই চলছে পুঁজিবাদী আর বস্তুবাদী কায়দায়। মিডিয়ায় নারী হলো আনন্দ-বিনোদনের এক মোহনীয় বস্তু। ফলে নারী নিজেই নিজেকে উচ্চতর সত্তা ভাবতে পারছে না। এমনভাবে নারীকে চিত্রায়িত করা হচ্ছে যেন নারীর কাজই হলো নিজেকে রূপসজ্জায় সজ্জিত করা আর পুরুষ হবে সেই সাজসজ্জার ভোক্তা। এভাবে মিডিয়া নারী ও পুরুষ উভয়কে মোহাচ্ছন্নতার জালে আবদ্ধ রাখছে। আর এ ধরনের মিডিয়াকে দেয়া হচ্ছে অপার স্বাধীনতা। কেননা বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজিবাদী বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে চাঙ্গা রাখতে এরূপ নিম্নমানের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেয়া হচ্ছে।

স্মাটফোন নিজেই যখন উদ্দীপক: সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। যে তিনবেলা খাবার জোগাড় করতে পারে না, তার হাতেও স্মার্টফোন। নেশাদ্রব্যের মতো স্মার্টফোনের মধ্যে রক্ষিত বিনোদনসামগ্রী প্রতি মুহূর্তেই প্রতিটি যুবককে ইন্দ্রিয় লালসায় উন্মত্ত করে তুলছে। স্মার্টফোন যত সহজে একজনকে উত্তেজিত করতে পারে, এমনটি এর আগে কোনো যন্ত্র করতে পারেনি। ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সব দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। মাদকের ব্যাপারে আইনি বাধা থাকলেও স্মার্টফোনের ব্যাপারে আইনি কোনো বাধা নেই। অথচ স্মার্টফোন যে মাদকতা আনতে পারে, তার পরিণতি খুবই ভয়ানক। স্মার্টফোনের  মেসেঞ্জারে যে পরিমাণে ইভ টিজিং চলছে, তা অন্য সব মাধ্যমকে হার মানায়।

ধর্মের নামে অসংলগ্ন বয়ান: প্রচলিত সমাজে যে ধর্মীয় বয়ান চলছে, তাতে অনেক বেশি প্রাজ্ঞতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সমস্যাটা হলো ব্যখ্যার মধ্যে। কেননা যারা ব্যাখা করছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্মদর্শী বিশ্লেষণের অভাব। বয়ানে নারীদের যেভাবে হিজাবের ব্যাপারে উচ্চ সতর্ক হতে বলা হয়, সেভাবে পুরুষদের লক্ষ করে বলা হয় না। তাছাড়া নারীর বেপর্দাকে যেভাবে দায়ী করা হয়, সেভাবে পুরুষের বেপর্দাকে দায়ী করা হয় না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী যেহেতু পুরুষ, সেক্ষেত্রে কী করে পুরুষরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কীভাবে নারী ও পুরুষ নৈতিকতার চর্চা করতে পারে—এ নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব লক্ষ করা যায়।

ফ্রয়েডীয় চেতনার বিশ্বায়ন: আমরা কমবেশি ফ্রয়েডীয় চিন্তা-চেতনার অনুগামী হয়ে পড়েছি। আধুনিক শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির অবাধ প্রসারে ফ্রয়েডীয় ধ্যান-ধারণার ব্যাপক বিস্তার হচ্ছে। ফ্রয়েডীয় ‘লিবিডো’ ধারণাকে অতি বেশি কাজে লাগাচ্ছে পুঁজিবাদী মিডিয়া -জগত্। ফলে কামুকতার চর্চাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।  যৌন উত্তেজনাই যখন আধুনিক ঘরানায় নৈতিকতা, তখন বহুবিধ সম্পর্ক, পরকীয়া আর ব্যভিচারকে সামাজিক বৈধতা দেয়া হয়। যারা কৌশলে তা রপ্ত করতে পারে, আধুনিক ধারণায় তারা অপরাধী নয়, কিন্তু যারা বিভিন্ন কারণে তা রপ্ত করতে পারে না, তারা এক অদ্ভুত অবদমন বা মানসিক অস্থিরতা অনুভব করে। সে জায়গা থেকে ধর্ষণের এত বিস্তার, যা আজ মহামারী। এর মানে সমস্যাটা ধর্ষণের মধ্যে নয়। সমস্যাটা ফ্রয়েডীয় কালচারের প্রসারের মধ্যে নিহিত। সেই গোড়ায় হাত না দিয়ে আমরা চিত্কার করব কিন্তু সমস্যা থেকেই যাবে।

এসব দিক বিবেচনায় কয়েকটা করণীয় উল্লেখ করতে পারি—
১. ‘ধর্ষণ’-কে অন্যতম প্রধান জাতীয় সমস্যা উল্লেখপূর্বক দ্রুত বিচার কাঠামোতে ধর্ষকের শাস্তি দ্রুত সময় নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে আইনি সংস্কার জরুরি। প্রমাণিত ধর্ষকের পক্ষে উকিল নিয়োগ নিষিদ্ধ করা দরকার।
২. মিডিয়াতে ফ্রয়েডীয় লিবিডো কালচার নিষিদ্ধ করতে হবে। যৌন উত্তেজক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারি করতে হবে। স্মার্টফোনের ব্যবহারে যেমন নিয়ন্ত্রণ জরুরি, তেমনি স্মার্টফোনে নিম্নমানের কালচার উপাদান উপভোগের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে ফিল্টারিং পদ্ধতি চালু করতে হবে।
৩. বহুবিধ সম্পর্ক, পরকীয়া ও ব্যাভিচার নিয়ন্ত্রণে আইনি সংস্কার আনতে হবে, তার প্রয়োগকে গুরুত্ব দিতে আইনকে ব্যবসার জায়গা থেকে সরাতে হবে।
৪. পুরুষ ও নারী উভয়ের চারিত্রিক উন্নতিকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রমে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারকে অঞ্চলভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানে সমবেত করতে হবে। শিক্ষাদানের লক্ষ্যে প্রতিটি স্তরে নৈতিক শিক্ষার কোর্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। এক্ষেত্রে সিলেবাসকে করতে হবে যুগোপযোগী ও উচ্চমানসম্পন্ন।
৫. যেকোনো অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জনগণ যাতে নিয়ম মেনে দাবি প্রকাশ করতে পারে, সেই সুযোগ দিতে হবে। ফলে প্রশাসন এক ধরনের সামাজিক চাপে থাকবে।
৬. ধর্ষককে এমনভাবে বয়কট করতে হবে, যাতে সে সমাজে বেঁচে থাকার কোনো আশ্রয় না পায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। নারীদেরও উচিত হবে অতি উত্সাহী স্বাধীনতার ফ্রয়েডীয় ডোজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনা। কেননা এর সুযোগ নিতে ওঁত পেতে থাকে সুযোগসন্ধানীরা।
আসুন আমরা সবাই সতর্ক হই আর সংস্কারের ব্যাপারে জোরালো দাবি জানাই। আমাদের উদ্যোগেই পরিবর্তন আসবে, নতুবা অন্ধকার আরো ঘনীভূত হবে। কেননা অজ্ঞতা আর নিষ্ক্রিয়তার চেয়ে ভয়ংকর কিছু আমি দেখিনি।

আশেক মাহমুদ: সহকারী অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন