নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমে ১৪.৮%

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত অর্থবছর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর বিপরীতে মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এতেই সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ আত্মতুষ্টি নিয়েই ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের তুলনায় কমানো হয়েছে। তবে নতুন লক্ষ্যমাত্রা (১৪ দশমিক ৮) অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি। বিপরীতে প্রায় আড়াই গুণ বাড়ানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য। আর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে নীতি সুদহার, নগদ জমা ও তরল সম্পদের বিধিবদ্ধ মাত্রাগুলোর সীমা। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। ঘোষিত মুদ্রানীতির ভঙ্গি উল্লেখ করা হয়েছে ‘সতর্কভাবে সংকুলানমুখী’।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতি অর্থবছরের জন্য দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ রীতির পরিবর্তন আনা হয়েছে চলতি অর্থবছর থেকে। এখন থেকে প্রতি অর্থবছরের শুরুতে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।

বছরে দুইবারের পরিবর্তে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণার বিষয়ে গভর্নর বলেন, অর্থবছরের শুরুতে আমরা যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করি, তার সঙ্গে দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। বাজার চাহিদার ভিত্তিতে বছরের যেকোনো সময়েই আমরা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে পরিবর্তন আনছি। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছর শেষে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বেসরকারি খাতে কমলেও বাড়ানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ৯ শতাংশ ধরা হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছরের শেষে অর্জিত হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, তথা ২১ দশমিক ১ শতাংশ। তবে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার যথাক্রমে ৬ ও ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নরের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃস্থানীয়রা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময়ে মাত্র ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি অনেক কম। যদিও লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় দেশের ঋণ বাজারে পরিপক্বতা এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন গভর্নর ফজলে কবির। মুদ্রানীতির ঘোষণায় তিনি বলেন, নিম্নতর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির জোগানেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মধ্যম আয়ের দেশের ঋণবাজারের সঙ্গে তুলনীয় পরিপক্বতা আসার শুভসূচনার ইঙ্গিত দেয়।

বিগত সময়ে বেসরকারি খাতে উচ্চঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য অতিউৎসাহী কিছু ব্যাংকের প্রশ্নযোগ্য ঋণ সৃষ্টির প্রবণতার কথা বলেছেন গভর্নর। তিনি বলেছেন, কিছু ব্যাংকের অতিউৎসাহী প্রশ্নযোগ্য মানের ঋণ সৃষ্টির প্রবণতা থেকে ঋণবাজারে আকস্মিক তেজিভাব এসেছিল। সে প্রবণতা সংযত হওয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখন দক্ষিণ ও পূর্ব এশীয় অঞ্চলের দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল উদীয়মান বাজার অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে তুলনীয় ধারায় এসেছে।

২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে—১৫ দশমিক ৬৬ ও ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বেসরকারি খাতে উচ্চ এ ঋণ প্রবৃদ্ধিকেই সে সময় প্রবৃদ্ধি সহায়ক বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সেই প্রবৃদ্ধিকেই বলা হচ্ছে কিছু ব্যাংকের অতিউৎসাহী কর্মকাণ্ড। বিষয়গুলো পরস্পর বিরোধী কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী বলেন, আমরা চাইলেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সেটি আমরা করতে চাই না। আমরা চাচ্ছি, গুণগত মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণ হোক। প্রবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। গুণগত মানের ঋণ বিতরণে জোর দেয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর ফলও পাওয়া গেছে। জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট চলছে। এ সংকট দিনদিন আরো গভীর হচ্ছে। চাহিদা না জোগান—কোন সমস্যার কারণে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, চলতি বছরের জুন শেষেও দেশের ব্যাংকিং খাতে ৮৫ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে সব ব্যাংকে আনুপাতিক হারে তারল্য নেই। এক্ষেত্রে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা (মিসম্যাস) রয়েছে। কিছু ব্যাংকের কাছে অনেক বেশি টাকা আছে, কিন্তু ঋণের পরিমাণ কম। আবার কিছু ব্যাংক আছে, যাদের হাতে ঋণের চাহিদা আছে, কিন্তু তারল্য নেই। এ অসামঞ্জস্যতার জন্য আমাদের কলমানি বাজার রয়েছে। কারো নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে কলমানি থেকে টাকা সংগ্রহ করছে। চাপ না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। এক সময় রেপো ওভার নাইট সিস্টেম ছিল। কিন্তু রেপোর মেয়াদ বৃদ্ধি করে আমরা ২৮ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করেছি। তবে রেপোতে ধার নেয়ার জন্যও ব্যাংকগুলোর চাপ নেই।

ডলারের বিনিময় সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, ডলারের বিনিময় হার অত্যন্ত যুক্তিসংগত পর্যায়ে রয়েছে বলেই আমরা মনে করছি। ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময়মূল্য এখন ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় সীমাবদ্ধ আছে। এটিকে আমরা যৌক্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে করছি। চাহিদার ভিত্তিতেই ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে।

পিপলস লিজিংসহ সমস্যাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ কী, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, পিপলস লিজিংসহ আরো কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকেই অসুবিধার মধ্যে ছিল। ২০১৩ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ে সমস্যা চলছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই আমরা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটিকে রক্ষা করা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব হলো আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা। সেটি রক্ষার জন্যই পিপলস লিজিংকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারেস্টিং সিচুয়েশনে আছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, ২০১৮ সালের শুরুতে ফারমার্স ব্যাংককে অবসায়ন না করে আমরা যখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম তখন অনেকেই বলেছে, এটি করা ঠিক হয়নি। এটিকে মরতে দেয়া উচিত ছিল, মরণাপন্ন ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার কী আছে, এ ধরনের বহু কথা আমরা শুনেছি। এবার যখন পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন বলা হচ্ছে কেন আমরা অবসায়ন করছি।

বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালকরা টাকা বের করে নিয়েছেন। তারা আবার বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন। এ ধরনের পরিচালকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা ঋণের নামে টাকা নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ অন্য ব্যাংকের পরিচালক পদে রয়েছেন। চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তবে যারা অন্যায় করেছেন, তাদের ধরার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের অর্থ নিয়মানুযায়ী ফেরত দেয়া হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন জানাতে হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে প্রজ্ঞাপন হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ ছিল। যদিও এখন সে স্থগিতাদেশ রহিত হয়েছে। এরই মধ্যে ৯০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন মেয়াদ গণনা কীভাবে করা হবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। দেশের জিডিপিতে অনানুষ্ঠানিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, এ খাতটি নিয়ে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্ট্যাডি করব।

মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজি হাসান, চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমীসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন