‘নাইকি দারুণ’ ‘আস্ক আ ফুটবলার’ নামের বইয়ে এ কথাটি লিখেছিলেন লিভারপুল মিডফিল্ডার জেমস মিলনার। তার
ভাষায়, ‘তারা (নাইকি) কেবল আপনাকে পরার জন্য বুটই দেয় না। তারা আপনাকে সেভাবে জিনিসটি তৈরি
করে দেয়, যেভাবে আপনি তা আশা করেন। অতীতে আমার পা বেশ কয়েকবার চোটে পড়েছিল। যে
কারণে তারা বুটের তলিতে কার্বন প্লেট লাগিয়ে দিয়েছিল আমার জন্য এবং সেটিকে আরো
মজবুত করে দিয়েছিল। যে পরিবর্তনই আপনি চান না কেন, সেটি হতে পারে অনেক ছোট কিন্তু তারা
সেটি করে দেবে।’
মিলনারের এ কথাগুলো থেকে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক জোড়া বুটের সঙ্গে একজন ফুটবলারের সম্পর্ক কতটা গভীর ও অবিচ্ছেদ্য, সেটিও বুঝে নেয়া যায় এ কথাগুলো থেকে। আর এ বুটকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক গড়ে ওঠে একজন ফুটবলার ও বুট প্রস্তুতকারক কোম্পানির মধ্যে। বিষয়টি এমন না যে, একটি বুট প্রস্তুতকারক কোম্পানি কেবল সেটি তৈরি করে দেয়াকে মহত্ কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মূলত এ বুটকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মাঝে গড়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্কও। অতীতে কেবল অর্থের দিকটিই প্রাধান্য পেত। কিন্তু এখন দিনবদলের সঙ্গে বিষয়টি কেবল অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেছে আরো বহুদূর।
কয়েকদিন আগে আফ্রিকার বর্ষসেরা
খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছে সাদিও মানে। তার এ অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে নতুন এক
জোড়া বুট নিয়ে হাজির হয়েছে স্পন্সর কোম্পানি নিউ ব্যালেন্স। প্যারিস সেন্ট
জার্মেইয়ের (পিএসজি) ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেও বাজারে এনেছে তার সিগনেচার করা নাইকির ‘বন্ডি
ড্রিমস কালেকশন’। এ রকম আরো অনেকভাবে খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বুট প্রস্তুতকারক
কোম্পানিগুলো। এর বাইরে বড় তারকাদের সঙ্গে বুট প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর
অর্থনৈতিক চুক্তি চোখ কপালে তোলার মতো। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে নাইকি
লাইফটাইম চুক্তির মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আবার ধারণা করা হচ্ছে, এডিডাসের
চুক্তিতে লিওনেল মেসি প্রতি বছর পায় ১২ মিলিন ডলার। একইভাবে গত আগস্টে ডেইলি
টেলিগ্রাফ জানায়, এয়ার জর্ডানের সঙ্গে ইংলিশ তারকা রহিম স্টার্লিং চুক্তি সম্পন্ন করেছে
১০০ মিলিয়ন পাউন্ডে।
অবশ্য কেবল চুক্তির অর্থতেই সীমাবদ্ধ
থাকছে না বিষয়টি। এর সঙ্গে যুক্ত আছে পারফরম্যান্স বোনাসও। খেলোয়াড়দের মাঠের
পারফরম্যান্স যত ভালো হবে, তাদের বোনাসের পরিমাণও সেভাবে বাড়তে থাকে। সেটি কেমন তা জানা যাচ্ছে
সাবেক ইংলিশ তারকা পিটার ক্রাউচের
‘হাউ টু বি এ ফুটবলার’ বইয়ে। যেখানে
তিনি বলছেন, ‘বুটের চুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকে আরো বাড়তি কিছু। প্রিমিয়ার লিগে
নির্দিষ্ট কিছু ম্যাচ খেলার ওপর থাকছে বোনাস। এরপর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচ এবং
গোলের ওপরও থাকছে বোনাস।’ তিনি আরো লেখেন,
‘২০০৭ সালে যেবার লিভারপুল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
ফাইনালে গেল এবং ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতি ম্যাচে ভালো খেলেছিলাম। সেবার আমার চুক্তির
মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেল।’
সাম্প্রতিক সময়ে এসে ফুটবলাররা অবশ্য কেবল চুক্তির পরিমাণ কিংবা বাণিজ্যিক দিক থেকেই স্বাক্ষর করছে না। এর সঙ্গে এখন আরো কিছু বিষয় নিশ্চিত করার ব্যাপারে সচেতন তারা। স্পোর্টস মার্কেটিং এজেন্সি বি-এনগেজডের কর্ণধার এহসেন শাহ, যিনি বেশ কয়েকজন বিখ্যাত খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করছেন; তিনি বলেন, ‘অতীতে এখানে অর্থনীতির বিষয়টি মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু এখন তারা (খেলোয়াড়রা) বুটের গুণগত মান দেখছে। তারা দেখছে এ বুট তাদের পারফরম্যান্সের বাড়তি কী যোগ করছে সেটিও। তারা এখানে দেখছে বুটের ওজন, সোল প্লেট, এটি তাদের পায়ের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে এবং তাদের স্টাইলে কী যোগ করছে, সেসবও। আর এসবের পরই কেবল ব্র্যান্ডটি তাদের সামনে কী ধরনের মার্কেটিং সুবিধা নিয়ে আসছে তা বিবেচনা করছে।
এসব চুক্তি অবশ্য পুরোপুরি
জটিলতামুক্তও নয়। যখন একজন খেলোয়াড় একটি বুট প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে
চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে, তখন সেখানে অনেকগুলো বিধিনিষেধ থাকে। অনেক সময় সেগুলো খেলোয়াড়দের জন্য
সমস্যাও তৈরি করে। একজন খেলোয়াড় যখন একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে, তখন
তাদের অন্যান্য পণ্য ব্যবহারের বিষয়টিও সেখানে উল্লেখ থাকে। যেমন স্কিনকেয়ার, হেডফোন
ও সানগ্লাসসহ আরো কিছু পণ্য সেখানে যুক্ত থাকে। পরে অন্য কোনো কোম্পানির সঙ্গে
খেলোয়াড়টি যখন চুক্তিবদ্ধ হতে যায়,
তখন দেখা যায় আগের চুক্তিটি বাধা তৈরি করছে।
অনেক ক্ষেত্রে খেলোয়াড়টি হয়তো এ বিষয়ে পুরোপুরি ধারণাও রাখে না আসলে কী ঘটেছে।
বি-এনগেজড জানাচ্ছে, ইউরোপের
শীর্ষ ছয় লিগের একটিতে খেলা তাদের এক খেলোয়াড় গত বছর এ ধরনের বাধার কারণে প্রধান
একটি ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক কোম্পানির চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। তার যুক্তি
ছিল, এ
বুট পরে সে খেলছে, কিন্তু এটা পরে সে বাইরে যেতে পারে না, অন্য কিছু করতে পারে না।
এর বাইরে আরেকটি বড় সমস্যা হয় যখন
খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত স্পন্সর ও দলের স্পন্সর ভিন্ন। যেমন মেসিকে অবশ্য নাইকির
সামগ্রী পরতে হয়, যখন সে বার্সার হয়ে দায়িত্ব পালন করে। আবার রোনালদো যখনই তার ক্লাব
জুভেন্টাসের প্রতিনিধিত্ব করে,
তখন তাকে পরতে হয় এডিডাসের পণ্য। আবার নেইমার
কিংবা গ্যারেথ বেলকে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না। কারণ তাদের ক্লাব, জাতীয়
দল এবং ব্যক্তিগত স্পন্সর একই। কিন্তু ভিন্ন হলেই সেটি তৈরি করে সমস্যা।
অন্যদিকে একজন খেলোয়াড় যখন ফ্রি এজেন্ট, অর্থাত্ অন্য কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যায়, তখন সবাই একযোগে তার কাছে গিয়ে হাজির হয়। সবাই চেষ্টা করে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে খেলোয়াড়টিকে দলে ভেড়াতে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৭ সালে রোমেলু লুকাকুকে নিয়ে। নাইকির সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়ার পর ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে বুট চুক্তি না করেই কাটিয়েছিল লুকাকু। সে সময় লুকাকু নাইকি ও এডিডাস উভয়ের বুট পরেই খেলেছিল, যা দুই জায়ান্টের মধ্যে লড়াইও জমিয়ে তোলে। যদিও শেষ পর্যন্ত এ দুজনকে নিরাশ করে লুকাকু চুক্তি করেছিল পুমার সঙ্গে। কোম্পানিটির ইতিহাসে যা সবচেয়ে বড় চুক্তিগুলোর একটি।
বেশির ভাগ সময় ক্লাবগুলোর মতো কোম্পানিগুলোও খুঁজতে থাকে তরুণ প্রতিভাগুলোকে। যাদের সঙ্গে অল্প বয়সেই চুক্তি সেরে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক থেকেও কোম্পানিগুলোর লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে। যেমন ম্যানসিটির তরুণ তুর্কি ফিল ফোডেনের সঙ্গে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চুক্তি সম্পন্ন করে নাইকি। একইভাবে রেনে এদোয়ার্দো কামাভিনগা, বায়ার্ন মিউনিখের কানাডিয়ান উইঙ্গার আলফেনসো ডেভিস তাদের স্পন্সর চুক্তি সম্পন্ন করেছে ২০তম জন্মদিনের আগেই। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে সহযোগিতা করে সেসব খেলোয়াড়ের মা-বাবারা।খেলোয়াড়দের সঙ্গে এ চুক্তি নিয়ে কোম্পানিগুলোর দ্বৈরথও বেশ আকর্ষণীয়। তবে সব পক্ষই এ কাজটি করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে। যেখানে একের প্রতি অন্যের সম্মান দেখানোর ব্যাপারও থাকে। দিন শেষে যেটি এসব চুক্তিকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্লেচার রিপোর্ট অবলম্বনে
আরো পড়ুন: