সিল্করুট

বিজেতাদের লক্ষ্য ছিল যে শহর

মাহমুদুর রহমান

সমরখন্দ পতনের কিছুদিন পর তুর্কান খাতুন বন্দি হন মোঙ্গল বাহিনীর হাতে ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

দেয়ালঘেরা শহর। তার চারপাশে শত্রুর আনাগোনা। থেমে থেমে তীর ছুড়ছে তারা। অনেকে পার হওয়ার চেষ্টা করছে উঁচু দেয়াল। তখনো কামান ব্যবহার শুরু হয়নি। কিন্তু ক্যাটাপুল্ট ধরনের ভারী গুলতি দিয়ে ছোড়া হচ্ছে পাথর। শহরবাসী জানে, বেশিদিন টিকবে না প্রতিরোধ। তারা আশা করে, শাসক কোনো সন্ধি করবেন শত্রুদের সঙ্গে। আবার যোদ্ধারা মনে করে তার প্রয়োজন নেই। এভাবেই শঙ্কা চলতে থাকে শহর পতন পর্যন্ত। সমরখন্দ বহুবার গেছে এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের ওপর নজর থাকে বিজেতাদের। বারবার আক্রান্ত হয় সেসব। বিজেতারা কখনো জয় করেন, কখনো ধ্বংসযজ্ঞ চালান। আবার কখনো শহর গড়েও থাকেন। মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ এমনই একটি শহর। সুপ্রাচীনকাল থেকে এ শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝড়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট থেকে সোভিয়েত রাশিয়া পর্যন্ত থাবা বিস্তার করেছে সমরখন্দের ওপর। মধ্য এশিয়ার এ শহর সংযুক্ত করেছিল পূর্ব ও পশ্চিমকে। সে কারণে সমরখন্দ হয়ে উঠেছিল বাণিজ্য, সংস্কৃতি, সম্পদে পরিপূর্ণ। এমন একটি অংশের ওপর বিজেতাদের নজর বরাবরই থাকে।

শুরুটা হয়েছিল আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের হাত ধরে। আনুমানিক ৩২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সমরখন্দ আক্রমণ করেন। আলেকজান্ডার কেবল বিজেতা বা লুটেরা ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল নগর তৈরি করা, সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি। কিন্তু সমরখন্দ দখল করার সময় তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন। আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর কথা সবারই জানা। প্রতিরোধের মুখে তারাও আক্রমণ করেছিল শক্তি দিয়ে। ফলে এ সময় শহরটির বেশ ক্ষতি হয়। তবে দ্রুতই ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছিল মারাকান্দ। হেলেনিস্টিক (গ্রিক) শাসনের সময় শহরটির এ নামই দেয়া হয়েছিল। বছরের মধ্যেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পরও সমরখন্দের ভাগ্য খারাপ ছিল। এর মধ্যেই আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় শহরের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে এবং শহরে বিশৃঙ্খলার মধ্যে বহু সম্পদ নষ্ট ও প্রাণহানি হয়েছিল। এ সময়ের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায় না।

এরপর সমরখন্দ বেশ কয়েকটি গোত্র ও শক্তির হাতে শাসিত হয়েছে। এর মধ্যে ছিল সাসানীয়রা। তবে এ সময় তুলনামূলক শান্ত ছিল সমরখন্দ ও তার পরিপার্শ্ব। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে সমরখন্দ ফের আক্রমণের মুখে পড়ে। আক্রমণ হয়েছিল শহরটি দখলের জন্য। মূলত ৩৫০-৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঝায়োনাইটরা সমরখন্দ দখলের চেষ্টায় রত ছিল। এরা ট্রান্স-অক্সানিয়া ও ব্যাক্ট্রিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী। সমরখন্দ এ সময় সম্পদশালী শহর হওয়ার কারণে ঝায়োনাইটরা বারবার আক্রমণ করেছে শহরটিকে। তাদের লক্ষ্য ছিল সমরখন্দ দখল। সমরখন্দের বাসিন্দারা এদের বাধা দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। পুরো ঘটনাটি ছিল আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের। এ সময় সির দয়িরা পর্যন্ত যাযাবরদের শক্তি ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

পঞ্চম শতাব্দীতে সমরখন্দ ছিল হেফথালাইটদের অধীন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে তাদের বিরুদ্ধে একত্র হয় সাসানীয় ও তুর্কিরা। এদের লক্ষ্য কেবল সমরখন্দ ছিল না। মূলত সাসানীয় ও তুর্কিরা বড় একটি অংশ দখল করতে চেয়েছিল। সমরখন্দ ও এর আশপাশের অংশ শাসন করা হেফথালাইটরা দুর্ধর্ষ হওয়ার পাশাপাশি তাদের ছিল বড় সেনাদল। কিন্তু যাযাবরি স্বভাব তাদের তখনো যায়নি। এ কারণে সাসানীয় ও তুর্কি আক্রমণ সামলাতে পারেনি। সাসানীয় ও তুর্কিরা এ সময় সমরখন্দকে আক্রমণ করেছিল দুদিক থেকে। ৫৬০ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘‌বুখারার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। দ্বিমুখী এ আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় সমরখন্দসহ হেফথালাইটদের অধিকৃত ভূমি। এ যুদ্ধে সমরকন্দের পাশাপাশি পতন হয় হেফথালাইটদের। এরপর সমরখন্দে স্থাপিত হয় প্রথম তুর্কি খানাত। 

সমরখন্দের পরবর্তী ইতিহাস বেশ জটিল। মধ্য এশিয়া, চীনসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলের সঙ্গে এর সংযুক্তি তৈরি হয়। ফলে সেখানে ছিল নানা ধর্মের মানুষ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই তাই সমরখন্দের দিকে নজর পড়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের। উমাইয়া খেলাফতের পতাকা নিয়ে সমরখন্দ আক্রমণ করেন কুতাইবা ইবনে মুসলিম। ৭১০ খ্রিস্টাব্দে তার সেনাবাহিনী সমরখন্দ জয় করে। লেখার শুরুতে যেমন বলা হয়েছে, ‘‌সমরখন্দের ওপর দৃষ্টি ছিল বিজেতাদের’ তার প্রমাণ এখানে পাওয়া যাবে। মধ্য এশিয়ার আরো কিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন কুতাইবা, কিন্তু কোথাও সরাসরি শাসন করেননি। উমাইয়া খেলাফতের অধীনে তিনি সমরখন্দের শাসকদের কাছ থেকে কেবল উচ্চপরিমাণে কর সংগ্রহ করেছেন। পাশাপাশি সমরখন্দকে তিনি সরাসরি আরব শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন এবং সেখানে একটি বড় সেনাবাহিনীও মোতায়েন রেখেছিলেন। জুলিয়াস ওয়েলহওসেন তার ‘‌দি আরব কিংডম অ্যান্ড ইটস ফল’ বইয়ে লিখেছেন, আরবরা বিজয় পাওয়ার পর সমরখন্দের জরথুস্ত্রীয় উপাসনালয়টি ধ্বংস করে দেয় এবং সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এরপর আবার দীর্ঘদিন তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি সমরখন্দে। তবে হাতবদল হয়েছে শহরের শাসন। উমাইয়া খেলাফতের পর মুসলিম জাহানে আব্বাসীয় খেলাফত আসে। সমরখন্দ এর আগে থেকেই ইসলামী শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান হয়ে উঠছিল। এর মধ্যে আব্বাসীয় খেলাফতের সময় সমরখন্দ দখল করে সামানীয়রা। এরা যদিও খেলাফত বা খলিফার অধীনেই সামন্তরাজ্য ছিল, তবু সমরখন্দকে তারা নিয়েছিল নিজেদের অধীনে। সমরখন্দকে করেছিল নিজেদের রাজধানী। 

দশম শতাব্দীর শেষপাদে কারখানিরা সমরখন্দ দখল করে নেয় সামানিদের কাছ থেকে। এরপর ২০০ বছর সমরখন্দ তুর্কিদের অধীনে চলে যায়, কিন্তু সেখানেও ছিল ছোটখাটো নানা যুদ্ধ ও অভিযান। তবে সেলজুক ও খোরেজমশাহদের অধীনে সমরখন্দ ছিল তুলনামূলক শান্ত এবং এ সময় শহরের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। তবে শান্তি তো সমরখন্দের কপালে ছিল না। সে শান্তি বিঘ্নিত হয় ১২২০ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান সমরখন্দ আক্রমণ করলে। ইতিহাসে এবারই সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় শহরটি।

চেঙ্গিস ছিলেন একজন বিজেতা। শাসনে তার ততটাও মন ছিল না। শহর ও সাম্রাজ্য দখল ছিল তার ‘‌অ্যাচিভমেন্ট’ বাড়ানোর প্রকল্প। মোঙ্গলদের সময়ে মধ্য এশিয়ায় শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল খোরেজম। স্বভাবতই তিনি তাই এ অঞ্চলকেই নিজের লক্ষ্য বানালেন। মুহম্মদ শাহ তখন খোরেজমশাহ। তার রাজধানী ছিল সমরখন্দ। চেঙ্গিস প্রথম আক্রমণ করেছিলেন সীমান্তে। তার দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী যেন ছিল অপ্রতিরোধ্য। আর বুখারা দখলের পর সমরখন্দ দখল করা ছিল সময়ের ব্যাপার। সমরখন্দ দখলের আগে প্রথমেই চেঙ্গিসের সেনাদল শহরটিকে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলে। তাদের বিরুদ্ধে এগিয়েছিল তুর্কি-ইরানি যৌথ বাহিনী। এ দলে ছিল ২০টি হাতি ও বিশাল এক সেনাদল। কিন্তু চেঙ্গিসের বাহিনী অল্প সময়েই এ আক্রমণ ঠেকিয়ে প্রতি আক্রমণ করে। সমরখন্দের বাহিনীর একটি বড় অংশ অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করে। এরা প্রাণভিক্ষা চাইলেও চেঙ্গিস তা দেননি। সবাইকে হত্যা করা হয়। ঘটনাবলি লেখকদের (ক্রনিকলার) মধ্যে অনেকেই বলেন, চেঙ্গিসের আক্রমণে সমরখন্দের প্রায় এক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। সংখ্যায় এত না হলেও অন্তত এর অর্ধেক মানুষ মরেছিল। কেননা বুখারার মসজিদে আশ্রয় নেয়া মানুষদের জ্বলন্ত তীর ও ক্যাটাপুল্টে তেলের শিশি ছুড়ে পুড়িয়ে মেরেছিল চেঙ্গিসের বাহিনী। সমরখন্দের যে প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কেননা ১৫০ বছর পর তৈমুরের হাতে সংস্কার হয় সমরখন্দের। মূলত চেঙ্গিস কেবল শহর ধ্বংসই করেননি, শহরের সেরা শিল্পী, কামার, কুমোর থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন মঙ্গোলিয়ায়। 

তৈমুরের হাতে সেজেছিল সমরখন্দ। চাগতাই মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে এক রকম বিদ্রোহ করে তিনি এ শহরকে নিজের কবজায় নিয়েছিলেন এবং এরপর সাজিয়েছিলেন নিজের মতো করে। কিন্তু তৈমুরের পর তার উত্তরাধিকার তৈরি না হওয়ায় এ শহর আবার ঘুরেছে একাধিক শাসক ও পরিবারের হাতে। সে সময় সমরখন্দ বারবার দখলে নিয়েছেন তৈমুরেরই জ্ঞাতিরা। এদের মধ্যে বাবর অন্যতম।

ফারগানার শাসক বাবর তৈমুরের উত্তরপুরুষ। সমরখন্দকে নিজের শাসনে নেয়ার ইচ্ছা তার ছিল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি সমরখন্দ দখলের চেষ্ট করেন। সে সময় তারই জ্ঞাতি বাইসানগান মির্জা ছিলেন সমরখন্দের শাসক। বাবর সমরখন্দের কাছাকাছি একটি গ্রামে অবস্থান নেন এবং সেখান থেকে খণ্ডযুদ্ধ চালাতে থাকেন। সমরখন্দ নিয়ে বাবর এতটাই ঘোরগ্রস্ত ছিলেন যে তিনি শহরের বাইরে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে সেখানে সেনাবাহিনী নিয়ে অবস্থান করেছেন মাসের পর মাস। এদিকে বাইসানগার অপেক্ষায় ছিলেন উজবেক সেনাদলের। তাদের আসতে দেরি বা আসার সম্ভাবনা না দেখায় শহর ছেড়ে যান বাইসানগার এবং কোনো রকম বাধা ছাড়াই বাবর সে শহর দখল করেন। কিন্তু ১০০ দিনের মাথায় বাবরকেও ছেড়ে যেতে হয় সমরখন্দ।

বাবর সমরখন্দ ছেড়ে ফারগানার উদ্দেশে গেলে সে সময় সমরখন্দ তার হাতছাড়া হয়। তিন বছর তিনি মধ্য এশিয়ায় ঘোরেন এবং এ সময় উজবেক নেতা শায়বানি খান ক্ষমতা বাড়াতে শুরু করেন। বাবরের ইচ্ছা ছিল সমরখন্দ ফের দখল করবেন। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ফের সমরখন্দ বাবরের হাতে আসে, কিন্তু সে সময় উজবেক নেতা শায়বানি তার ভারী বহর নিয়ে সমকন্দের ওপর চড়াও হন। বাবরকে ছাড়তে হয় সমরখন্দ। হারাতে হয় বোন খানজাদা বেগমকে। বাবর এর পরও সমরখন্দ ফিরে পাওয়ার বহু চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে শায়বানি হয়েছে আরো শক্তিশালী। এ তুর্কি-উজবেক সংঘাতে সমরখন্দকে চোকাতে হয়েছে মূল্য। শহর ছিন্নভিন্ন করেছিলেন শায়বানি।

সমরখন্দ উজবেকদের অধীনে ছিল অনেকদিন। এরপর বুখারার আমির শাসন করেছেন শহরটিকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শহরটি সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার হাতে আসে। ১৮৬৮ সালে শহরের সিটাডেলটি দখল করে নেন কর্নেল কনস্ট্যানটিন পেত্রোভিচ ভন কফম্যান। অবশ্য এরপর রুশ বাহিনীর ৫০০ সৈন্যকে হেনস্তা করেন আবদুল মালিক তুরা। তিনি ছিলেন বুখারার আমিরের পুত্র। তবে তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। রাশিয়ান তুর্কিস্তানের অংশ হয়ে ওঠে সমরখন্দ। ১৯২৫-৩০ পর্যন্ত শহরটি ছিল উজবেক সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের রাজধানী। এরপর সে গৌরব পায় তাসখন্দ।

মাহমুদুর রহমান: লেখক