বাঘটির চার থাবায় চারটি হাতি। মুখে ও লেজে আরো একটি করে। যেন বার্তা দিচ্ছে, তুমি যতই শক্তিধর হও না কেন, তোমার মোকাবেলায় আমি একাই যথেষ্ট। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের কোনকান উপকূল (ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের একটি প্রশাসনিক বিভাগ কোনকান) থেকে খানিক দূরে অবস্থিত ডিম্বাকৃতির একটি দ্বীপ। ‘মুরুদ-জানজিরা’ তার নাম। সে দ্বীপে অবস্থিত দুর্গটির নাম ‘জানজিরা মেহরুব’। বাংলা করলে দাঁড়ায়—চন্দ্রদ্বীপ। কালো পাথরের সমানাকৃতির ব্লক দিয়ে তৈরি। দুর্গের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে ডান পাশের দেয়ালে দেখা যাবে বাঘের ভাস্কর্যটি। বাঘটি যেন এখানকার শাসকদের শক্তিমত্তা ও সাহসিকতার প্রতীক। যার মাধ্যমে তারা ঠেকিয়ে রেখেছিল পরাক্রমশালী মারাঠাদের। মোগলদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সুসম্পর্ক। ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা লাভ করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সমুন্নত ছিল তাদের পতাকা। লাল জমিনে একেবারে ডান পাশে নিচে সাদা অর্ধচন্দ্র। তার মাঝখানে একটি তারকা। পশ্চিমে আরব সাগর। পূর্বে পর্বতশ্রেণী। সাগর ও পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত দ্বীপ মুরুদ-জানজিরা। স্থানীয় কোনকানি ভাষায় মুরুদ শব্দের অর্থ দ্বীপ। আরবি জানজিরা শব্দের অর্থও দ্বীপ। মহারাষ্ট্রের কোনকানে অবস্থিত জানজিরা রাজ্যের রাজধানী মুরুদ-জানজিরা। এখানে বাস করতেন জানজিরার শাসকরা। তারা পরিচিত ছিলেন সিদি নামে। আর তাদের সাম্রাজ্যকে বলা হতো সিদি সাম্রাজ্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কোনকান উপকূলের সঙ্গে মিসরীয়, ফিনিশীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সময় থেকে এ অঞ্চল মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলিম শাসনের পূর্ব পর্যন্ত আরো কয়েকটি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল এ অঞ্চল। এর মধ্যে নন্দ, মৌর্য, কলচুরি, চালুক্য, রাষ্ট্রকুট ইত্যাদি সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ দেবগিরির যাদবরা এ অঞ্চল শাসন করেন। ১২৯৬ সালে কোনকান দিল্লি সালতানাতের অধীনে আসে। ১৩৪৭ সালে আলাউদ্দিন বাহমান শাহ এ অঞ্চলের শাসক হন। তিনি তুঘলক সাম্রাজ্যের একজন সেনাপতি ছিলেন। দাক্ষিণাত্যে তিনি বাহমানি সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এ সাম্রাজ্যের অধীন জুন্নার শহরের প্রশাসক মালিক আহমেদ (১৪৮০-১৫০৯) বাহমানি সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এটি আহমেদনগর সালতানাত নামে পরিচিত। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি মালিক আহমেদ নিজাম শাহ নাম ধারণ করেন। এ কারণে তা নিজামশাহি সাম্রাজ্য নামেও পরিচিত। সাম্রাজ্য স্থিতিশীল রাখতে স্থানীয় জনগণ ও বিদেশী আগন্তুকদের সহায়তা নিতেন দাক্ষিণাত্যের শাসকরা। বিদেশীরা ছিল মূলত ইরান ও আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসী। এদের মধ্যে আবিসিনীয় (বর্তমান ইথিওপিয়া) জনগণের সংখ্যা ছিল বেশি। আফ্রিকার এ মুসলমানরা দক্ষ নাবিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নৌযুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী, অভিজাত ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দাক্ষিণাত্যে এসেছিলেন। আহমেদনগরের শাসকের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়। আবিসিনিয়ার অভিজাত লোকদের জানজিরা রাজ্যের শাসনক্ষমতা প্রদান করেন আহমেদনগরের নিজাম। প্রথম শাসক ছিলেন সিদি বুরহান খান। তার উত্তরসূরি হিসেবে পিরাম খানের (শাসনকাল ১৫২৬-১৫৩২) নাম পাওয়া যায়। বুরহান খান জানজিরা মেহরুব দুর্গের কাজ শুরু করেছিলেন। ১৫৭১ সালে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ভারতের পশ্চিম উপকূলে আফ্রিকার মানুষেরা নিজেদের ‘সিদি’ নামে পরিচিত করেছিলেন। এটি একটি সম্মানসূচক উপাধি (সম্ভবত আরবি ‘সৈয়দ’ কিংবা ‘সৈয়দি’ শব্দের অপভ্রংশ সিদি। অর্থ সম্ভ্রান্ত, নেতা, প্রধান ইত্যাদি)। তবে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে তারা ‘হাবশি’ হিসেবে পরিচিত। ষোড়শ শতাব্দী থেকে জানজিরার শাসক হিসেবে সিদিদের যাত্রা হয়। সিদি শাসকরা বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী মুরুদ-জানজিরায় জানজিরা মেহরুব দুর্গ নির্মাণ করেন। সুপরিকল্পিতভাবে দুর্গটি নির্মাণ হয়েছিল। দুর্গের প্রবেশপথ এমনভাবে নির্মাণ করা যে বাইরে থেকে তা কোনোভাবেই দেখা যেত না। ২০০ মিটারের ভেতর আসার পরেই কেবল দৃশ্যমান হতো পূর্বমুখী এ তোরণদ্বার। এর উভয় পাশে দুটি কেল্লা। দুর্গে প্রবেশ করে কিছু দূর গেলে একটি প্রাসাদ দেখা যায়। এটি ‘সুরুল খান ওয়াদা’ (সিদি সুরুল খানের প্রাসাদ) নামে পরিচিত। এটি ছিল সাততলা একটি ভবন। কালের করালাঘাতে এর মাত্র অর্ধেক অংশ (সাড়ে তিন তলা) বর্তমানে অবশিষ্ট আছে। এ প্রাসাদের দুই পাশে দুটি জলাশয়। দক্ষিণের জলাশয়টির পাশে জামে মসজিদ অবস্থিত। সুরুল খানের প্রাসাদের পেছনে একটি কেল্লা। এর নাম ‘বালে কেল্লা’। দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু এ কেল্লা ছিল সিদি খায়রিয়াত খানের প্রাসাদ। এর চূড়ায় উড়ত সিদিদের পতাকা। বর্তমানে এর দেয়ালগুলোই কেবল দাঁড়িয়ে আছে। ছাদ ধসে গেছে। জানজিরা মেহরুব দুর্গের ভেতরের প্রাসাদগুলোর সীমানাপ্রাচীর নীলচে গ্রানাইট পাথরের তৈরি। দুর্গের সীমানা প্রাচীরসংলগ্ন মোট ২২টি কেল্লা। ভেতরে আরো দুটি। দুর্গের দেয়ালের উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট, পুরুত্ব ১২ ফুট। কিছু স্থানে ১৫ ফুট। দুর্গের দেয়ালের পশ্চিম দিকে গোপন একটি দরজা ছিল। বের হয়ে সোজা আরব সাগর। এ কারণে এটিকে ‘দরিয়া দরওয়াজা’ বলা হতো। দুর্গের সুরক্ষা প্রাচীর ছিল আড়াই ফুট পুরু। এটি ছিল খাঁজকাটা। প্রাচীরের পেছনে নিরাপদে থেকে এসব খাঁজের ভেতর দিয়ে সহজেই তীর কিংবা গুলি ছোড়া যেত। কিছু জায়গায় কামানের গোলা ছোড়ার উপযোগী গর্তও ছিল। দুর্গের দেয়াল ও কেল্লাগুলো ছিল তিনতলা। অপেক্ষাকৃত শীতল নিচতলায় গোলাবারুদ মজুদ করা হতো। মাঝের তলায় ছিল ‘ওয়াচ টাওয়ার’। উপরের তলা কামান রাখার জন্য বরাদ্দ ছিল। সিদি সেনাবাহিনীর প্রায় ৬০০টি কামান ছিল। বর্তমানে ৭৫টি অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে ‘কালাল বাঙ্গাদি’, ‘চাওয়াড়ি’ ও ‘লান্ডা কাসাম/কাসাব’ নামের তিনটি কামান পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। সিদিদের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধজাহাজ ছিল তাদের। গেরিলা যুদ্ধকৌশলে তারা পারদর্শী ছিলেন। এসব কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকরা সিদি সৈনিকদের ভাড়া করতেন। মোগলদের সঙ্গে সিদিদের সুসম্পর্ক ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় সে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়। সিদিদের আচরণ ও হাস্যরসে সম্রাট সন্তুষ্ট ছিলেন। ১৬৭৬ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব সিদি শাসকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তাদের উপহার হিসেবে সৈন্য, গোলাবারুদ এবং কয়েকটি রণতরী উপহার দেন। ১৬৭৭ সালে সিদি কাসিম এবং সিদি সম্বলের নেতৃত্বে যুদ্ধজাহাজগুলো জানজিরায় এসে পৌঁছে। সর্ববৃহৎ জাহাজটির নাম ছিল ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’। সিদিদের নৌবহরের তত্ত্বাবধানের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব বার্ষিক ৪ লাখ রুপি মঞ্জুর করেন। সে সময় জানজিরার শাসক ছিলেন নবাব সিদি কাসিম ইয়াকুত খান। জানজিরার সিদিদের সঙ্গে মারাঠাদের সবসময় একটি বৈরী সম্পর্ক ছিল। মারাঠা মহারাজ ছত্রপতি শিবাজীর ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সিদিরা ছিল বড় বাধা। তাই সিদিদের সঙ্গে মারাঠাদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। ১৭৩৩ সালের ২৬ মে মারাঠা প্রধানমন্ত্রী বাজিরাওয়ের লেখা এক চিঠিতে সিদি-বর্গী সংঘর্ষের এক চিত্র ফুটে উঠেছে। মহারাষ্ট্রের সাসওয়াদ শহরের (পুনে জেলায় অবস্থিত) তৎকালীন প্রশাসক সরদার আমবাজি পুরন্দরের উদ্দেশে লেখা সে চিঠির বক্তব্য ছিল এমন—‘বহুবার চেষ্টা করেও সিদিকে পরাজিত করা যায়নি। তাকে উত্খাত করতে ব্যাপক প্রয়াস চালাতে হবে। অন্তত ১৫ হাজার দক্ষ সৈনিক দরকার। আগে তার কেবল একটি দুর্গ ছিল। বর্তমানে উনদেরি ও আনজানভেলও তার করায়ত্ত হয়েছে। আমার মতে, প্রতিনিধি ও সরখেল যেন যথাক্রমে আনজানভেল ও উনদেরি দখল করে।’ ১৭৩৬ সালে মারাঠাদের সঙ্গে এক যুদ্ধে সিদিরা পরাজয় বরণ করে। মারাঠা সেনাপতি শিমাজি আপ্পা এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষে একটি শান্তি চুক্তি স্থাপিত হয়। চুক্তি অনুসারে দ্বৈত সরকার ব্যবস্থা স্থাপিত হয়। সিদি সাম্রাজ্যের মোট ১১টি মহল দুইপক্ষে সমান ভাগ হয়ে যায়। সিদি শাসনামলে জানজিরা মোট চারটি ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়। পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ ও ফরাসি। পর্তুগিজদের সঙ্গে সিদিদের বেশ মিত্রতা ছিল। প্রয়োজনে তারা সিদিদের লোকবল, অর্থ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করত। ডাচদের সঙ্গে সিদিদের সম্পর্ক ছিল বিপরীত। তারা মারাঠাদের মিত্র ছিল। তবে ছত্রপতি শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠাদের উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধির কারণে ইংরেজরা শঙ্কিত ছিল। তাই তারা সিদিদের পক্ষ নিয়েছিল। একই কারণে (ইংরেজদের টেক্কা দিতে) ফরাসিরা মারাঠাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছিল। এ সময় থেকে সিদি সাম্রাজ্যে অরাজকতা বেড়ে যায়। শিমাজি আপ্পার কাছে পরাজয় তাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ধসে পড়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ। সব মিলিয়ে জানজিরা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনমন ঘটেছিল। অবশেষে ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার জানজিরার সার্বিক উন্নয়নে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে জানজিরাকে বোম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়। সে সময় জানজিরার শাসক ছিলেন নবাব সিদি দ্বিতীয় মুহাম্মদ খান (১৮২৬-১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। নবাব সিদি ইবরাহিম খান (১৮৭৯-১৯২২) ব্রিটিশদের পক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে গান স্যালুট দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জানজিরা ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে তা মহারাষ্ট্র রাজ্যের কোনকান বিভাগের রায়গড় জেলার একটি শহর।
নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক