সিল্করুট

ভারতবর্ষে সিদি-হাবশিদের আগমন

আহমেদ দীন রুমি


সবদিক থেকেই স্বতন্ত্র বদর। যেমন সাহস, তেমন বীরত্ব। বেশ লম্বা ও গোলগাল শরীর। এক বসায় একটা খাসি সাবাড় করে দিতে পারে। তারপর খেয়ে নিতে পারে আধা সের ঘি। জীবনযাপনে মেনে চলে আবিসিনিয়ার সংস্কৃতি। ইবনে বতুতা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে মরক্কোয় ফিরে স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন সে মুগ্ধতা। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ভারতে ছিলেন ১৩৩৩ থেকে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ফলে তার আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বীর বদরের ভোজনপ্রীতির জন্য না। ভারতবর্ষে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও বিবর্তনের দলিল হিসেবে। 

ভারতবর্ষে প্রবেশের বহু রাস্তা রয়েছে। কিন্তু বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। দক্ষিণ ভারতের জন্য কথাটা আরো বেশি করে সত্য। বৈচিত্র্যে অনন্য ভারত। বিচিত্র সেখানকার সমাজ ও জনগণ। সময়ের বিবর্তনে বসতি গড়ে তুলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ। সে তালিকায় সামনের দিকেই থাকবে আফ্রিকার নাম। বস্তুত সমুদ্রপথে আফ্রিকা ভারতের সঙ্গে যুক্ত বহু বছর আগে থেকে। মহাভারত, রামায়ণ ও বৌদ্ধধর্মের পালি কিতাবেও দূরদেশের সঙ্গে নৌ যোগাযোগের কথা বলা আছে। গ্রিক ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ উদ্ধৃত করেছেন। তার বর্ণিত সারাওস্টাস নগরীই বর্তমান সৌরাষ্ট্র। 

মুসলমানদের উত্থানে যোগাযোগের পরিসর বিস্তৃত হয়। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত এডেন বন্দরকে ইবনে বতুতা আখ্যায়িত করেছেন ‘ভারতীয়দের বন্দর’ হিসেবে। সেখানে যেমন ভারতীয়রা গেছে, একইভাবে তারাও এসেছে ভারতে। তবে সবাই নাবিক হয়ে আসেনি। কেউ যোদ্ধা হিসেবে এসেছে, কেউ এসেছে রাজার সেবক কিংবা দাস হয়ে। ভারতীয় শাসকরা সামরিক বাহিনী ও প্রাসাদরক্ষীর দায়িত্ব সিদিদের হাতে তুলে দিতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। শক্তির পাশাপাশি বিশ্বস্ততার খ্যাতি ছিল তাদের। পঞ্চদশ শতকে সমুদ্র বিজয়ে বের হয় ইউরোপ। আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে ভারতে নোঙর করে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজরা। দাস ব্যবসা তখন জনপ্রিয়। সে সময়ে ভারত থেকে ইউরোপে দাস সরবরাহ করা হয়েছে যেমন, তেমনি এখানেও প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকানদের উপস্থিতি। ক্রমে দাক্ষিণাত্য, বাংলা, গুজরাট, খণ্ডেশ, জৈনপুর, মালওয়া, গোয়া, দিও ও দামানে ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকান। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে গড়ে ওঠে বসতি। মিশে যায় এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এ জনগোষ্ঠী পরিচিত হয়েছে সিদি বা হাবশি নামে। আধুনিক ইথিওপিয়া আরবি ও ফারসি অভিধানে হাবশা হিসেবে চিহ্নিত। সেখানকার মানুষকে বলা হয় হাবশি। ‘সিদি’ শব্দটা আবার আরবি ‘সায়িদ’ থেকে উদ্ভূত। আরব জাহাজের কাপ্তানকে ‘সায়িদ’ বলা হতো। অধিকাংশ সিদির শিকড় ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও নীল অঞ্চলের বান্টু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত। আরব লেখকরা তাদের অভিহিত করতেন ‘জানজি’ বলে। চীনা লেখায় অবশ্য উচ্চারণ ঈষৎ পরিবর্তিত হয়েছে ‘জিনজি’ হিসেবে। দুটি শব্দই দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জ উপকূল ও জাঞ্জিবার দ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কিত। ওই অঞ্চল থেকে আগত জনগোষ্ঠীই সিদি বা হাবশি। বিশেষভাবে তাদের গায়ের কালো রঙ, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, মোটা ঠোঁট ও চ্যাপ্টা নাকের জন্য আলাদা করে চেনা যায়। কঠোর পরিশ্রম, সাহস আর আনুগত্যের জন্য গুরুত্ব ছড়িয়ে ছিল ইতিহাসজুড়েই। 

গুজরাটে সিদিদের সরব উপস্থিতি দ্বাদশ শতক থেকেই। সৌরাষ্ট্রের কেউ কেউ অবশ্য নিজেদের সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতে আসা সৈনিকদের বংশধর বলে দাবি করে। সোমনাথ মন্দির বিজয়ের পর কিছু সৈনিক নাকি সৌরাষ্ট্র ও কোচিতে থেকে গিয়েছিল। গড়ে তুলেছিল স্থায়ী নিবাস। ১২৯৯ সালে দিল্লি অধিপতি আলাউদ্দিন খিলজি রাজপুত শাসক কর্ণ ভাঘেলাকে পরাজিত করেন। অধিকার করে নেন গুজরাট। তার সামরিক অভিযানে যোগ দিয়েছিল সিদি সৈন্য। পরবর্তী সময়ে তারা কোচিতে থিতু হয়। পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের খাতিরে সিদিদের ভারতে আনতে ইসমাইলি ও ভাটিয়া বণিকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সেই সময়। সিদিদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘ভারত মহাসাগরে নৌপথে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হাবশি। তাদের কোনো একজনকে জাহাজে রেখেই ভারতীয় জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া যায়।’ এ থেকে সে সময় নৌযাত্রায় সিদিদের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ক্রমে এসব সিদিই সরব হয় স্থানীয় রাজনীতিতে। জামনগর প্রাসাদ, কোচের আয়নামহল ও ভাবনগরের প্রাসাদের চিত্রকর্মে সিদি উপস্থিতি তার প্রমাণ। তাদের তত্পরতা দৃশ্যমান হয় পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে। সুলতান মাহমুদ শাহ (১৪৫৯-১৫১১) যখন পাটান অভিযান পরিচালনা করেন, তার সামরিক বাহিনীর বড় অংশই ছিল সিদি সৈন্য। সুলতান বাহাদুর শাহের (১৫২৬-৩৭) আমলে আহমেদাবাদে পাঁচ হাজার সৈন্য ছিলেন সিদি। তাদের নেতৃত্ব দিত নিজস্ব কমান্ডার। সাইফুল মুলুক মিফতাহ নামের জনৈক সিদিকে নিযুক্ত করা হয় দুর্গরক্ষক। তার অধীনে থাকত চার হাজার আফ্রিকান সৈন্য। নগর প্রতিরক্ষার জন্য সিদিরা ছিল শাসকদের আস্থাভাজন। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের সীমান্তে অবস্থিত তখনকার খণ্ডেশ। সেখানে সিদিদের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করা যায় সামরিক কমান্ডার বিলাল জুজার খানের নাম। দাক্ষিণাত্যে বাহামনি শাসনামলে সিদিদের রাজনৈতিক উত্থান ও সফলতা ছিল ঈর্ষণীয়। নাবিক ও ব্যবসায়ীর পেশাকে ছাপিয়ে সামরিক নেতা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখাতে থাকে তারা। পরবর্তী সময়ে বাহামনি সাম্রাজ্যের ভাঙনে জন্ম নেয়া বিজাপুর, বিদার, বেরার, গোলকোন্ডা ও আহমেদনগর সালতানাত। প্রতিটিতেই সিদিদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। 

ষোড়শ শতকে ভারতে প্রবেশ করে পর্তুগিজ। অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গোয়া, দিও ও দামানে। দক্ষিণ সুরাটের দামানে পর্তুগিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে সেখানে সিদি নিয়ন্ত্রণ ছিল। পর্তুগিজদের মাধ্যমে পূর্ব আফ্রিকা থেকে বিপুলসংখ্যক নাগরিক দাস হিসেবে জীবন শুরু করে এখানে। গোয়ার ইতিহাস একই রকম। পরবর্তী সময়ে জনগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃবর্ণীয় বিয়ের কারণে বংশধরদের রক্তে সিদি, ভারতীয় ও পর্তুগিজ বৈশিষ্ট্য একাকার হয়ে গেছে। সালসেত্তে খ্রিস্টান, কোনকান মুসলিম, ঠাকুর ও তালহেরি কুনবিদের ধমনিতে সিদি বৈশিষ্ট্য এখনো প্রবহমান। পর্তুগিজ আধিপত্যের জের ধরেই কর্ণাটকে প্রসারিত হয়েছে খ্রিস্টধর্ম। দিল্লিতে সিদি উপস্থিতির প্রথম দিকের প্রমাণ সুলতানা রাজিয়ার (১২৩৬-১২৪০) সময়ে। সুলতানা জনৈক সিদি জামাল উদ দীন ইয়াকুতকে আস্তাবলপ্রধান নিযুক্ত করেন। তার সঙ্গে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। একজন সিদির এমন রাজনৈতিক উত্থান থেকে ওই অঞ্চলে গোটা সিদি জনগোষ্ঠীর সমাজ-অর্থনীতির অতীত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সিদি আধিপত্য থেকে মুক্ত ছিল না বাংলাও। ঐতিহাসিক ফারিশতার মতে, রুকনুদ্দিন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) আফ্রিকান দাসদের উচ্চ পদে আসীন করেন। তার সেনাবাহিনীতে ছিল আট হাজার সিদি সৈন্য। অন্যদিকে মুজাফফর শাহের (১৪৯১-১৪৯৩) যুগে সেনাবাহিনীতে পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল সিদি। পরবর্তী সময়ে তাদের সংখ্যা ও প্রভাব দুই-ই বৃদ্ধি পায়। বোম্বের মতো কলকাতায়ও দীর্ঘদিন দাস প্রথা চলেছে। সেদিক থেকেও বিস্তৃত হয়েছে তাদের সমাজ।

বর্তমান পাকিস্তার রাষ্ট্রের ভূমিতে সিদি ইতিহাস আরো পুরনো ও ভিন্ন। ৭১০ সালে মুহম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে সিন্ধ ও পাঞ্জাব অভিযানে এসেছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিদি সৈন্য। তারা আর ফিরে যায়নি। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাকরানের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। তারা সিদিয়ানি ও গাদ্দো নামেও অভিহিত হয়। করাচির অন্তত তিনটি বিশেষ স্থানে গড়ে উঠেছে সিদি বসতি। উত্তর-পশ্চিমের তান্দো বাগোতেও তাদের বিস্তৃত আবাসভূমি। আফ্রিকান সংস্কৃতির পাশাপাশি তারা গ্রহণ করেছে স্থানীয় সংস্কৃতিকে। অভিযোজিত হয়েছে এখানকার জলবায়ুর সঙ্গে। ভারত আর পাকিস্তানের মতো শ্রীলংকারও রয়েছে সিদি স্থাপনার নিজস্ব আখ্যান। পর্তুগিজ, ডাচ ও ব্রিটিশ যুগে বিপুল পরিমাণ হাবশি আনা হয়েছিল এখানে। তবে তার আগের ইতিহাস একেবারে শূন্য নয়। ইবনে বতুতা শ্রীলংকা সফরকালে সিদিদের উপস্থিতি দেখেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা কলম্বো নগরীতে প্রবেশ করলাম। সেখানে উজির, সমুদ্রপথ তদারককারী বসবাস করেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে ৫০০ আবিসিনীয় যোদ্ধা।’ অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ের শাসক ও অভিজাতদের অধীনে কাজ করেছে সিদিরা। তার আরেকটি প্রমাণ দেখা যায় আরো পরে। ১৫৮৫ সালে সিতাওয়াকা রাজ্যের শাসক রাজাসিংহে পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। তার সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ গঠিত ছিল সিদিদের দিয়ে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শ্রীলংকায় সিদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছয় হাজার বলে লিখিত প্রমাণ মেলে। প্রকৃত সংখ্যা বেশি হওয়া অস্বাভাবিক না। সংস্কৃতির দিক থেকে শ্রীলংকার মাটিতে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। জনপ্রিয় অবস্থান নিয়ে আছে তাদের বিশেষ ধরনের নাচ ‘কাফরিনহা বাইলা’। দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মালদ্বীপ। দাস প্রথার সূত্র ধরে দ্বাদশ শতক থেকেই সেখানে দেখা যায় আফ্রিকান উপস্থিতি। ইবনে বতুতা তার সফরনামায় শেখ নাজিব ও আবদুল আজিজ নামের দুজন বিখ্যাত সিদির কথা উল্লেখ করেছেন। মালদ্বীপে বসবাস করা অধিকাংশ সিদি জড়িত ছিল নারকেল চাষের সঙ্গে। শ্রীলংকার বিশেষ নাচের মতো মালদ্বীপে বিশেষ ধরনের গান প্রচলিত সিদি সমাজে।     

দূর আফ্রিকা থেকে এসে ভারতবর্ষের মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে গেছে সিদি সমাজ। দক্ষিণ এশিয়ার বহুমাত্রিক ইতিহাসে তাদের স্বতন্ত্র উত্থান ও পতনের গল্প রয়েছে। ভারতের স্থানিক ভিন্নতার প্রভাবে ভিন্নতা এসেছে তাদের সংস্কৃতি ও ভাষায়। সিদিরা যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে এসেছে, ভাষাগত ভিন্নতা আগে থেকেই ছিল। এখানে এসে সোয়াহিলি, সোমালি ও বান্টুর সঙ্গে মিশেল ঘটেছে আরবি, ফারসি, পাঞ্জাবি, সিংহলি ও ভারতীয় অন্যান্য ভাষার। সেখানে কোচি ও গুজরাটির আধিপত্য সব থেকে এখানকার সংস্কৃতিকে দিয়েছে বৈচিত্র্য। গুজরাটে ধামাল, পাকিস্তানে সুফি সংস্কৃতি, মালদ্বীপের সংগীত কিংবা শ্রীলংকার নৃত্য সে বৈচিত্র্যের দলিল।  


আহমেদ দীন রুমি: লেখক