সিল্করুট

হাবশি ক্রীতদাস থেকে দিল্লির ‘আমির উল উমারা’

ফজল হাসান

কামাল আমরোহীর রাজিয়া সুলতানা সিনেমার পোস্টার থেকে

ইতিহাসে অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায় তারা কোনো সময়ে জিরো ছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজের মেধা, বীরত্ব কিংবা অন্য কোনো কারণে হয়েছিলেন হিরো তবে উল্টো পরিস্থিতিও ঘটেছে অনেকের ভাগ্যে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মামলুক শাসনের সময় দিল্লি সালতানাতের প্রথম নারী শাসক সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার শাসনামলে জিরো থেকে হিরো হওয়া একজন ছিলেন জামাল উদ দিন ইয়াকুত। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন আফ্রিকান হাবশি (বা সিদ্দি)

সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার অনুগত কর্মচারী এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জামাল উদ দিন ইয়াকুতের ক্ষমতা এবং প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। সম্রাজ্ঞী তাকে রাজকীয় আস্তাবলের প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সম্মানজনক উপাধি আমির উল খাইল (ঘোড়ার আমির) দিয়েছিলেন। যা হোক, অল্প সময়ের মধ্যে জামাল উদ দিন ইয়াকুত তার তীক্ষ বুদ্ধি সাহসিকতার জন্য উচ্চ অবস্থান পদমর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সম্রাজ্ঞী তাকে আরো উচ্চতর আমির উল উমারা (আমিরদের আমির বা অভিজাতদের প্রধান) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে আমির-উল-উমারা পদটি কেবল সর্বোচ্চ স্তরের একজন উচ্চপদস্থ তুর্কি ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত ছিল।

বর্তমান লেখাটি হাবশি জামাল উদ দিন ইয়াকুতের ক্রীতদাস থেকে দিল্লির মসনদের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার ইতিহাস।

জামাল উদ দিন ইয়াকুতের পরিচয়

জামাল উদ দিন ইয়াকুতের বাল্যকাল সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, মূলত তার ক্রীতদাস পরিচয়ের কারণে। জামাল তার আসল নাম নয়। অনুমান করা হয় যে জামাল উদ দিন ইয়াকুত ছিল তার মামলুক সম্রাটের দেয়া তুর্কি নাম। তিনি দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ এবং সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার শাসনামলে (১২০০ থেকে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) জীবিত ছিলেন।

জামাল উদ দিন ইয়াকুত ছিলেন আবিসিনিয়ার হাবশি। তার দৈহিক গড়ন ছিল দীর্ঘ এবং দেহে ছিল অপরিমেয় শক্তি। উল্লেখ্য, বেশির ভাগ হাবশি দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকা থেকে আসা বান্টু বংশধর। ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দীতে হাবশিদের ক্রীতদাস হিসেবে ভারতবর্ষে আনা হয়েছিল। তারা এসেছিল প্রধানত নীল নদের তীরবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে, যেমন মিসরের উত্তরাঞ্চল, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া সুদান। ভারতের মুসলিম রাজারা তাদের শারীরিক গঠন দৈহিক শক্তি, লড়াই করার দক্ষতা এবং আনুগত্যের জন্য নিযুক্ত করতেন। সেসব হাবশির মধ্যে কেউ কেউ দিল্লি সালতানাতের সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়েছিল। সেই তালিকায় জামাল উদ দিন ইয়াকুতের নাম সবার আগে রয়েছে।

ভাগ্যের পরিবর্তন

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে জামাল উদ দিন ইয়াকুত ছিলেন আফ্রিকান হাবশি ক্রীতদাস। সেই ক্রীতদাস থেকে দিল্লির মসনদের অভিজাত ব্যক্তি হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসের খানিকটা পেছনে ফিরে যেতে হবে।

সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশের (দিল্লি সাম্রাজ্যের মামলুক রাজবংশের সম্রাট, যিনি ১২১১-১২৩৬ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন) মৃত্যুর পরে ক্ষমতার জন্য লড়াই শুরু হয়। জীবিতকালে ইলতুতমিশ তার কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে তার চার অযোগ্য পুত্রের চেয়ে বেশি পছন্দ এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য যোগ্য মনে করতেন। তবে ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর রাজিয়া সুলতানা তার বড় ভাই এবং মাকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসেন। তার ক্ষমতায় আসার জন্য তুর্কি আভিজাত্য এবং ইসলামিক ওলামা একজন নারীর ক্ষমতায় আসার বিরোধিতা করেছিল। সেই সময় লাহোরের গভর্নর ছিলেন শের খান সানকার নামে একজন তুর্কি অভিজাত ব্যক্তি। সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানাকে রক্ষা এবং দেখাশোনা করার পাশাপাশি তার ওপর নজর রাখার জন্য তিনি ইয়াকুতকে সম্রাজ্ঞীর সেবায় নিযুক্ত করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা সব বিষয়ে ইয়াকুতের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং সেই অনুযায়ী রাজকার্য পরিচালনা করতেন। তখন গুঞ্জন উঠতে শুরু করে যে জামাল উদ দিন ইয়াকুত শুধু সভাসদের প্রধানই ছিলেন না, সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। এমন গুজবই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছিল। চারদিক থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। প্রথমেই বিদ্রোহ করেন লাহোরের গভর্নর। অবশ্য সেই বিদ্রোহ রাজিয়া সুলতানা শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বলা হয়, সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অতুর্কি কৃষ্ণাঙ্গ জামাল উদ দিন ইয়াকুতকে আস্তাবলের প্রধান থেকে সভাসদদের প্রধান করে তোলা, যদিও ইয়াকুত আনুগত্য এবং যোগ্যতার কারণে হয়ে উঠেছিলেন সম্রাজ্ঞীর অতি ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসী। সম্রাজ্ঞী তাকে আমিরপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করলে তুর্কি সভাসদরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তখন আমিরপ্রধান হওয়ার গৌরব শুধু একজন তুর্কির জন্যই নির্ধারিত ছিল। তাই কোনো আফ্রিকান হাবশি সেই সম্মান পাবে, তা তুর্কি সভাসদরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।

যদিও বলা হয়, তাদের সম্পর্ক গোপন ছিল এবং পর্দা দরজার আড়ালে ঘটেছিল, তবে তা দিল্লির আদালতে গোপন ছিল না। ভাটিন্দার (পাঞ্জাব) শাসক মালিক ইখতিয়ার-উদ-দীন আলতুনিয়া রাজিয়ার এমন সম্পর্কের বিরোধী ছিলেন। জানা যায়, আলতুনিয়া এবং রাজিয়া ছিলেন শৈশবের বন্ধু। তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন এবং আলতুনিয়া রাজিয়ার প্রেমে পড়েছিলেন। সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার জীবনে এমন এক কঠিন সময় এসেছিল যখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণপারিবারিক আনুগত্য, নাকি ভালোবাসা।

প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, অনেকের মতে সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার পতনের কারণ ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা। সম্রাজ্ঞীর একদিকে কথিত প্রেমিক জামাল উদ দিন ইয়াকুত এবং অন্যদিকে প্রতিশোধপরায়ণ মালিক ইখতিয়ার-উদ-দিন আলতুনিয়া। রাজিয়া সুলতানা দিল্লির মসনদে আরোহণ করার পর পরই তিনি সম্রাজ্ঞীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু রাজিয়া দিল্লির শাসক হিসেবে ব্যস্ততার কারণে বারবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সুতরাং যখন আলতুনিয়া শুনতে পান ইয়াকুত সম্রাজ্ঞীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, তখন তিনি সংগত কারণেই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং ঈর্ষান্বিত হন। সুলতানা রাজিয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করে ইয়াকুতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারেবিষয়টি আলতুনিয়া মেনে নিতে পারেননি। বলা হয়, ত্রিমুখী প্রেম, বিরহ বিচ্ছেদের প্রতিশোধই সুলতানা রাজিয়ার ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যার কারণ।

সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা জামাল উদ দিন ইয়াকুতের সম্পর্ক

সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা জামাল উদ দিন ইয়াকুতের সম্পর্ক নিয়ে দুটি আলাদা মতবাদ বা ব্যাখ্যা চালু আছে।

ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা জামাল উদ দিন ইয়াকুতের মধ্যে গোপন প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কারোর মতে, একসময় লাহোরের নির্মম শাসনকর্তা শের খান সানকারই সেই গুজব ছড়িয়েছিলেন। এমন গুজবই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছিল। চারদিক থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। প্রথমেই বিদ্রোহ করেন লাহোরের গভর্নর। অবশ্য রাজিয়া এই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একসময় তথাকথিত তাদের সেই সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক কিচ্ছা-কাহিনী চালু হয়েছিল। যেমন এক বিবরণে জানা যায় যে ইয়াকুত সম্রাজ্ঞীর কোমরের চারপাশে হাত রেখে তাকে ঘোড়ায় উঠতে সহায়তা করেছিল। সঞ্জয় ত্রিপাঠীর মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস এবং রশিদ-আল-দীনের জামিউত তাওয়ারিখ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে ঘটনাটি ছিল লাহোরের শাসনকর্তা শের খানের ষড়যন্ত্র মাত্র। তার উদ্দেশ্য ছিল রাজিয়া সুলতানাকে, পাশাপাশি ইয়াকুত এবং আলতুনিয়া উভয়কেই হত্যা করে তার ক্ষমতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা।

অন্যদিকে অনেক ইতিহাসবিদ পণ্ডিতেরা মনে করেন যে ইয়াকুত মোটেও রাজিয়া সুলতানার প্রেমিক ছিলেন না। তিনি কেবল একজন ক্রীতদাস ছিলেন এবং সম্রাজ্ঞীর সেবা করতে বাধ্য ছিলেন। জানা যায়, তিনি রাজিয়ার প্রতি প্রচণ্ড অনুগত ছিলেন, তবে তা ভালোবাসার চেয়ে তার কর্তব্যের কারণে বেশি ছিল। এছাড়া তিনি সম্রাজ্ঞীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছিলেন এবং খোলাখুলিভাবে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। এসব ঘটনা অভিজাত শ্রেণীর ভদ্র লোকজন উভয়ের সম্পর্কে গুজব তৈরি করতে ব্যবহার করেছিল।

যাহোক, সমালোচকদের মতে সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতান এবং জামাল উদ দিন ইয়াকুতের সম্পর্কের মধ্যে হয়তো সত্যিকারের ভারতীয় সংস্করণের ওথেলো গল্পের সঙ্গে মিল রয়েছে। যাহোক, তাদের মধ্যে প্রেমের (হয়তো সত্যি, নতুবা কল্পিত) সম্পর্ক ভারতে লোককাহিনীর একটি বিশিষ্ট অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের সেই কথিত প্রেমের গল্পকে কেন্দ্র করে ১৯৮৩ সালের হিন্দি চলচ্চিত্র রাজিয়া সুলতান নির্মিত হয়েছে। জামাল উদ দিন ইয়াকুতের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ধর্মেন্দ্র এবং রাজিয়া সুলতানার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হেমা মালিনী।

জামাল উদ দিন ইয়াকুতের মৃত্যু

জামাল উদ দিন ইয়াকুতের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। ইয়াকুত একদিক থেকে মামলুক রাজবংশের ক্রীতদাস ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হন। পরাজিত ইয়াকুতকে বন্দি করে হত্যা করা হয়। তিনি সম্রাজ্ঞীর প্রতি আনুগত্য থেকে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন।

শেষ কথা

জামাল উদ দিন ইয়াকুত অত্যন্ত বুদ্ধিমান সাহসী ছিলেন। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ধীরে ধীরে সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কর্মদক্ষতা এবং সম্রাজ্ঞীর নেকনজরে থাকার কারণে দিল্লির মসনদের আমিরদের আমির হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।

পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাস যতদিন সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানাকে স্মরণ করবে, ততদিন সম্রাজ্ঞীর নামের সঙ্গে জামাল উদ দিন ইয়াকুতের নামও উচ্চারিত হবে।

 

ফজল হাসান: লেখক অনুবাদক