অভিমত

উচ্চ কর আরোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেভারেজ খাত?

রেজাউল হাসান

ছবি : বণিক বার্তা

খুব দ্রুতই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে তরুণ জনগোষ্ঠী ও শক্তিশালী কর্মশক্তি মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি উন্নতি করছে। ২০ বছর ধরে এ দেশের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই তরুণ, যাদের মাধ্যমে বিপুল প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সক্রিয় কর্মশক্তি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তাদের এ অবদানের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্প খাতের সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের অনুকরণীয় নেতৃত্বে গত ছয় বছরে বাংলাদেশের আর্থিক উন্নতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিগত কয়েক বছরে কভিড মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ, রফতানি কমে যাওয়া, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ হ্রাস এবং সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মতো নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এত কিছুর পরও এ সময়ে এনবিআর স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি সূচক বজায় রেখেছে। জনাব মুনিমের মেয়াদকালে এনবিআরের আয়কৃত রাজস্বের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তার নেতৃত্ব প্রশংসার যোগ্য। 

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিভিন্ন খাতের অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে মহামারী-পরবর্তী সময়ে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে এফএমসিজি (ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস) খাত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থনীতির ধীরগতি সত্ত্বেও এ খাত টিকে গিয়েছিল। এর পেছনে কারণ ছিল ছোট আকারের পণ্য বিক্রি, ক্রয়ক্ষমতা এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের দ্রুত সম্প্রসারণ। এফএমসিজির মধ্যে প্রবৃদ্ধিতে লক্ষণীয় অবদান রেখেছে বেভারেজ খাত। খাতটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগও আকর্ষণ করতে পেরেছে।

গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুর কারণে বেভারেজ খাতের জন্য বাংলাদেশ বেশ আকর্ষণীয় একটি বাজার। কার্বোনেটেড ও অন্যান্য বেভারেজের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এটি আইসক্রিম ও বিস্কুটের মতো পণ্যের পাশে স্থান করে নিয়েছে। ভোক্তাদের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এগুলো প্রবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত কারণ এবং তা সরকারের রাজস্ব আদায়েও অবদান রাখে। 

২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ এ খাত থেকে আয় করে ১৫৫২ কোটি টাকা। দেশের রাজস্বে যার অবদান ছিল ১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এনবিআরের মোট রাজস্ব আয়ের শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। দুই বছরে রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ প্রবৃদ্ধির মধ্যেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। বেভারেজ খাতের সম্প্রসারণের ফলে খুচরা বিক্রেতাদের নেটওয়ার্কও বিস্তৃত হচ্ছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে খাদ্য ও বেভারেজ খাতে দেশের কর্মশক্তির ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মরত, ফলে খাতটি জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং আরো সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।

উচ্চ সম্পূরক শুল্ক এবং ন্যূনতম করের কারণে সম্প্রতি বেভারেজ খাতের প্রবৃদ্ধি ২০-২৫ শতাংশ কমে গেছে। সরকারের রাজস্বে এর অবদান কমে যাওয়া থেকেই বিষয়টি বোঝা যায়—২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এ পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকা, শেষার্ধে যা ১৭০ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০২৩ সালের জুনে ৩ শতাংশ টার্নওভার কর আরোপের পর রাজস্বের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এটি যে আরো কমবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছিল ৮৬৫ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ের রাজস্ব থেকেও কম।

এমন কঠোর আর্থিক নীতির বাস্তবায়নের ফলে বেভারেজ খাতের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বার্ষিক বিক্রির ওপর ভিত্তি করে টার্নওভার কর আরোপ করার বিষয়টি ঔপনিবেশিক সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ধরনের কর আরোপের আগে এনবিআরকে আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের মূল্য, বৈদেশিক মুদ্রার হার, মুদ্রাস্ফীতির হার, মূল্য সংযোজন, বাজার পরিস্থিতি এবং মূলত দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। 

কিন্তু গত বছর নতুন প্রণীত আয়কর আইন, ২০২৩-এ হঠাৎ করেই বেভারেজ খাতের ওপর ৫ শতাংশ (যা আগে ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ) টার্নওভার কর আরোপ করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়। এটি এ খাতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। টার্নওভারের ওপর দ্রুত ন্যূনতম কর আরোপের ফলে খাতটি বিপর্যস্ত হয়েছে।

গত নয় মাসের রাজস্বের পরিমাণ থেকে এ নীতির তাৎক্ষণিক প্রভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত অর্জিত রাজস্ব ছিল ২৩৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ৪৩৬ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা। যদি ৩ শতাংশ টার্নওভার কর অব্যাহত থাকে বা বাড়ে তাহলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি থেমে যেতে পারে। এটি সম্ভবত কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি মন্থর এবং বিনিয়োগের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রাজস্ব বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে প্রভাবিত করবে। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উদ্দেশ্য বিঘ্নিত হতে পারে। 

বাংলাদেশে অনেক খাতই শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হারে নামমাত্র টার্নওভার কর দেয়। বেভারেজ খাতের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আইসক্রিমের ওপর ধার্য করের পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে বেভারেজ খাতের ওপর কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই প্রস্তাবিত ৩ শতাংশ কর অনেক বেশি বলে মনে হয়। এ হার বাস্তবায়ন করা হলে স্থানীয় উৎপাদনকারী এবং বিদেশী বিনিয়োগকারী উভয়ের ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি হবে। একটি ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি হবে।

৩ শতাংশ টার্নওভার কর আরোপের ফলে কোম্পানিগুলো তাদের ট্রেড মার্জিন ও বিনিয়োগ কমাতে বাধ্য হয়েছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। অর্থাৎ কার্বোনেটেড পানীয় কেনা মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, এতে বিক্রিও কমে গেছে। ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

বাংলাদেশের বেভারেজ খাতে মোট করহার প্রায় ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ, যার মধ্যে আছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং আমদানি শুল্ক। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ হার সর্বোচ্চ। ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানে করের হার যথাক্রমে ৪০ শতাংশ, ২৯ দশমিক ২, ৩৮ দশমিক ৪৩ ও ৩০ শতাংশ। এ উচ্চ করের বোঝা উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়, এতে পণ্যগুলোর খুচরা মূল্যও বৃদ্ধি করে। প্রতিযোগিতামূলক কর ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশের কার্বোনেটেড বেভারেজ খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিতই করে না, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

দেশের বেভারেজ খাত বাংলাদেশের বাজারের সম্ভাবনার ভিত্তিতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে। তবে সরকারি রাজস্ব বাড়ানোর পরিবর্তে এ খাতের ওপর আকস্মিকভাবে ৩ শতাংশ হারে অত্যধিক কর আরোপের ফলে সামগ্রিক রাজস্ব আয় হ্রাস হয়। প্রকৃতপক্ষে এ প্রভাব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৯-এর মূল ভাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়নের প্রচার এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা এ লক্ষ্যমাত্রার অন্তর্ভুক্ত। 

সুতরাং আমাদের অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বর্তমান ৩ শতাংশ হার কমিয়ে ১ শতাংশ বা তার কম করা উচিত। এতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এ খাত ও অর্থনীতির বিকাশ হবে। এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ, ব্যাপক প্রভাব মূল্যায়ন এবং আদর্শভাবে, এ খাতসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলার জন্য একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এ বিষয়গুলো জরুরি।   

রেজাউল হাসান: সাবেক সদস্য (ভ্যাট) পলিসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন