বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লে মান খারাপ হবে এটা মনে করি না

২০১৯ সাল থেকে শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। দেশের শিক্ষা খাতে গত কয়েক বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের এসব উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম, প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ছাত্ররাজনীতিসহ দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। এরই মধ্যে ৩২ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং আরো কয়েকটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এ উদ্যোগের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশেরই লক্ষ্য থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অল্পসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অধিক শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রয়োজন ছিল। আরেকটি বিষয় হলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একার পক্ষে কয়েক হাজার কলেজকে সঠিকভাবে মনিটরিং সম্ভব নয়, যার ফলে এদের মানের অবনমন ঘটছিল। প্রধানমন্ত্রী যখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রতি জেলার কলেজগুলোকে ওই জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশও জারি করা হয়েছিল। এটি বাস্তবায়ন হলে কলেজগুলোর শিক্ষার মানের উন্নয়ন হবে।

তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যুগোপযোগী কারিকুলাম নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমরা এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছি। জাপান তাদের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বিদেশী শিক্ষক এনেছিল। প্রয়োজনবোধে আমাদেরও তেমন করতে হবে। বিশেষত আমাদের দেশের এমন অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আমরা যাতে তাদের মেধাকে আমাদের দেশেও কাজে লাগাতে পারি এ কারণে ব্লেন্ডেড এডুকেশন সিস্টেম চালু করছি। এর ফলে এসব মেধাবী শিক্ষক আমাদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামকেও যুগোপযোগী এবং কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণের চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অ্যাক্রেডিটেশন নিয়ে কাজ করছি। ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ওয়াশিংটন একর্ডের অ্যাক্রেডিটেশন লাভের চেষ্টা চলছে। এটি পেলে দেশের রেজিস্ট্রেশন ব্যবহার করেই তারা আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পাবেন।

শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন অধিকসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হলে শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লে মান খারাপ হবে এটি আমি মনে করি না। যে পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থাপন করা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার সুযোগ এবং মান দুটোই বাড়বে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার আগে আমাদের শতবর্ষী কলেজগুলো যখন কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল তখন কলেজগুলোর শিক্ষার মান বেশ ভালো ছিল। কলেজগুলোর একটা সুনাম ছিল। কিন্তু যখন তাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হলো তখন শিক্ষার সেই মান এবং সুনাম অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি জেলার অধীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয় তখন এদের মান যেমন বাড়বে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সক্ষমতা এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়বে। কারণ এসব কলেজের এরই মধ্যে অবকাঠামো রয়েছে এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন। তাই আমাদের শতবর্ষী কলেজগুলোকে এখন আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে না রেখে ওই জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা জরুরি। যদিও এক্ষেত্রে আইনি বাধার কথা বলা হয়। কিন্তু আমার মতে, এটি তেমন বাধা নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সদিচ্ছা থাকলে এটি স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব। এটি বাস্তবায়ন হলে এ কলেজগুলোর শিক্ষার মান এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উভয়ই বাড়বে। 

বর্তমানে আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য পর্যাপ্ত কি?

আওয়ামী লীগ সরকার আমজনতার জন্য কাজ করে। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য দেশের প্রতিটি মানুষকে সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন করা। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যাদের সাক্ষরতার হার কম কিন্তু উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ অনেক বেশি। আমরা তেমন হতে চাই না। আমরা আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে একটি ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই। এ কারণে আমাদের সাক্ষরতা অর্জন এবং প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ বেশি থাকে। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা উচ্চশিক্ষায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিচ্ছি না। অনেক সময় জিডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ কত এটি হিসাব করা হয়। এ তুলনাটি করা উচিত নয়। আমাদের কর আহরণের যে লক্ষ্য সেটির সঙ্গে কর আহরণের বাস্তব চিত্রের বেশ পার্থক্য রয়েছে। এর পরও কিন্তু আমরা শিক্ষায় যথেষ্ট সর্বসিদ্ধি দিয়ে থাকি। কারণ শিক্ষা অর্জনকে আমরা ব্যয়বহুল করতে চাই না। আবার শিক্ষার সবকিছু কিন্তু শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই হিসেবে শিক্ষায় আমাদের বাজেট কম নয়। আর আমার মতে, আমাদের উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে বড় চ্যালেঞ্জ বাজেট নয়। আমাদের চ্যালেঞ্জটা ব্যবস্থাপনার। সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এই বাজেটেই উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব।

আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ পিছিয়ে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংগুলোয় যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে সেগুলো কিন্তু প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এসব দেশের। এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যয় অত্যন্ত বেশি। শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি টাকা টিউশন ফি দিতে হয়। আমরা চাই না, আমাদের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় এত বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হোক। এ কারণে আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র-ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধার তুলনা করা হলে সেটি অযৌক্তিক। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে র‌্যাংকিংয়ের কথা বলা হলে সে জায়গায় আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে এবং গবেষণায় উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে। যেমন গত কয়েক বছরে আমরা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। যারা গবেষণা করছেন, ভালো জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করছেন তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রদান করা হচ্ছে। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা কতটুক রয়েছে?

১৯৭৩ সালের আইনে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় তাদের সংসদে পৃথক আইন পাসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই কিন্তু তাদের সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাদের সিদ্ধান্তগুলো তারাই নেয়। এখানে সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেখভাল করার সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি), তারাও কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, স্বাধীন কমিশন। সরকার যেটি করে সেটি শুধু আর্থিক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা। এটি করা হয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট আসে জনগণের ট্যাক্সের অর্থ থেকে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। এটিকে তো স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ বলা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে পরিচালিত হবে এক্ষেত্রে যেহেতু সরকার হস্তক্ষেপ করছে না, সুতরাং তারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই চলছে।

সম্প্রতি দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। সাধারণত প্রতিটি দেশে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি নেয়া হয়। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন জরিপ করা হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। আমাদের এ শিক্ষাক্রম চালু করার আগে কি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল?

আমরা এ শিক্ষাক্রম চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি ২০১৭ সাল থেকে। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেই এটি চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং শিক্ষাক্রম চালুর আগে এটি পাইলটিং করা হয়েছে। এরপর ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক কথায় শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল না। এক্ষেত্রে সংকট যেটা ছিল সেটা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব। এ বিষয়টি কাটিয়ে উঠতে কাজ চলছে।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে নানা সমালোচনা রয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 

আগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মুখস্থনির্ভর। কে কত ভালো মুখস্থ করছে তার ওপর নির্ভর করে ফলাফল তৈরি হতো। শিক্ষার্থীরা তখন পড়ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য। অল্প সময়ে ভালো ফলাফলের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছিলেন কোচিং এবং গাইড বই ব্যবসায়ীরা। নতুন শিক্ষাক্রমে এ সুযোগটা থাকছে না। শিক্ষার্থীরা এখন হাতে-কলমে শিখবে। এ কারণে গাইড বই এবং কোচিংয়ের ব্যবসা কমে যাবে। ফলে তারা চাচ্ছে না এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হোক। এছাড়া আমাদের কিছু অভিভাবক রয়েছেন যারা চান সন্তান সারা দিন স্কুল-কোচিং-হোম টিউটর নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এখন যেহেতু স্কুলের শিক্ষাই যথেষ্ট, তারাও কিছুটা উদ্বিগ্ন। আবার এ শিক্ষাক্রমে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় তথা সেরা শিক্ষার্থী, মেধাবী-মেধাহীন শিক্ষার্থীর কোনো বিষয় থাকবে না। আগে যার অর্থ ছিল তার সন্তানের ভালো ফলাফলে সম্ভাবনা বেশি ছিল, কিন্তু এখন শহরের ধনী ব্যক্তির সন্তান যেভাবে যা শিখবে প্রান্তিক অঞ্চলের দরিদ্র ব্যক্তির সন্তানেরও তেমন শিক্ষারই সুযোগ থাকবে। ফলে স্কুলগুলোর মধ্যে ফলাফলের মাধ্যমে সুনাম অর্জনের যে প্রবণতা ছিল সেটি আর হবে না। তাই স্বনামধন্য কিছু স্কুলও চায় না এটি বাস্তবায়ন হোক। 

আর এ শিক্ষাক্রম নিয়ে বেশকিছু গুজব ছড়ানো হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে, এ শিক্ষাক্রমে কোনো হোমওয়ার্ক থাকবে না। কিন্তু এটি সত্যি নয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যা শিখে আসবে সেটি তো তাদের বাসায় চর্চা করতে হবে। বিভিন্ন রিপোর্ট তৈরির জন্যও তাদের বাসায় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। তবে এখানে বিষয় হলো, তাদের আলাদা কোচিং করতে হবে না, বাড়িতে শিক্ষকের প্রয়োজন হবে না, স্কুলেই সব শেখানো হবে। আরেকটি গুজব ছড়ানো হয়েছে যে ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে। এটিও সত্যি নয়। ধর্মীয় শিক্ষা এখনো রয়েছে। পার্থক্য হলো, আগে যেখানে মুখস্থ করানো হতো—নামাজ কয় ওয়াক্ত, এখন সেখানে দেখা হবে সে নামাজ পড়তে জানে কিনা। তাকে নামাজ পড়ে দেখাতে হবে। আরেকটি গুজব হলো পরীক্ষা থাকবে না। এটিও সঠিক নয়। প্রচলিত পরীক্ষা না থাকলেও বছরব্যাপী মূল্যায়ন কিন্তু থাকবে। আগে শিক্ষার্থীরা ফেল করলে আমরা সর্বোচ্চ কী ব্যবস্থা নিতাম? তাদের এমপিও বাতিল করতাম, বেতন বন্ধ করতাম। এত শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি তো পূর্ণ হতো না। কিন্তু এখন যেটা হবে ছয় মাস পরপর যখন শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে তখন সেখানে শিখন ঘাটতি থাকলে তা ধরা পড়বে এবং তাৎক্ষণিক শিক্ষকদের কৈফিয়তের আওতায় এনে শিখন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আমাদের এ শিক্ষাক্রমে দেশে শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন সেসব শিক্ষাবিদ যুক্ত ছিলেন। এর সঙ্গে ইউনিসেফও যুক্ত আছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এ শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। 

নতুন শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞানশিক্ষায় নম্বর ১০০-তে নামিয়ে আনা হয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এত উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানশিক্ষা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে এবং শিক্ষার্থীরাও বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহ হারাবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় নম্বর কমানো হলেও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তাদের যতটুকু বিজ্ঞান শেখা প্রয়োজন সেটি তাদের শেখানো হবে। আগে যেটা হতো আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানের তেমন কিছুই শেখানো হতো না আর কিছু শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শেখানো হতো। এ বেশি শেখানোর ফলে কিছু শিক্ষার্থী এত প্যানিকড হয়ে যেত যে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েও উচ্চ মাধ্যমিকে আর বিজ্ঞান নিত না। এখন সেটি হবে না। বয়স অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যতটুকু বিজ্ঞান শেখা প্রয়োজন তার এর কমও শিখবে না, বেশিও শিখবে না। আর এখন যেহেতু তারা শুধু মুখস্থনির্ভর নয়, বরং হাতে-কলমে শিখবে তাই পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আরো বেশি আগ্রহী হবে।

কারিগরি শিক্ষায় সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। কিন্তু এদের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশই শিক্ষক সংকট. অবকাঠামো সংকট নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরাও আগ্রহী হচ্ছেন না। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের মান নিশ্চিতে সরকারের পরিকল্পনা কী?

বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মানহীন এমনটি নয়। বাংলাদেশ বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। এ বৃহৎসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে যুগোপযোগী কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই এবং এটি বৃহৎ ক্ষেত্র যে এখানে সরকারের একার পক্ষে কাজ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় এবং বেসরকারি অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষায় আমাদের একটি সমস্যা শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। পিএসসির মাধ্যমে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সেটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কারিগরি ক্ষেত্রে হাতে-কলমে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের যুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ নেই। যেমন কারিগরি শিক্ষা তো মূলত হাতে-কলমে শিক্ষা। কারো হয়তো শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন না থাকলেও সে খুব ভালো ফটোগ্রাফার বা কোনো মেশিন চালানোয় তার খুব ভালো দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো শিক্ষক হিসেবে তাদের তেমনিভাবে যুক্ত করতে পারছি না। এ বিষয়গুলোয় পরিবর্তন আনতে হবে। যারা হাতে-কলমে দক্ষ, কারিগরি শিক্ষায় তাদের আরো বেশি যুক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই দুর্নীতির কারণে আলোচিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বৃদ্ধির পেছনে কোন বিষয়গুলো দায়ী এবং এ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কী ভাবছে? 

দুর্নীতির সমস্যা শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয় বরং দেশে সামগ্রিকভাবেই দুর্নীতির সমস্যা রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে কয়েক ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। এর মধ্যে একটা হলো বদলিসংক্রান্ত, আরেকটি হলো প্রকল্পসংক্রান্ত। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ ও বদলিসংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে কোচিং ও গাইডবই বাণিজ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের একটা অংশ ক্লাসের বাইরে কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন। তারা এ বিষয়টি কেন্দ্র করে সুবিধাজনক স্থানে বদলির চেষ্টা করেন এবং এ ধরনের বদলি নিতে গিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। আবার প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ করা হয়, কেনাকাটা করা হয়। আমরা যখনই এ ধরনের অভিযোগ পাচ্ছি তখনই ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবস্থা গ্রহণ জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শাস্তি প্রদান করলে দেখা যায় আদালতের স্টে অর্ডারে সেটি আটকে দেয়া হয় এবং আদালতে মামলাজট থাকায় সে বিষয় সুরাহা হতে ছয়-সাত বছর লেগে যায়। এদিকে সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। সরকার পুনর্নির্বাচিত হলেও আবার মন্ত্রী, ডিজি এসব পদে পরিবর্তন আসে। নতুনরা এলে পুরনো বিষয়গুলো অনেকটা আড়ালে চলে যায়। যদি দ্রুততম সময়ে শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা যেত তা হলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেত। অন্তত কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সাসপেন্ডের সুযোগ থাকা উচিত। আবার এটিও সত্যি যে শিক্ষাক্ষেত্রে যতটা দুর্নীতি হয় সেগুলো নিয়ে প্রচারণা অনেক বেশি হয়। সামান্য কোনো কিছু ঘটলেও অনেক বড় আকারে সেটি প্রচার করা হয়। এ কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবে যতটা দুর্নীতি তার চেয়ে বেশি মনে হয়। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্ররা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানের ছাত্ররাজনীতিকে কীভাবে দেখছেন? অতীতের সেই গৌরবময় ইতিহাস তারা কতটা বজায় রাখতে পেরেছে?

দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে ছাত্ররা সব সময়ই এগিয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও কোনো সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হলে ছাত্ররা অবশ্যই এগিয়ে আসবে। দেশে বর্তমানে এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, তাই এখনকার ছাত্ররাজনীতি কেমন চলছে সেটি দিয়ে অতীতের তুলনায় ছাত্ররাজনীতি কতটুকু শক্তিশালী সেটি বলা যায় না। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররাজনীতির পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বললে যে প্রশ্ন আসে সেটি হলো সবাই রাজনীতির সুযোগ পাচ্ছে কিনা। যদি এ দিকটি বিবেচনা করা হয় তাহলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু নানা মতের-নানা আদর্শের অস্তিত্ব রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাধা দেয়া হচ্ছে না। তবে কেউ যদি ছাত্রদের ব্যবহার করে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখে তাহলে সেটি ছাত্রদের নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহারের শামিল। ছাত্রদের সরকার পতনের হাতিয়ার করার সুযোগ নেই। সরকার পতন ছাত্রদের কাজ নয়, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইলে সেটি রাজনৈতিক দলগুলো করবে। আর ছাত্রদের অবশ্যই রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু সবার আগে তাদের দায়িত্ব তো পাঠগ্রহণ, সঠিকভাবে শিক্ষাজীবন শেষ করা। সেই শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেটিও অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন