পর্যালোচনা

অর্থ পাচারকারীদের প্রতিরোধে বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডিকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করার পথে একটি বড় বাধা হলো বিদেশে অর্থ বা পুঁজি পাচার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকেই দেশে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে সামরিক সেনা শাসনের অধীনে আরো প্রকট হয়। বলা হয়ে থাকে বর্তমানে বিদেশে অর্থ পাচার যেন একটি ওপেনসিক্রেট। তবে বিগত শতাব্দীর আশি বা নব্বইয়ের দশকে মানি লন্ডারিং এতটা খোলামেলা ছিল না। নিজ দেশে অর্থ-সম্পদ রাখা নিরাপদ নয় বিবেচনায় দুর্নীতিবাজ অবৈধভাবে দেশীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীরা বিদেশে অর্থ পাচার করে বিদেশী ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে কিংবা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে।

অর্থ পাচারের অন্যতম প্রধান বাহন হলো হুন্ডি। ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাপী তেল সংকটের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হলে সেসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হতে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় কোটি ৩০ লাখ (সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগস্ট ২০২২, দেশ রূপান্তর)

প্রবাসী আয় বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু প্রবাসীদের উপার্জনের সম্পূর্ণ টাকা বৈধ উপায়ে দেশে আসে না। অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, মোট পাঠানো রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে (সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগস্ট ২০২২, দেশ রূপান্তর) কখনো কখনো শতকরা হার আরো বেড়ে যায়। প্রক্রিয়ায় পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা দেশে পরিশোধ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। সিআইডির বরাতে গত সেপ্টেম্বর মাসে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী শুরু হলে হুন্ডি ব্যবসা অনেকটা কমে যায়। সেজন্য প্রায় দুই বছর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসে এবং আগস্ট-’২১- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই করোনা মহামারীর প্রকোপ কমে এলে হুন্ডি ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যাওয়ার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশ কম। শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই নয়, আরো নানা উপায়ে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়। মুদ্রা পাচার বামানি লন্ডারিং’-এর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা বা থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাব মতে, বাংলাদেশ থেকে মোট অর্থ পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের অতিমূল্যায়ন বা ওভার ইনভয়েসিং এবং রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের কম মূল্যায়ন অর্থাৎ আন্ডার ইনভয়েসিং করে অর্থ পাচার করা হয়। কখনো কখনো পণ্য আমদানি-রফতানি না করে অবৈধ জাল কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ পাচার হয়। এর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতিবাজ সামরিক, বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ব্যাংকের টাকা আত্মসাত্কারীদের হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো এবং হুন্ডি সিস্টেমে প্রবাসীদের টাকা পাঠানো এবং বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো সহজ হয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের সিআইডি জানতে পেরেছে যে বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও হুন্ডির টাকা পাঠানো হয়। পুঁজি পাচারের আরো একটি পদ্ধতি হচ্ছে রফতানি আয়ের একটি বিরাট অংশ দেশে না এনে বিদেশে রেখে দেয়া। এভাবে অর্থ জমিয়ে কতিপয় ব্যবসায়ী বিদেশে বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে।

অর্থ পাচারের বিষয়টি সরকারি কর্তৃপক্ষ জানলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের অভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তবে দিন দিন মানিলন্ডারিং বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রচারিত রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৮২ হাজার ১১০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৭৭ হাজার ৪৩৫ কোটি এবং ২০১৫ সালে ৯৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। সংস্থার তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় লাখ কোটি টাকা। গত দুই বছরের মুদ্রা পাচারের চিত্র আরো ভয়াবহ বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

বাংলাদেশ থেকে কীভাবে এবং কারা অর্থ পাচার করে সে বিষয়ে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা

() দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ীরা অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেন; () আমদানি-রফতানির আড়ালে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বিদেশে উন্নততর জীবন কাটানোর কিংবা বিকল্প ব্যবসার উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার করে; () মাদক অস্ত্র ব্যবসাসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার (যেমন ক্যাসিনো) মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পাচার করে; () উন্নত সুযোগ-সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে রাখা এবং নিজেও গোপনে ওই দেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্য অর্থ প্রচার করে জমা করে; () সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা মালয়েশিয়ায় জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, কানাডা ইত্যাদি দেশে বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য অর্থ পাচার করে।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে, প্রাথমিকভাবে সেসব দেশে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যত্র সুবিধামতো জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুবাইয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পর্যালোচনায় জানা যায়, ওখানে ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা শীর্ষস্থানে রয়েছে। এছাড়াও শোনা যায় দুবাইয়ে বসবাসকারী ব্যবসারত কতিপয় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর কাছে বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ/আমলা/ঋণখেলাপি পাচারকৃত অর্থ গচ্ছিত রাখছে। অনেকে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে ব্যবসায় বিনিয়োগে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সুযোগ নিয়ে অনেকে বৈধভাবে পুঁজি সরাচ্ছে। ওই টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করা হলে এর লভ্যাংশ এবং পরবর্তী সময়ে ইকুইটির টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় বিদেশে অর্থ সম্পদ রাখা মানিলন্ডারিং আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিয়ম মেনে ব্যবসা করা বৈধ।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে তার হিসাব সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশীদের মোট অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে জমার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৫৫ শতাংশ। তবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত সব অর্থ পাচারকৃত নয়। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ছাড়াও বাড়ি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লগ্নী করে পাচারকৃত অর্থ সম্পদ রাখা হয়।

পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ নিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেসব হুবহু সঠিক নাও হতে পারে। পরিমাণ কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে, তবে বিদেশে অর্থ পাচার দিন দিন বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিজনিত যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিদেশে মুদ্রা পাচার।

পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন। পাচার রোধেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যাপারে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছে। ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন জারির মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ প্রমাণিত হলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান করা হয়েছে। বৈধ বা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার ধরা পড়লে এবং তা প্রমাণিত হলে অপরাধের সঙ্গে জড়িত অর্থ বা সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্য বা ১০ লাখ টাকা (যা অধিক) অর্থদণ্ড এবং সর্বনিম্ন চার বছর বা সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ভিত্তিতে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএফআইইউ প্রতিষ্ঠিত হলে মানিলন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কিছু কাজ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং ২০১৫ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী বিএফআইইউ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পুলিশের সিআইডি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করবে। ব্যাপারে বিএফআইইউর সঙ্গে তিন সংস্থার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ দুদক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার ধরা পড়লে এনবিআর তদন্ত করে মামলা করবে। হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার হলে সিআইডি মামলা করবে।

বিএফআইইউ বিদেশী রাষ্ট্র বা কোনো সংস্থা থেকে পাচারের কোনো তথ্য পেলে কিংবা দেশের মধ্যে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন ব্যাংক বা মিডিয়ার মাধ্যমে অবহিত হলে তা বিশ্লেষণপূর্বক তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে পাঠায়। তবে তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত শেষে আদালতে মামলা করে তা শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে বলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য আসেনি। -১০ বছরের পুরনো বহু মামলা আদালতে পেন্ডিং রয়েছে। প্রভাবশালী অপরাধীরা অনেক সময় মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে।

অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিষফোঁড়াস্বরূপ। এটি প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ পাচারের মাধ্যমে বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের একশ্রেণীর সরকারি আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির মধ্যে নৈতিকতা দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই। সেজন্য তারা অবৈধ অর্থ, ব্যাংকের টাকা, জনগণের আমানত, দেশের সম্পদ প্রভৃতি আত্মসাৎ লুট করে নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর জনগণকে এদের বিরুদ্ধে সতর্ক হতে হবে।

অপরাধীকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা জটিল সময়সাপেক্ষ বিবেচনায় করারোপের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যকর পন্থা বলে অনেকে মনে করে। বাংলাদেশঅটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই)’ ব্যবস্থার এখনো সদস্য নয়। বিশ্বের ১২১টি দেশ এর সদস্য। বাংলাদেশও এইওআইয়ের সদস্য হতে পারে। কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থ নিয়ে ব্যাংকে রাখলে ব্যবস্থার আওতাভুক্ত দেশকে চাহিবামাত্র ব্যাংক তথ্য দিতে বাধ্য। এছাড়া ওইসিডির অভিভাবকত্বে পরিচালিত () Base Erosion and Profit Shifting Inclusive Framework (BEPS) এবং () Global Forum on Transparency and Exchange of Information for Tax Purposes সংস্থা দুটির সদস্য হলে মানিলন্ডারিং ট্রান্সফার প্রাইসিং সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করে এনবিআরকে সহায়তা করতে পারে।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আসন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী নানা পরামর্শ দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। পুঁজি পাচার প্রতিরোধ বর্তমানে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে রফতানিকারকদের বিদেশে রফতানি আয় রেখে দেয়ার পরিমাণ সীমিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয় দেশে আনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআর যৌথভাবে কমিটি গঠন করে দ্রব্যের আমদানি রফতানিমূল্য যাচাই করে ওভার ইনভয়েসিং আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থ পাচারকারীদের প্রতিরোধে বিএফআইইউ, দুদক সিআইডিকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

বর্তমানে দেশে প্রবাসী আয়ের বিনিময় হারের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় মূল্য - টাকা বেশি। পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। ব্যাংকের পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকিং আইন সহজ করে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমবে, অন্যদিকে অর্থ পাচারও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তাই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ব্যাংক আর্থিক সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সর্বোপরি অর্থ পাচার প্রতিরোধে সব নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কঠোরতার কোনো বিকল্প নেই।

 

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন