খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা

শিগগিরই খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব

সেতা তুতুনজিয়ান

বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্যমূল্য সূচক অনুসারে সকালের নাশতায় যে ধরনের খাবার খাওয়া হয়যেমন সিরিয়াল, মাংস, দুধ, উদ্ভিজ্জ তেল চিনি জাতীয় পণ্যের দাম ফেব্রুয়ারির ১৪১ দশমিক পয়েন্ট থেকে মার্চে অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৫৯ দশমিক পয়েন্ট। যদিও এপ্রিলে খানিকটা কমে তা ১৫৮ দশমিক পয়েন্টে নেমে আসে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য সার্বিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার বিধ্বংসী প্রভাবসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিমাণ বর্তমানে নতুন উচ্চতা ছুঁয়েছে।

কভিড-১৯ মহামারী বিশ্বের খাদ্য ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা অকার্যকারিতা সামনে এনেছে। এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ আর সরবরাহ-শৃঙ্খলগুলো বিঘ্নিত হওয়ার কারণে দাম বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণজীবন যা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। চ্যালেঞ্জগুলো আরো কঠিন করে তুলছে ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ রাশিয়া ইউক্রেন উভয় পক্ষই বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, জ্বালানি সারের অন্যতম সরবরাহকারী।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার জন্য আরো বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাবদাহ, বন্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী খরার মতো প্রতিকূল আবহাওয়া কৃষি উৎপাদন খাদ্যের প্রাপ্যতাকে করছে বাধাগ্রস্ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রভাবগুলো বৃদ্ধি পাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা যদি দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় (প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায়) তবে তা কেবলই বিপর্যয় ডেকে আনবে। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সর্বশেষ আন্তঃসরকারি প্যানেলের প্রতিবেদন অনুসারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এড়ানোর জন্য অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। যদিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। বরং ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলোকে বিপর্যয় থেকে সুরক্ষিত রাখতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সহায়তা কর্মসূচিগুলো পুনরায় চালু করতে বড় অংকের বিনিয়োগের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন রয়েছে।

এমনকি তাপমাত্রা কমার সবচেয়ে আশাবাদী পর্যায়েও এক দশকের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রান্তসীমায় পৌঁছবে বলে মনে হয় না, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলগুলোয় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পানি চক্র বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে ঘন ঘন চরম তীব্র বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ খাদ্য পানির মতো জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর সংকট সামাজিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অস্থিতিশীলতা এবং অভিবাসনের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংঘাতের ইন্ধন জোগাবে।

একটি স্থিতিস্থাপক, টেকসই ন্যায়সংগত খাদ্য ব্যবস্থাকে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন অভিযোজন এজেন্ডার স্তম্ভ হতে হবে। আর তাই ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাগুলোকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। বিশেষ করে যে অঞ্চল রাষ্ট্রগুলোয় ভূমির রুক্ষতা প্রকট কিংবা জমির ন্যূনতম কৃষিমূল্য নেই এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন পানি যেখানে সহজলভ্য নয় বরং সীমিত অবনমিত এবং আর্থসামাজিক অবস্থাও বেশ কঠিন।

ধরনের বৈরী পরিবেশে কৃষিজমির কম উৎপাদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলগুলো স্থানীয় জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত খাদ্যের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে সমর্থ হয় না। প্রকৃতপক্ষে ধরনের প্রান্তিক পরিবেশে বিশ্বের ন্যূনতম ২৫ শতাংশ বা ১৭০ কোটি লোকের বসবাস, যারা দারিদ্র্য অপুষ্টিতে আক্রান্ত বিশ্বের মোটা জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ।

ক্ষুধা দারিদ্র্য স্বল্পমেয়াদে খাবারের প্রয়োজন মেটাতে কৃষক বার বার একই জমিতে অতিরিক্ত ফসল ফলাতে বাধ্য হতে পারে। এমনকি তারা জানে যে, এতে দীর্ঘমেয়াদে জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অচিরে যা তাদের পরিবার সম্প্রদায়কেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাছাড়া ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা, স্বল্প অর্থনৈতিক সুযোগ এবং বাজারে প্রবেশের সামান্য সুবিধাপ্রাপ্ত প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সামনে জীবনধারণের জন্য আর কোনো উপায়ও নেই। তাই তারা একই জমি বার বার ব্যবহারের দিকেই অগ্রসর হবে।

যেসব দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কম তাদের মূলত বাইরের দেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছু দেশ তাদের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে। কিন্তু মহামারী আর যুদ্ধ সম্পর্কিত বিপর্যস্ত পরিস্থিতি যৌথভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর অবস্থা কতটা নাজুক আর অসহায়। এফএওর রাষ্ট্রভিত্তিক খাদ্য কৃষি প্রতিবেদন ২০২১ অনুসারে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অতিরিক্ত ১৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ নতুন করে ক্ষুধার শিকার হয়েছে। এদিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, যুদ্ধ, কভিড, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যবৃদ্ধি ৩৮টি দেশের কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের প্রান্তে নিয়ে ফেলতে পারে।

দেশগুলো এর জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত খাদ্য সুরক্ষিত করার জন্য সংগ্রাম করছে। অনেক দেশই এখন তাদের খাদ্যনির্ভরতা পুনর্মূল্যায়ন করছে নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলকে সংক্ষিপ্ত করে আমরা যদি স্বল্পমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিই তাতে মাটি পানির মতো কৃষিসম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে মধ্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হতে পারে।

টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ সস্তা নয়। জৈব জলবায়ুগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কার্যকর উৎপাদন পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন ব্যয়বহুল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ। কিন্তু দুর্বল শাসন কাঠামো, সীমিত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং উচ্চঋণ অনেক দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মহামারীটি জনসাধারণের বাজেটের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। মহামারী মোকাবেলায় নেয়া বকেয়া ঋণের কারণে অনেক দেশের সরকার ঋণ সংকটে পতিত।

দারিদ্র্য দুর্বল দেশগুলো বাইরের সাহায্য ছাড়াই দূষণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি থেকে শুরু করে ক্ষুধা দারিদ্র্যের মতো অন্যান্য অগণিত আন্তঃসংযুক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করবেএমনটা আশা করা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা জোরদার করার জন্য, আমাদের অবশ্যই দেশীয় পর্যায়ের সমাধানের বাইরে গিয়ে আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সমাধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে, যা প্রান্তিক পরিবেশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের চাহিদাগুলোকে বিবেচনা করে। অন্যথায় ক্ষুধা, অভিবাসন আর সহিংসতার অস্থিতিশীল চক্র থেকে পালানোর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

সেতা তুতুনজিয়ান: থ্রাইভিং সলিউশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী, ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্ম ফর ফুড সিস্টেম সায়েন্সের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন