বছরজুড়ে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেড়েছে সবচেয়ে বেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে চালু ছিল দেশের পুঁজিবাজার। অতিমারীর মধ্যেও বাজার মূলধন লেনদেনে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে পুঁজিবাজার। প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। সেই সঙ্গে সেকেন্ডারি বাজারে যুক্ত হয়েছেন নতুন বিনিয়োগকারীরাও। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি পর্যায়ের সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন গত ১০ বছরে সর্বোচ্চে পৌঁছে। লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স। অন্যদিকে সমাপ্ত বছরে শেয়ারদর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোরই আধিপত্য দেখা গেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার মধ্যে গত বছর নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়। এরপর পুঁজিবাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে দেশ দেশের বাইরে ব্রোকারেজ হাউজের শাখা বা ডিজিটাল বুথ চালু করা হয়। আইপিওর শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রো-রাটা অনুসারে বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এছাড়া গত বছরে কোয়ালিফায়েড ইনভেস্টর অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানিজ রুলস, ২০১৮-এর আওতায় ডিএসইতে ছয়টি কোম্পানি নিয়ে স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে লেনদেন চালু হয়। এছাড়া পুঁজিবাজারে আলোচিত ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেট বিলুপ্তির মাধ্যমে ওটিসি মার্কেটের ১৮টি কোম্পানি, ১৪টি বন্ড এবং বেশকিছু ওপেন অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) চালু প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পরীক্ষামূলক লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ডেরও। সার্বিক বিষয় পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর সবচেয়ে বেশি শেয়ারদর বেড়েছে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর। শেয়ারদর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সবার উপরে ছিল সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড। গত বছরে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৩২৪ শতাংশ। কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন হাজার ৩৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ বৃস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বশেষ সমাপনী দর ছিল ৯৫৭ টাকা ৭০ পয়সা। লেনদেন চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার ১৯৫ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ৯৫৯ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়।

শেয়ারদর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফরচুন সুজ লিমিটেড। কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৩১৫ শতাংশ। বছরের শেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের সমাপনী দর ছিল ৯২ টাকা ১০ পয়সা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ দর ছিল ১৫ টাকা ৯০ পয়সা ১২১ টাকা ৮০ পয়সা।

২৮৪ শতাংশ শেয়ারদর বৃদ্ধি নিয়ে গত বছরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। খাদ্য আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ কর্মদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বশেষ সমাপনী দর ছিল ৪১ টাকা ৫০ পয়সা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪৪ টাকায় লেনদেন হয়। 

তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। গত বছর ওষুধ রসায়ন খাতের কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২৫৮ শতাংশ। কোম্পানিটির বাজার মূলধন প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা। সর্বশেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার ৪৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৫১ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হয়। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ দর ছিল যথাক্রমে ১০ টাকা ৬০ পয়সা ৬৩ টাকা ৮০ পয়সা।

তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে থাকা জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের বাজার মূলধন প্রায় হাজার ৬৯১ কোটি টাকা।  গত বছর তথ্য প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২৩৭ শতাংশ। সর্বশেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের সমাপনী দর ছিল ১৬৫ টাকা ৪০ পয়সা। গত এক বছরে শেয়ারটি ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা ১৮৫ টাকায় লেনদেন হয়।

২২৭ শতাংশ শেয়ারদর বৃদ্ধি নিয়ে গত বছর তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি কাট্টলী টেক্সটাইল লিমিটেড। কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার ৩০ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৩২ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ দর ছিল যথাক্রমে টাকা ৪০ পয়সা ৪১ টাকা ৮০ পয়সা।

তালিকায় পরের অবস্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি আনোয়ার গ্যালভানাইজিং লিমিটেড। গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২২৩ শতাংশ। কোম্পানিটির বর্তমান বাজার মূলধন ৫৪৫ কোটি টাকা। বছরের শেষ কার্যদিবসে শেয়ারটির সমাপনী দর ছিল ৩৭৯ টাকা ৭০ পয়সা। গত এক বছরে শেয়ারটি ৯২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৪৮৩ টাকায় লেনদেন হয়।

দর বৃদ্ধির তালিকায় অষ্টম অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতের কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলসের বর্তমান বাজার মূলধন প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২১৭ শতাংশ। গত এক বছরে কোম্পাটির শেয়ারের সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ দর ছিল টাকা ৮০ পয়সা থেকে টাকা ২০ পয়সা।

নবম অবস্থানে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারদর বছরে ২১৭ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটির বাজার মূলধন হাজার ৬২২ কোটি টাকা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার ৬৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২৪৯ টাকায় লেনদেন হয়। সর্বশেষ কার্যদিবসে সমাপনী দর ছিল ২৪৩ টাকা ৪০ পয়সায়। দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় সর্বশেষ রয়েছে দ্য ঢাকা ডায়িং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। বস্ত্র খাতের কোম্পানিটির বাজার মূলধন ২০৩ কোটি টাকা। গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২১৩ শতাংশ। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ দর ছিল যথাক্রমে টাকা ৯০ পয়সা ২৯ টাকা ৫০ পয়সা। বছরের শেষ কার্যদিবসে শেয়ারটির সমাপনী দর ছিল ২৪ টাকা ১০ পয়সা।

গত বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে এসেছে। প্রথমবারের মতো একটি সুকুক বন্ড ১৪টি কোম্পানিসহ মোট ১৫টি কোম্পানি গত বছর বাজারে এসেছে। আইপিওর মাধ্যমে এসব কোম্পানি হাজার ৬৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ২৯৭ কোটি ৭৩ টাকা মূলধন উত্তোলন করে। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠান বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। যেখানে ২০২০ সালে আটটি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে মোট ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ৩১১ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করে।

লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, করোনার মধ্যেও গত বছর ডিএসইর লেনদেন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০২১ সালে ডিএসইতে ২৪০ কার্যদিবস লেনদেন হয়। এতে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ৫৪ হাজার ৫২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা ডিএসইর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। আগের বছরের তুলনায় সমাপ্ত বছরে এক্সচেঞ্জটিতে লাখ ১৯ হাজার ৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বা ১৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি লেনদেন হয়েছে। গড় লেনদেন ছিল হাজার ৪৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। যেখানে ২০২০ সালে ২০৮ কার্যদিবসে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল লাখ ৩৪ হাজার ৯৮১ কোটি ২২ লাখ টাকা। গড় লেনদেন ছিল ৬৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

লেনদেনের পাশাপাশি গত বছর ডিএসইর বাজার মূলধনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। গত বাজার মূলধন ডিএসইর ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন আগের বছরের তুলনায় ৯৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। সমাপ্ত বছরে বাজার মূলধন সর্বোচ্চ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। সর্বনিম্ন ছিল লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা।  যেখানে ২০২০ সালে এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। 

অন্যদিকে করোনার মধ্যেও গত বছরে সূচকে উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট যোগ হয়েছে। এর মধ্যে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স আগের বছরের চেয়ে হাজার ৩৫৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট বা ২৫ দশমিক শূন্য শতাংশ বেড়ে হাজার ৭৫৭ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। গত বছর ডিএসইএক্স মূল্যসূচক সর্বোচ্চ হাজার ৩৬৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়। সর্বনিম্ন ছিল হাজার ৪৫ পয়েন্ট। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি হাজার ৯০ পয়েন্ট নিয়ে সূচকের যাত্রা শুরু হয়।

ব্লু-চিপ সূচক ডিএস-৩০ গত বছর ৫৬৮ পয়েন্ট বা ২৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হাজার ৫৩২ দশমিক ৫৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ওই বছর সূচকটি সর্বোচ্চ হাজার ৭৮৭ দশমিক ৮২ পয়েন্টে উন্নীত হয়। সর্বনিম্ন ছিল হাজার ৯০১ পয়েন্ট। ২০১৩ সালে হাজার ৪৭৩ দশমিক শূন্য পয়েন্ট নিয়ে সূচকের যাত্রা হয়। অন্যদিকে শরিয়াহ্ সূচক ডিএসইএস ১৮৯ পয়েন্ট বা ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে। বছর শেষে সূচকটি হাজার ৪৩১ দশমিক ১২ পয়েন্টে উন্নীত হয়। গত বছর সূচকটি সর্বোচ্চ হাজার ৬০০ দশমিক ২৬ পয়েন্টে উন্নীত হয়। সর্বনিম্ন ছিল হাজার ১৬৬ দশমিক ১৭ পয়েন্ট। ৯৪১ দশমিক ২৮ পয়েন্ট নিয়ে সূচকের যাত্রা শুরু হয়।

অন্যদিকে দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএসসিএক্স গত বছর হাজার ৪৮৬ দশমিক ৬০ পয়েন্ট বা ১২ শতাংশ বেড়ে ১৩ হাজার ৯১৩ পয়েন্টে এসেছে। যেখানে আগের বছর শেষে সূচকটির অবস্থান ছিল ১২ হাজার ৪২৭ পয়েন্টে। বছর শেষে সিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০২০ সালের তুলনায় এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন বেড়েছে ২৫ দশমিক শতাংশ। গত বছর এক্সচেঞ্জটিতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। যেখানে ২০২০ সালে গড় লেনদেন ছিল ২৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গড় লেনদেন বেড়েছে ১২৬ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন