এগারো বছরে ১০ বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

মূল্য সহনীয় রাখতে নীতিগত অস্বচ্ছতা ও অদক্ষতা দূর হোক

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। কিন্তু সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। বিদ্যুতের দাম ক্রমেই বাড়ছে। গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১০ বার। এতে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ আর খুচরা পর্যায়ে প্রায় ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে বলে খবর মিলছে। প্রতি বছর দেয়া ভর্তুকি বিবেচনায় নিলে বিদ্যুতের প্রকৃত দাম আরো বেশি হবে। বিদ্যুতের উচ্চমূল্য নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা হয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানানো হয়েছে। সম্প্রতি ক্যাবের এক ওয়েবিনারেও এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বক্তারা। উদ্বেগ যথার্থই। বিদ্যুৎ খাতে অদক্ষতা, অনিয়ম নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার কারণে বিদ্যুত খাতে আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছে ক্ষুদ্র একটি মহল, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহক। এর পরিবর্তন জরুরি।

ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া এবং শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জোগাতে ২০০৮-০৯ সালে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোয় জোর দেয়া হয়েছিল। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় চালু করা হয়েছিল অনেকগুলো তেলনির্ভর ভাড়াভিত্তিক দ্রত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন এটা ছিল সাময়িক ব্যবস্থাপনার অংশ। এজন্য ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করা হয়েছিল অসম চুক্তি। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে তাদের। এছাড়া আরো কিছু কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের আগে চাহিদার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমান চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। কিন্তু সক্ষমতা অনুপাতে বাড়েনি বিদ্যুতের চাহিদা। বর্তমানে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট মতো। বাকি সক্ষমতা অব্যবহূত থাকছে। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। তদুপরি ভর্তুকির বিষয় তো আছেই। প্রতি বছরই ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুৎ খাতে - হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এবার ভর্তুকি বাবদ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের খবর মিলছে। বলা চলে ক্যাপাসিটি চার্জ ভর্তুকি সমন্বয় করা হয়েছে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে। দেখা যাচ্ছে, একদিকে সরকারি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে, যার চূড়ান্ত ভার পড়ছে গ্রাহকের ওপর। শুরু থেকেই বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিলে, চাহিদা সঠিকভাবে নিরূপণ করে উৎপাদন বাড়ানো হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না; বরং আরো কম দামে ব্যক্তি পর্যায়ে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেত। কাজেই পরিকল্পনা নেয়ার  ক্ষেত্রে অদক্ষতা  যেমন স্পষ্টতেমনি নীতিগত অস্বচ্ছতার কারণে বিশেষ  কোনো  গোষ্ঠীকে সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে বৈকি।  

বিদ্যুতের দাম অনেকটা নির্ভর করে প্রাথমিক জ্বালানি মূল্যের ওপর। সংগতকারণে প্রায় সব দেশই দেশীয় উৎসের জ্বালানি প্রাপ্যতার নিরিখে বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা করেছে। কারণ তারা জানে আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সহনীয় দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন প্রভৃতি দেশ তাই টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করেছে। দেশীয় জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। যেজন্য জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুতের দাম আমাদের চেয়ে কম। এমনকি প্রতিবেশী ভারতও প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, পানিসম্পদ, সৌরশক্তিসহ দেশীয় জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এবং সুলভে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও কৌশল একসময় একই রকম ছিল। স্বল্পমূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে আমরা দীর্ঘ সময় অর্থনীতির চাকা স্বচ্ছন্দে চালু রেখেছি। ২০১০ সাল নাগাদ গ্যাস সংকট জ্বালানি খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর বেড়ে যায় নির্ভরতা। এর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা জারি রাখা হয়। এখনো আমদানিনির্ভরতা চলমান। প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা অন্য জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে খুব একটা গতি নেই। ফলে এলএনজি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেই এগোচ্ছে সরকার। আন্তর্জাতিক এলএনজি বাজারের উদ্বায়িতা প্রবল। আকস্মিক দাম ওঠানামা করে। এই বহিঃস্থ অভিঘাত মোকাবেলায় সমর্থ নয় আমাদের জ্বালানি খাত। উচ্চমূল্যে আমদানীকৃত এলএনজি দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সহনীয় দামে পৌঁছানো নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। কাজেই আমদানির পরিবর্তে দেশীয় উৎসের জ্বালানির ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে এক্ষেত্রে জুতসই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

ইতিবাচক বিষয় হলো, এক দশক আগেও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে কয়লা গুরুত্ব পেলেও এখন তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আসতে পারছে না। কারণে অনেক বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অন্যদিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের তাগিদে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার কমানোরও জোর দাবি উঠছে বিশ্বব্যাপী। বাস্তবতায় সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসছে বলে খবর মিলছে। এটা পরিবেশ সুরক্ষার জায়গা থেকে সুখবর বটে। কিন্তু কয়লা বিদ্যুৎ থেকে সরে আসার বিষয়টি সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে অযৌক্তিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মোটেই সম্পর্কযুক্ত নয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলেও চীন ভারত ২০৪০ সাল পর্যন্ত নিজস্ব কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখবে। তারা এটা করবে দেশীয় কয়লা দিয়ে। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। কাজেই এখানে মূল ইস্যু কয়লা নয়, বিদ্যুতের দাম। আমদানিনির্ভর কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ নিশ্চয়ই বেশি হবে। ফলে সুলভে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। দেশীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দাম পড়বে কম। কাজেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় জ্বালানির ওপর বেশি জোর দিতে হবে বৈকি, যাতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

উৎপাদনক্ষমতা বাড়লেও ফ্রিকোয়েন্সি ভোল্টেজ ওঠানামা, ঘন ঘন অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ খাতে একটি নিত্য সমস্যা। ফলে মানসম্মত বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহক। প্রেক্ষাপটে সরকার বিতরণ ব্যবস্থা সঞ্চালন অবকাঠামোয় গুরুত্ব দিয়েছে। গ্রিড সাবস্টিটিউশন, বিদ্যুৎ বিতরণে উপকেন্দ্র নির্মাণ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। বাবদ বছরও ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু এক্ষেত্রে কতটুকু সঞ্চালন লাইন দরকার, বিতরণ ব্যবস্থার কতটুকু উন্নতি প্রয়োজন, তার সঠিক চাহিদা নিরূপণ করা হয়নি বলে খবর মিলছে। একসময় কাজে লাগবে যুক্তিতে হাজার হাজার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে সঞ্চালন সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল অর্থ; যা সমন্বয় করা হচ্ছে পাইকারি খুচরা পর্যায়ে উপর্যুপরি দাম বাড়িয়ে। সঞ্চালন বিতরণ অবকাঠামোর উন্নয়নে আপাতভাবে লাভবান হচ্ছে  কোম্পানিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র তথা জনগণ। সুতরাং এক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।

বিদ্যুৎ খাতে দাম নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার বিইআরসির। আমরা দেখছি অনেক সময় সংস্থাটিকে পাশ কাটিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নামকাওয়াস্তে গণশুনানির আয়োজন করা হয়। শুনানিতে দাম বাড়ানোর পরিবর্তে দাম কমানোর পথ বাতলে দেয়া হয় ভোক্তা-গ্রাহকের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেসব পরামর্শ বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে; বরং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বারবারই বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এতে কমিশনের ভূমিকা এখতিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ। আজকে বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির সংকট প্রবল। জনস্বার্থ সুরক্ষা নয়, ব্যক্তি খাতের কিছু উদ্যোক্তার মুনাফার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ খাত; যার খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাসাধারণকে। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। খাতটিতে অযৌক্তিক মূল্য নিয়ন্ত্রণ, সুশাসন জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করে ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষায় সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন