ধনী দেশগুলো শুধু নিজের স্বার্থ দেখলে বিশ্বের মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না

. আহমেদ মুশফিক মোবারক অর্থনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের কলেজ পার্ক ক্যাম্পাস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা উদ্যোগ ওয়াই-রাইজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। সম্পৃক্ত রয়েছেন ইনোভেশনস ফর পভার্টি অ্যাকশন (আইপিএ), জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব (জি-পাল) এবং ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের (আইজিসি) সঙ্গে। উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। আহমেদ মুশফিক মোবারক করোনা মহামারী, মাস্কের ব্যবহার, দরিদ্র, কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলার চিন্তাটা কীভাবে এল?

কভিড-১৯ মহামারী শেষ করতে সবার জন্য টিকার প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু করতে কয়েক মাস বা বছর লেগে যাবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, যেখানে টিকা পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগবে। এরই মধ্যে মহামারী শেষ হচ্ছে না। ভারতের শহরগুলোয় আমরা দেখলাম তারা বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে গত দুই মাস। মহামারী যদি শহর থেকে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামগুলোয় পৌঁছে তখন পরিস্থিতির ভয়াবহতার মাত্রা বর্তমানকে ছাড়িয়ে যাবে। বিপজ্জনক পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মাস্ক ব্যবহার করতে উদ্যোগী করছি। যেটাকে সিডিসি বলে নন-ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্টারভেনশনস। মাস্ক পরা, শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলামহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোধে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

 

মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস নিয়ে আপনারা একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন। এটি সম্পর্কে পাঠকদের অবগত করবেন?

সাধারণ মানুষদের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাসটা তৈরি করা খুব সহজ নয়। শুধু মাস্ক পরিধান নয়, যেকোনো ধরনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে যাওয়াটা কঠিন। ভারতের গ্রামের মানুষদের টয়লেট ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি যেমন সহজ নয়, তেমনি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষদের রাতারাতি উন্নত চুলা ব্যবহার করানোর কাজটিও কিছুটা কঠিন। তাই তাদের নতুন অভ্যাস তৈরি করতে হলে খুব সতর্কভাবে কৌশলের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সেই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিওস ইনোভেশন ফর প্রোভার্টি অ্যাকশন (আইপিএ) গ্রিন ভয়েসের একটি দল বাংলাদেশ সরকারের এটুআই কর্মসূচি এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে মিলে দেশের সর্বত্র সব জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে কী করা যায়, তা বের করার উদ্যোগ নিই। গতবছর এক জরিপের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ৯৫ শতাংশ মানুষ বলছে তারা মাস্ক পরছে। আমরা জানতে চেষ্টা করলাম। আমাদের হিসাবে মাস্ক ব্যবহারের হার নেমে এল ৮০ শতাংশে। এরপর আমরা দেশের বিভিন্ন গ্রামে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মীদের দায়িত্ব দিই। দেখা গেল ৩০ শতাংশের মতো মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে। এরপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ কৌশল ব্যবহার করে নিশ্চিত হলাম, আসলে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের হার মাত্র ১২-১৩ শতাংশের মতো। 

 

মাস্ক পরার অভ্যাস গড়তে কী পদক্ষেপ নিলেন?

দেশের ৬০০টি গ্রামে সাড়ে তিন লাখ মানুষের ওপর ১০ সপ্তাহ ধরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা দেখেছি যে কীভাবে মাস্ক পরার অভ্যাসটি পরিবর্তন করা যায়। সাড়ে তিন লাখ লোকের ওপর আমরা ১৫ থেকে ২০টা পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখেছি। আমরা সমন্বিতভাবে শুধু চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে মাস্ক ব্যবহারের হার অনেক বেড়ে যায় এবং স্থায়ী হয়। দশ সপ্তাহ ধরে আমরা মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করি। প্রথমত, একটা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিনা মূল্যে মাস্ক পৌঁছে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত. কাজটি করার সময় আমরা তাদের সঙ্গে কিছু তথ্যও শেয়ার করি। তাদের সচেতনতা তৈরির জন্য লিফলেট, ব্রুশিয়ার দিয়ে তাদের দেখাই যে মাস্ক পরা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আমরা যে ভিডিওটা তৈরি করেছি, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বার্তা ছিল। আরো ছিল ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ইমাম ট্রেনিং একাডেমির পরিচালকের বার্তা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নেয়া হয়েছে এবং তাদের সহায়তায় মানুষকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, মসজিদের ইমাম। তাদের সঙ্গে কথা বলার কারণ হচ্ছে, মসজিদে সবাই যখন নামাজের সময় একত্র হয় তখন খুব কাছাকাছি দাঁড়ানো হলে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্য আমাদের কর্মীরা গ্রামের মসজিদগুলোয় জুমার নামাজের সময় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের মাস্ক বিতরণ করেছে। এছাড়া আমরা আগে থেকে ইমাম সাহেবদের হাতে -সম্পর্কিত একটা লিখিত কাগজ দিয়ে দিয়েছিলাম। যার আলোকে কিছু বিষয় তারা খুতবার সময় তুলে ধরেন। গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের সঙ্গেও আমরা আগে থেকে কথা বলে নিয়েছি। লোকেরা যখন শুনেছে কর্মীরা চেয়ারম্যান বা মেম্বারের পক্ষ থেকে তাদের বাড়িতে গেছে তখন তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কাজগুলো করার পর আমরা আবার ওই গ্রামে গেছি। প্রথম দিকে সপ্তাহে তিনদিন। এর পরের সপ্তাহে দুদিন। তারপর একদিন। চতুর্থত. আমাদের মাস্ক প্রমোটররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। যদি কোনো রিকশাচালক বা অন্য ব্যক্তি মাস্ক ছাড়া চলাচল করেছেন, তাদের তারা মাস্ক ব্যবহারের কথা বলেছেন। কারো কাছে মাস্ক না থাকলে আবার তাকে সরবরাহ করা হয়েছে।

গবেষণায় কী ফল পেলেন?

চতুর্থ পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা দেখেছি মাস্ক পরার হার তিন গুণ বেড়েছে। আমরা ট্রায়াল ভিত্তিতে কাজগুলো করেছি আর তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক ছিলাম। এসব কৌশল একসঙ্গে প্রয়োগ করে দেখা গেল মাস্ক পরার হার ১০-১২ শতাংশ বেড়ে গেছে। এরপর আমরা আরেকটি কৌশল যোগ করি। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্মীরা লোকজনকে মাস্ক পরার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে শুরু করলেন। কেউ মাস্ক না পরলে তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বলা হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথাও জানানো হয়। মাস্ক না থাকলে বাড়ি থেকে তা আনা, বাড়ি বেশি দূরে হলে তাকে আরেকটি মাস্ক দেয়াএভাবে অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এতে দেখা গেল মাস্ক পরার হার ৪৫ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। মোট ১০ সপ্তাহের গবেষণার শেষ তিন সপ্তাহ আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করিনি। তখনো দেখেছি মাস্ক পরার হার বেড়ে ৪৫ শতাংশের মতো দাঁড়িয়েছে।

 

মাস্ক পরার কারণে কি করোনার প্রভাব কমেছে?

গবেষণায় দেখা গেছে, আগে থেকে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি থাকা দেশগুলোয় সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম। কোথাও কোথাও মাস্ক পড়ার সঙ্গে শারীরিক দুরত্বও মেনে চলা হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কোন বিষয় ভূমিকা রাখছে সেটি দেখতেই বাংলাদেশ মাস্ক পড়ার গবেষণা শুরু করি। তথ্যগুলো আমরা এখন সংগ্রহ করছি। স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল স্কুল আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আমরা ফোন করে জানছি কারো কোনো উপসর্গ তৈরি হয়েছে কিনা। যাদের মধ্যে উপসর্গ পাওয়া গেছে তাদের বাড়িতে একজন পেশাদার চিকিৎসকের সঙ্গে গিয়ে আমরা তাদের রক্ত পরীক্ষা করছি। এটাকে বলে সেরোপ্যারোলেন্স স্টাডি। ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আইসিডিডিআর,বির সহায়তায় কাজগুলো হচ্ছে। আমাদের কাজ এখনো চলছে।

 

কী কারণে সবাইকে মাস্ক পরার বিষয়ে বলছেন?

ভারতে যে সংকটটা আমরা দেখলাম, বাংলাদেশ বা অন্য কোথাও সংকট যেন তৈরি না হয়। সংক্রমণ যেন বেড়ে না যায়, সেজন্য আমরা সবাইকে মাস্ক পরার কথা বলছি। তাছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে ব্লাড স্যাম্পল আর সেরোপ্যারোলেন্স জরিপ চালানোর আগেও বৈজ্ঞানিকভাবে এটি প্রমাণিত যে মাস্ক পরলে সংক্রমণ কম হয়। কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা কত শতাংশ মানুষকে মাস্ক পরার আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি এবং সংক্রমণের হার কতটা কমেছে দুটো মিলিয়ে আমরা একটা হিসাব করছি।

মাস্ক পরলে জীবন বাঁচে, অর্থনীতিও গতিশীল হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউন চলাকালে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়, তা জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ১০ শতাংশের সমান। অন্যদিকে লকডাউনে সেই ক্ষতির তুলনায় মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যয় হয় ১৮ ভাগের ভাগ।  জীবন নাকি জীবিকা-এটি নিয়ে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা গেলে লকডাউন প্রয়োজন হয় না। এতে জীবন জীবিকা উভয়ই রক্ষা পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সমন্বিত উপায়ে মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার হার ২৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। এটা অন্যান্য এলাকার তুলনায় শতাংশ বেশি। মূলত নিয়মিত নজরদারি পর্যবেক্ষণের কারণে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়।

 

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে পাওয়া গেছে অবস্থায় আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি। গত দুই মাসে ভারতে মহামারীর বড় ধরনের প্রভাব আমরা দেখেছি। ওই একই ভ্যারিয়েন্ট আর একই অবস্থা এখন নেপালে। গত এক বছর কিন্তু নেপালের অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে হঠাৎ ভারতে সংক্রমণ হওয়ার কারণে এখন নেপালেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা যে মডেলটির কথা বলছি, তা এখন নেপালেও প্রয়োগ করা হবে। ওদের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমরা কাজ করছি। নেপালের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের খুব সতর্ক থাকা উচিত। তাছাড়া করোনা এমন একটা জটিল ভাইরাস যে সবাই টিকা না পাওয়া পর্যন্ত অসতর্ক হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য মাস্ক বিতরণ -বিষয়ক প্রচারণা খুব প্রয়োজনীয়। আমরা যদি ১৬ কোটি মানুষকে কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে চাই, সেক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাকের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। এনওআরএম বা নর্ম; নো কস্ট মাস্ক ডিস্ট্রিবিউশন (এন), অফারিং ইনফরমেশন (), রিএনফোর্সমেন্ট (আর) এবং মডেলিং বা রোল মডেলিং (এম), মডেলের ওপর ভিত্তি করে ব্র্যাক একটি কর্মসূচি তৈরি করেছে। সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে মডেলটা আমরা দেশের ৩৫টি জেলায় প্রয়োগ করব। যেখানে সংক্রমণের হার বেশি, সেসব জেলাকেই আমরা তালিকাভুক্ত করেছি। ৩৫টি জেলায় প্রায় আট কোটি লোকের বসবাস। আমাদের মূল গবেষক দল আর ব্র্যাক মিলে কাজটি করছে। সারা দেশে ব্র্যাকের নেটওয়ার্ক আছে, তারাই কাজগুলো করছে। তাদের অংশগ্রহণ এখানে অনেক। ইতিবাচক বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, যেখানে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি কাজ করা সম্ভব। কারণ সরকার এখানে সহায়তা করে। তবে সরকারের অংশগ্রহণ যদি আরো খানিকটা বেশি হতো তাহলে কাজটা আরো ভালো করে করা সম্ভব হতো। যেমন আমরা আট কোটি লোকের কাছে মাস্ক পৌঁছাতে চাই। এত মাস্ক কিন্তু ব্র্যাকের হাতে নেই। আছে দেড় বা দুই কোটি। বাকি যে ছয় কোটি মাস্কের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে সরকার সহযোগিতা করতে পারে। তাছাড়া বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকেও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তাদের প্রতি আমার অংশগ্রহণের অনুরোধ থাকবে। ছয় কোটি মাস্কের ঘাটতি মেটাতে সক্ষম হলে কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা কার্যকরভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হব।

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ অনুসরণীয় ছিল। কিন্তু কভিডের কারণে অনেকে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। উদীয়মান চ্যালেঞ্জটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

বিশ্বের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলো মিলিয়ে প্রায় ১৫টি দেশে আমরা এক বছর ধরে বিভিন্ন গবেষণা করেছি। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে কভিডের প্রভাব দেখতে আমরা সঠিকভাবে বিভিন্ন দেশের তথ্য একত্র করে জানার চেষ্টা করেছি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা দেখেছি কভিড স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে আসলেও এটি এখন অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। কভিডের কারণে মানুষের আয়, কর্মসংস্থান, কাজের সুযোগ, খাদ্যনিরাপত্তা কমে গেছে। ১৯৯৭ সালের এশিয়ার আর্থিক সংকট বা ২০০৮-এর বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়গুলোয়ও আমরা এতটা খারাপ পরিস্থিতি অবলোকন করিনি। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি গভীর। মাস্ক পরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে আমরা যদি ভাইরাসের প্রভাব কমিয়ে আনতে পারি তাহলে দরিদ্র মানুষকেও আর্থিক নিরাপত্তা দেয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে তার নাগরিকদের কাছে সাহায্য পৌঁছানো প্রয়োজন। তাছাড়া বৈশ্বিক দায়িত্বও রয়েছে। যদি একটা দেশে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে সারা পৃথিবীতে এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিলঅনেক জায়গায় নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, এমন একটা ভ্যারিয়েন্ট এল, যেটার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তেমন কার্যকরী নয়। আমরা সৌভাগ্যবান যে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসেনি। আমরা যদি মহামারী নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়, তাহলে এর প্রভাবটা কয়েক বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। যদিও আমেরিকা তাদের বেশির ভাগ লোককে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে বাইরের বিশ্বের এত বেশি যোগাযোগ যে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট খুব সহজে এখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য আমার মনে হয়, যারা বৈশ্বিক নেতা, বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের ওপর বিশ্ব অনেক নির্ভর করেছে, যারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছে, ভ্যাকসিন বিকাশ বণ্টনেও তারা এগিয়ে রয়েছে। দেশগুলোসহ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় মহামারী নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ধনী দেশগুলো যদি শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে তাহলে সারা পৃথিবীর মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। 

 

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র মানুষদের কাছে কীভাবে আরো কার্যকরভাবে সাহায্য পৌঁছানো যায়?

প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অর্থনীতিবিদরা একে টার্গেটিং বলি। ধরা যাক, হঠাৎ কোনো সংকট তৈরি হলো, তখন দেশব্যাপী দরিদ্র মানুষদের কাছে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সহায়তা পাঠানো হয়তো সম্ভব নয়। এজন্য টার্গেটিংয়ের প্রয়োজন। যেমন কোন ধরনের পরিবারের ওপর সংকটের মাত্রাটা বেশি, তাদের চিহ্নিত করে খুব তাড়াতাড়ি তাদের হাতে অর্থ পৌঁছানো। সেটার জন্য আগে থেকে একটা অবকাঠামো তৈরি করতে হয়। যেমন আমেরিকায় সবাই প্রত্যেক বছর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়। রিটার্ন জমা দেয়ার পরিমাণ দেখে তারা বুঝতে পারে কার আয় কম, কার বেশি। সেভাবে টার্গেটিং করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবস্থা নেই। মাত্র থেকে শতাংশ মানুষ নিয়মিত ট্যাক্স দেয়। ভারত যেমন জন ধন য়োজনা নামে একটা অবকাঠামো তৈরি করেছে। এর অধীনে যে রাজ্যগুলোয় তারা ডিজিটাল আইডির মাধ্যমে বরাদ্দ বণ্টন করেছে, সেখানে দুর্নীতিও কমে গেছে। ধরনের অবকাঠামো বাংলাদেশেও করা প্রয়োজন। ডিজিটাল অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু হুট করে এমন একটি অবকাঠামো করা সম্ভব নয়। তবে গত বছর থেকে সরকারের সঙ্গে সেলফোন অপারেটরদের নিয়ে আমরা একটা কাজ করছি যে কীভাবে সেলফোন ব্যবহার থেকে মানুষের আর্থিক অবস্থা চিহ্নিত করা যায়। আলাদা করে দেশব্যাপী ১৬ কোটি মানুষের তথ্য আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ১৬ কোটির মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ লোকই বাংলাদেশে সেলফোন ব্যবহার করে। বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আফগানিস্তান রুয়ান্ডার ওপর ধরনের একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে মুঠোফোন ব্যবহারের প্যাটার্ন দেখে আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। আমরাও এভাবে টার্গেটিং করে একটি তালিকা তৈরি করতে পারি। গত বছর থেকে আমরা সে চেষ্টা করছি, এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছি। শিগগিরই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা আশা করছি আগামী বছরের মধ্যে একটি পদ্ধতি দাঁড় করাতে সক্ষম হব।

 

করোনায় কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় কী বলে মনে করেন?

আমাদের কাছে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত কিছু তথ্য আছে, যেমন কভিডের কারণে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ লোক তাদের কাজ হারানোর কথা বলছে। এছাড়া প্রায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ বলছে তাদের আয় কমে যাওয়ার কথা। আমাদের তথ্যমতে আরো একটা বিষয় আমরা পেয়েছি তা হচ্ছে, যে পরিবারগুলো অভিবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ক্ষতির মাত্রা কিছুটা বেশি। অভ্যন্তরীণ হোক বা বিদেশী অভিবাসী আয়দুটো ক্ষেত্রেই। শুরুর দিকে মহামারী বাংলাদেশ পর্যন্ত না এলেও বিভিন্ন দেশে এখানের যেসব অভিবাসী আছেন, তাদের পরিবারগুলোয় কিন্তু মহামারীর প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। কারণে নীতিগতভাবে একটা পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। যেহেতু আমাদের দেশ রেমিট্যান্সের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কয়েক বছর আগেও জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অংশ ছিল ১০ শতাংশ। এখন হয়তো তা থেকে শতাংশ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে হবে যে মহামারীর কারণে দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের তারা যেন আবারো কাজে নেয়। অবস্থায় আমাদের প্রধান কাজ হলো মহামারী নিয়ন্ত্রণ। ভারতের অভিজ্ঞতায় আমরা যেমন দেখেছি মহামারী যদি আবার ফেরত আসে এবং লকডাউন করে দেয়া হয় তাহলে কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেও লাভ হবে না। মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে এমনিতেই কাজ বেড়ে যাবে। সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব হলো মাস্ক ভ্যাকসিন সরবরাহ করা। আর অবশ্যই সারা দেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি গ্রহণ।

 

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী ধরনের পলিসি গ্রহণ করা উচিত?

বাংলাদেশকে যেন ভারতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়এটাই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত। যারা অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজ করেন তাদের ঘাড়ের ওপর যদি লকডাউন পড়ে তাহলে সে পরিবারগুলোয় খাদ্যের অভাব বেড়ে যায়। সে ব্যাপারে আমাদের একটু মনোযোগ রাখা উচিত। লকডাউন হয়তো প্রয়োজন কিন্তু আমরা যদি মাস্ক বিতরণ মাস্ক-বিষয়ক প্রচারণার কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারলে লকডাউনের ব্যাপ্তি কমানো সম্ভব। যেসব কাজ ঘরে বসে করা যায়, সেগুলো বাইরে গিয়ে না করা। তাছাড়া সমাবেশ বা সবাই একত্র হয়ে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার মতো কাজগুলো থেকে বিরত থাকা। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো দুই ভাগে ভাগ করে সে অনুযায়ী কাজ করা। মাস্ক সরবরাহ করা, -সম্পর্কিত প্রচারণা বাড়ানো, যাতে সংক্রমণ কম হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ভ্যাকসিন এনে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে। তাহলে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।

 

আমরা দেখছি কিছু মানুষ করোনার টিকা গ্রহণে অনাগ্রহী। এক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?

বাংলাদেশে কিন্তু টিকা নেয়ার একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা যদি ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে দেখি তাহলে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এগিয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অতীতে যখন এমএমআর ভ্যাকসিন দেয়া হলো তখন কিন্তু দেশব্যাপী টিকা দিতে আমরা খুবই সফল হয়েছি। সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে দেশব্যাপী কাজগুলো করেছে। টিকা ঘিরে আমাদের জনগণের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব আছে। তবে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অতীতের মতো আবারো সে ধরনের একটা পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন। এতে ভ্যাকসিন নিয়ে যদি কারো কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে তা কেটে যাবে। ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা এমন কিছু দেশের তালিকা আমরা তৈরি করেছি। আমাদের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, নিম্নমধ্যবিত্ত দেশের তুলনায় উন্নত দেশগুলোয় টিকা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগার পরিমাণ বেশি। রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। এর পরে রয়েছে আমেরিকা। আমেরিকার শেষ ৩০ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনার বিষয়টি অনেক কঠিন হয়ে গেছে। বাংলাদেশ, ভারত নেপালে কিন্তু সমস্যাটি এত বড় আকারে নেই। জরিপের তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ লোকই টিকা নিতে রাজি। কিন্তু জনগোষ্ঠীকে যদি সুবিধাজনকভাবে আমরা টিকা পৌঁছে দিতে না পারি তাহলে টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে না। এটাকে সম্ভব করার দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও।

 

কভিড পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের সম্পদ বেড়েছে। বিপরীতে অনেকে নতুন দরিদ্র হয়েছে।

হ্যাঁ, বিশ্বব্যাপী বৈষম্য বেড়ে গেছে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি আমার ধারণার কথা বলতে পারি। আমেরিকায় দেখা গেছে, কভিডের কারণে সরাসরি লেনদেন কমে গেছে, এর বদলে ডিজিটালি লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। অনলাইনে খাবার অর্ডার দেয়া বা কেনাকাটার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধরনের ব্যবসা যারা পরিচালনা করছেন তারা লাভবান হয়েছেন। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগগুলোর তুলনায় এখন বড় বড় ব্যবসার লাভ বেশি হচ্ছে। এসব কারণে বৈশ্বিক বৈষম্যের পরিমাণ বেড়েছে।

 

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে?

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অবদানের কথাটি আমাদের সাক্ষাৎকারে ঘুরেফিরে অনেকবার উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ এগিয়ে নিতে অনেকটা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এতে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব তখন এনজিওগুলো এখন যে ধরনের তহবিল পায়, সেখানে কিছু পরিবর্তন হবে। বিদেশ থেকে যে তহবিল আসে, যার সূত্রে গ্রামীণ অঞ্চলগুলোয় উন্নয়নমূলক কাজ হয়, সেগুলো কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। তাই পর্যায়ে গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রম ঘিরে সরকারের পক্ষ থেকে চিন্তা থাকতে হবে। সরকারের বাজেট থেকে বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা বা নিজ থেকে অথবা এনজিওর মাধ্যমে কাজগুলো করার বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের এনজিওগুলো যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। সেটি কাজে লাগানো উচিত।

 

শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন