ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় ও বরণকৃত্য

পাভেল পার্থ

ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচয় মুছতে থাকলেও এখনো এক এক ঋতু সাজে এক এক উৎসব আর মেলার আয়োজনে। অঞ্চল জাতিভেদেও ঋতুভিত্তিক আচার-রীতিগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলাদেশে বর্ষবরণ বর্ষবিদায়ের কৃত্য আচারগুলো সব ক্ষেত্রেই উৎসবমুখরতা তৈরি করে। পাশাপাশি বর্ষবিদায় বর্ষবরণকে ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি, গাজন, চড়ক কি বৈশাখী মেলা। বাংলা বছরকে ঘিরে বাঙালি সমাজে চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা, নববর্ষ যেমন বাংলার জন-উৎসব, তেমনি দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজে বর্ষবিদায় বরণের কৃত্যগুলোও জন-উৎসবে রূপ নেয়। অঞ্চল জাতিভেদে বর্ষবিদায় বরণ উৎসবের নামগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সমতলের কোচ হাজং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বর্ষবিদায় বরণ উৎসবকেবিহুবলেন। ভাওয়াল মধুপুরগড়ের বর্মণ কোচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা সন্যাসী পূজা, গাজন, চড়ক পূজার মাধ্যমে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা উৎসবকে বলেন বিষু। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অনেকেই সময় পালন করে দণ্ডবর্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা বর্ষবিদায় বরণের উৎসবকে বলে বিজু। মারমারা বলে সাংগ্রাই। রাখাইনদের ভাষায় সাংগ্রেং। ত্রিপুরারা বলে বৈসু বা বৈসুক, কোথাও বুইসুক। গুর্খা অহমিয়ারা বলে বিহু। তঞ্চঙ্গারা বলে বিষু। ম্রোরা উৎসবের নাম দিয়েছে চানক্রান। চাক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা উৎসবকে বলে সাংগ্রাইং। খিয়াং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অনেকেই উৎসবকে সাংলান বলে।

নীলকণ্ঠ দুধ-উদলানো কৃত্য

নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের বাগদী সমাজ চৈত্রসংক্রান্তির দিন নীলকণ্ঠ পূজা করে। বৈশাখের প্রথম দিনে গোয়ালঘরে আয়োজন করেদুধ-উদলানোকৃত্য। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে সেই দুধ গোয়ালঘরের মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। বছরের প্রথম দিনে এভাবেই ভূমি জননীকে দুধ দিয়ে নতুন বার্তা বয়ে আনার আহ্বান জানায় বাগদী সমাজ, যাতে বছরজুড়ে গোয়াল ভরা সুস্থ দুধেল গরু থাকে, সংসারের আয়রোজগার ভালো হয়, সংসারের মঙ্গল হয়।

হাজরা আম-ছাতুয়া

রবিদাসদের ভেতর হাজরা নামের এক কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্র স্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সঙ্গে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। সময় ঢোল, খাজরি, ঝাল বাজানো হয়। রবিদাসদের ভেতর সময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়।

ছাতাপরব পাতাপরব

ছাতাপরব পাতাপরবের ভেতর দিয়ে আয়োজিত হয় সাঁওতালদের বর্ষবিদায় বর্ষবরণ পর্ব। চৈত্রসংক্রান্তিতে সাঁওতালরা পাতা উৎসব পালন করে। এটাকে অৗচুর পাতাও বলে।অৗচুরশব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ঘোরানো। চড়ক পূজার বড়শি ঘুরানো যেমন করে হয়। সময় বাড়ির সব গাছের গোড়ায় নতুন মাটি তুলে দিতে হয়। নতুন বছর যেন ফুলে-ফলে-শস্য-ফসলে ভরপুর থাকে গাছগাছালি এই মানতে। বর্ষবিদায় বরণের কৃত্য হিসেবে মুণ্ডারা গ্রাম পূজা হিসেবে পালন করে মুড়ই পূজা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটা খুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতা শাক খায়। সাঁওতালদের বছর শুরু হয় ফৗগুন (ফাল্গুন) মাসে। আর মাসেই আয়োজিত হয় বর্ষবরণের উৎসব বাহা। বাহাকে তাই সাঁওতালি ভাষায়হড়’-দেরনাওয়া সেরমা পরবমানেসাঁওতালদের বর্ষবরণ উৎসববুঝায়। বাহা পরব দু-চারদিন জুড়ে হয়, পরবের প্রথম দিনকে উম দ্বিতীয় দিনকে বাহা সৗরদি দিন বলে।

বিজু

বিজুই চাকমাদের সবচেয়ে বড় আয়োজনের সামাজিক উৎসব। ফুল বিজু, মূল বিজু গয্যাপয্যা দিনতিন পর্বে বিভক্ত বিজু শুরু হয় ২৯ চৈত্র। পাহাড়-টিলা-বন গ্রাম ঘুরে ঘুরে এদিনে শিশু, কিশোর বালিকারা সংগ্রহ করেন নানা পদের ফুল। ভাতজরা ফুল বা বেই ফুল ছাড়া বিজু জমে না। ভাতজরা ফুল বিজুর সময়ে ফোটে বলে অনেকে একে বিজু ফুলও বলে। ফুল বিজুর দিনে সবাই সকাল সকাল স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে নেয়। স্নানের সময় ডুব দিলে বিজুগুলা নামের সুস্বাদু ফল পাওয়া যেতে পারে আশায় কেউই স্নানের জন্য দেরি করে না। সংগৃহীত ফুল নদী বা ছড়ার পাড়ে পূজা করে জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ঘরবাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ফুল বিজুর দিন থেকে পরবর্তী সাতদিন চাকমারা ঘরের দরজা, ঘরের খুঁটি বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে রাখে। ফুল বিজুর পরদিনই শুরু হয় মূল বিজু। এদিনে চাকমা বাড়িতে বাড়িতে নানা পদের রান্না হয়। এসবের ভেতর বিজুর পাজোন বা এক ধরনের মিশ্র সবজি হলো সবার কাঙ্ক্ষিত খাবার। পাজানোর তরিতরকারি খুঁজতে জঙ্গলে যাওয়াকে চাকমা ভাষায় বলেতোনতগা যানা সান্যা পিঠা, বিনি পিঠা, বিনি হগা, বড়া পিঠা বানানো হয় ঘরে ঘরে। খবরক, গ্যাল­, লংকাপোড়া বিনি, কালাবিনি, লালবিনির মতো নানা জুমধান থেকে তৈরি করা জগরা, কানজি দোয়াচুয়ানির আনন্দিত আসর জমে ওঠে। চাকমারা নববর্ষের দিনকে গয্যাপয্যা বলে মানে আরাম আয়েশ, গড়াগড়ি করে কাটানোর দিন। নারীরা এদিন মালোকখীমার উদ্দেশে ভাত উৎসর্গ করেন। বিজুর সময় চাকমা গ্রামে গ্রামে গেংখুলীরা উভোগীত, রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাং ছড়া পালাসহ নানা পালাগানের আয়োজন করে।

বৈসুক

ত্রিপুরাদের ভেতর বৈসুক পালিত হয় ত্রিপুরাব্দের তাল­াং মাসের ৩০ তারিখে। এদিনই ত্রিপুরা বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছিল। সময় ত্রিপুরারা কর্ম প্রেমের দেবতা গড়িয়ার আরাধনা করে গড়িয়া নাচের ভেতর দিয়ে। পূর্বজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পালিত হয় পারিবারিক কৃত্য। ছড়া বা নদীর স্রোতে প্রদীপ ভাসিয়ে অবিবাহিত ত্রিপুরা মেয়েরা পালন করে সিমতুং পূজা।

বিষু

তঞ্চঙ্গগারা ফুল বিষু, মূল বিষু গয্যাপয্যা বিষুতিনদিনে পালন করে বর্ণাঢ্য বিষু। বিষুর দিনে তঞ্চঙ্গারা বিনি চালের গুঁড়া দুধের তৈরি মু পিঠা বানায় বাড়িতে বাড়িতে। অনেকেই বিজু-বিষুর দিনে ক্যাঙ বা বৌদ্ধমন্দিরে খাদ্য উপঢৌকন দান করে।

সাংগ্রাইং

বর্ষবিদায় বরণের উৎসবকে মারমারা বলে সাংগ্রাই। মারমারাও প্রায় তিনদিন ধরেই পালন করে সাংগ্রাই। মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের মতোই কিছুুটা নামের মিল আছে চাকদের বর্ষবিদায় বরণ উৎসবের। সাংগ্রাইং উৎসবের প্রথম দিনকে চাকরা বলে পাইংছোয়েত বা ফুল দিন। চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখর হয়ে ওঠে। পাইংছোয়েতর দিন গ্রামে গ্রামে আয়োজিত হয় পেকো (গিলা), গ্যাং (লাটিম), মাইকানিকছা (কানামাছি) নামের নানা চাক খেলা। সাংগ্রাইংয়ের দ্বিতীয় দিন হলো আক্যাই। এদিনে পাড়ার যুবসম্প্রদায় বাইক (ঢোল), লাংহোয়াক (ঝাঁজ) হ্নে (বাঁশি) বাজিয়ে ক্যাং বা বৌদ্ধমন্দিরে যায় আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য। সাংগ্রাইংয়ের শেষ দিনকে চাকরা বলে আপ্যাইং। নববর্ষের এদিন বাড়ি বাড়ি নানা পদের রান্না হয়। নিমন্ত্রণ খায় মানুষ এবাড়ি-ওবাড়ি। গৌতম বুদ্ধের পূজা-অর্চনার ভেতর দিয়ে আনন্দমুখর আয়োজনে খিয়াংরা পালন করে সাংলান উৎসব।

বর্ষবিদায় বর্ষবরণকে ঘিরে মূলত চৈত্রসংক্রান্তিতেই গ্রামজনপদে মেলা আয়োজনের আদি চল। গাজীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তে যেখানেই চড়ক পূজা আয়োজিত হয় সেখানেই এখনো মেলার আয়োজন ঘটে। বিশেষত চা বাগান এলাকাগুলোতে এসব মেলার আয়োজন স্থানিক স্বতঃস্ফূর্ত। এসব মেলা কোনো কোনোটি একদিন স্থায়ী হয়, কোনোটি চলে দিনকয়েক, কোনোটিবা ১৫ দিন কি এক মাস। তবে চলতি সময়ে বর্ষবিদায় বরণ ঘিরে আয়োজিত মেলাগুলোর স্থায়িত্ব খুব কম এলাকায় এক মাস গড়ায়। অঞ্চলভেদে এসব মেলায় আগে ভিন্ন ভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ফলফলারি, বীজ, পঞ্জিকা পাওয়া গেলেও এখন দেশের প্রায় সব এলাকার মেলাই একাকার হয়ে গেছে। যেন বহুজাতিক বিশ্বায়িত দুনিয়ার বাণিজ্য বাহাদুরি। সব মেলাতেই এখন প্রায় একই ধরনের সস্তা প্লাস্টিক পণ্য করপোরেট পানীয় পাওয়া যায়। হাওর অঞ্চলে চৈত্র মাসে আয়োজিত মেলাগুলোবান্নিবাবারুণীহিসেবে পরিচিত। সোমেশ্বরীর মেলা, হোমাই ঠাকুরের মেলা, পণাতীর্থ, লেংটার মেলা, শারপীনের মেলা। এসব মেলা আখ, ক্ষীরা, বেল, খই-দইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন এসব মেলায় প্যাকেটজাত পণ্য থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের কার্ড পর্যন্ত পাওয়া যায়। রাজশাহীর পবা নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় স্থানীয়ভাবে নির্মিত মুখা বা মুখোশ পাওয়া যেত। এখন খুব কম। লোহার জিনিস, মাটির জিনিসের পাশাপাশি খই, মুড়ি, চিঁড়া, নকুলদানা, কদমা, বাতাসা, জিলাপি, কটকটি, মুরালি আর রঙিন কাচের চুড়িসহ হরেক রকম পুঁতির মালা ছিল এসব মেলার প্রাণ। বেদে নারীরা মেলায় চুড়ি মালা বিক্রি করত। চড়ক আর বৈশাখী মেলাতেই বেশি বিক্রি হতো বেদে নারীদের নিজস্ব সংগৃহীত মুক্তা মুক্তার নাকফুল কি মালা। আর মেলে পঞ্জিকা, পুথি, পাচালি, নামাজ শিক্ষা, স্ত্রী শিক্ষা, লতাপাতার গুণ, ব্রতকথাসহ নানা সস্তা পুস্তিকা। এসব দোকানে পাওয়া যায় কাঠের মালা, তুলসী মালা, চন্দন, আবির, শাঁখা-সিঁদুর, তিলকমাটি, নীলমাটি। রাষ্ট্র বহুদিন বাদে বহু বিতর্ককে জিইয়ে রেখেক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০তৈরি করেছে। ওই আইনে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগণের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কি বাঙালি সবার বর্ষব্যাপী উৎসব মেলাকেই সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বর্ষবিদায় বরণকে ঘিরে এসব উৎসব মেলা আয়োজনের সঙ্গে কেবল বিশ্বাস বিনোদন নয়, জড়িয়ে আছে জনপদের উৎপাদন সম্পর্কের রাজনীতি অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি। নতুন বছরে দেশের সব জনপদের কৃত্য উৎসবের প্রতি রাষ্ট্র সম-উদ্যোগী হবেএই প্রার্থনা।

পাভেল পার্থ: গবেষক লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন