সৈয়দ আবুল মকসুদ ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

দুজন শক্তিশালী মানুষের কথা

আনু মুহাম্মদ

করোনাকালে গত মাসে পরপর দুদিন আমরা এমন দুজন প্রিয় মানুষকে হারালাম, যাঁদের ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এঁরা হলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। প্রথমজন পেশাগতভাবে ছিলেন সাংবাদিক আর দ্বিতীয়জন ছিলেন ব্যাংকার।

সৈয়দ আবুল মকসুদকে চিনতাম তাঁর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসসের কর্মজীবন থেকে। বাসস অফিসের নিচেই ছিল আমাদের লেখক শিবির-সংস্কৃতি-গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট অফিস। প্রায়ই দেখা হতো আসা-যাওয়ার পথে কিংবা নিচে, কখনো কখনো তিনি ঢুঁ মারতেনআমাদের সঙ্গে বসতেন, কথা বলতেন। ততদিনে তিনি মওলানা ভাসানী নিয়ে তাঁর বিশাল কাজ প্রকাশ করেছেন। ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রায় ৯০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেটা ছিল তাঁর এক বড় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন, কারণ শুধু ভাসানী নন, বাংলাদেশের ইতিহাস বুঝতেও গ্রন্থ এক জরুরি সূত্র হিসেবে বিশেষভাবে সহায়তা করবে। সরকারি বার্তা সংস্থায় কাজ করলেও মকসুদ ভাই সাংবাদিক গবেষক-সত্তা বিসর্জন দেননি। তিনি সংবাদপত্রে কলামও লিখতেন। হুমায়ুন আজাদের ওপর ফ্যাসিবাদী হামলা নিয়ে লেখার কারণে তিনি তত্কালীন সরকারের বিরাগভাজন হন। লেখা বন্ধ করার চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে তিনি বাসসের নিশ্চিত পেশাগত জীবন ত্যাগ করেন। এরপর তিনি একদিকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কলাম লেখা অন্যদিকে গবেষণাকাজে পূর্ণ মনোযোগ দেন।

২০০৩ সালে ইরাকে ভয়ংকর মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে যে মার্কিন আগ্রাসন গণহত্যা পরিচালিত হয়, তার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর জীবনের আরেক পর্বে প্রবেশ করেন। এই আগ্রাসন গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি পোশাক হিসেবে শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে সাদা চাদর গ্রহণ করেন। তিনি জানান যে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই পোশাক দিয়েই তিনি প্রতিবাদ জারি রাখবেন, যতদিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থাকবে ততদিন তিনি আর পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরবেন না। আগ্রাসন বন্ধ হয়নি, পোশাকও পাল্টায়নি, পোশাকেই তিনি চলে গেলেন প্রতিবাদসহ। আর সময় থেকেই আবুল মকসুদ লেখালেখি গবেষণার পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় সরব হন। সে কারণে তাঁর সঙ্গে এর পর থেকে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে।

২০০৬ সালে ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থানের সময়ে মকসুদ ভাই আমাদের সঙ্গে ঘটনাস্থলেই ছিলেন। আন্দোলনসহ  তার পর থেকে সুন্দরবন আন্দোলন পর্যন্ত জাতীয় কমিটির কর্মসূচিতে তিনি প্রায় নিয়মিতই যোগ দিয়েছেন। বিষয়ে তাঁর কোনো দ্বিধা বা ক্লান্তি দেখিনি। লং মার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছেন, তাগিদও দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সমাজ রাষ্ট্রে সব রকম অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি বরাবর সরব ছিলেন। কখনো কখনো তিনি একা হলেও প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ধারাবাহিক উপস্থিতি ভূমিকার কারণে তিনি এক প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। তবে জনসমস্যা সমাধানের তাগিদে তিনি অনেক সময় এমনসব লোকদের সঙ্গে বসতেন, যা নিয়ে আমি আপত্তি করতাম। তবে এগুলো তাঁর মূল ভূমিকাকে কখনো পথচ্যুত করেনি।


প্রতিবাদী নাগরিক নেতা হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ যতটা পরিচিতি পেয়েছেন, লেখক-গবেষক হিসেবে ততটা পাননি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও তাঁর কাজ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বেশ কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থ আছে তাঁর, যা তিনি করেছেন নিজ তাগিদ থেকে। এর বাইরে তাঁর সুলিখিত কলামগুলো সময়কে বোঝার জন্য খুবই দরকার হবে। এসব কলামে তাঁর রসবোধ, তথ্যনির্ভরতা, ইতিহাসচেতনা পুরো বিষয়কে পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলত। তিনি আরো অনেক কাজ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, করতে পারতেন, প্রয়োজন ছিল। শারীরিকভাবেও তিনি সক্ষম ছিলেন, তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া আমাদের জন্য বিস্ময়কর এবং বড় আঘাত।   

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আশির দশকের শেষে বা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কোনো এক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সেমিনারে যোগ দিতে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়। তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে করোনাকালে, আমার এক পিএইচডি শিক্ষার্থীর থিসিসের বহিঃস্থ শিক্ষক হওয়ার অনুরোধ জানাতে গিয়ে। এর মধ্যে বিভিন্ন সেমিনার আলোচনা সভায় তাঁর সঙ্গে দেখা কথা হয়েছে। কথা কাজের মধ্য দিয়ে তিনি আরো অনেকের সঙ্গে আমারও আস্থা অর্জন করেছিলেন। একই কারণে ক্ষমতাবানদের বিরক্তিভাজন হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থকরী খাত বর্তমান সময়ে দুর্বৃত্তদের সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার। ব্যাংক শেয়ারবাজার এমনসব উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দৃশ্যমান অদৃশ্য শক্তির থাবার মধ্যে যে তার থেকে উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে সত্য উচ্চারণের জন্য খাতের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। খালেদ ভাই ছিলেন সেই বিরল মানুষ, যিনি নিজের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে বারবার বিপদসংকেত দিয়েছেন। সরকার তাঁর কথা শোনেনি কিন্তু এসব কথা সময়ের অর্থনীতির দুর্বৃত্ত অপকর্ম বুঝতে সবাইকে সহায়তা করবে।     

আশির দশক থেকেই বাংলাদেশে ঋণখেলাপিদের দাপট শুরু হয়েছে। এর পর থেকে বিভিন্ন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের লোভ এবং ক্ষমতা ক্রমে বেড়েছে। আর গত এক দশকে তাদের আগ্রাসন বেড়েছে অভূতপূর্ব মাত্রায়, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরো অনুকূল হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের অন্যতম শিকার, এর সঙ্গে গড়ে ওঠা একের পর এক বেসরকারি ব্যাংক এবং অর্থকরী প্রতিষ্ঠান তাদের অনেকের অপকর্মের মাধ্যম। এখন শুধু ঋণ নিয়ে মেরে দেয়া নয়, পুরো ব্যাংক লোপাট করাই পুরনো-নতুন চোরাই কোটিপতিদের বাসনা। আর তারাই এখন বাংলাদেশের বড় কর্তা। অর্থনীতির প্রয়োজন বিবেচনা না করে একের পর এক বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, ঋণখেলাপিদের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা বিধিমালা প্রণয়ন, তদারকির সমস্যা, ব্যাংক জালিয়াতি বিষয়ে শৈথিল্য ইত্যাদি অর্থনীতিকে ক্রমাগত ফুটা করতে থাকলেও বোধগম্য কারণে সরকার এসব পরিবর্তনে কোনো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেনি। অর্থকরী খাতে দীর্ঘদিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করে সেই অভিজ্ঞতা আর দায়িত্ববোধ থেকে এসবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ফুটা করে অর্থ পাচারের অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে। এর খবর দেশের নয়, বিদেশী পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পেরেছি। দেশে খবর জানাজানি হলেও আসলে কত পরিমাণ পাচার হয়েছে, কারা এর জন্য দায়ী, সেসব বিষয় সরকারিভাবে কখনো প্রকাশ করা হয়নি। ফিলিপাইনে পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির বিচার শাস্তি হয়েছে প্রকাশ্য শুনানি বিচারের প্রক্রিয়ায়। আর যে দেশের সম্পদ পাচার হলো, যে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অরক্ষিত হয়ে পড়ল, সেখানে না কোনো শুনানি হলো, না কোনো সরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল . ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে। তা প্রকাশ করা হয়নি। আসল হোতাদের বিপদের ঝুঁকি থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়তো এই ধামাচাপা ব্যবস্থা।

একই অভিজ্ঞতা হলো শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও। ১৯৯৬ সালের পর ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস হয়েছিল। কত লাখ মানুষ এজন্য পথে বসেছে, তার হিসাব সরকার করেনি। ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে অনেক পরিশ্রম করে সেই রিপোর্ট জমা দেন কিন্তু তা আর প্রকাশিত হয়নি। বোঝা যায়, সেখানে আসল দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করার কারণেই তা সিন্দুকে আটকে রাখা হয়েছে। লুণ্ঠন পাচার চলবে কিন্তু তা নিয়ে কেউ কিছু জানতে পারবে না, বলতে পারবে নাএই হলো পরিস্থিতি। শেয়ারবাজার, ব্যাংকসহ অর্থকরী খাতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তাই সরকারের বিভিন্ন শাখার সক্রিয়তার জুড়ি পাওয়া কঠিন। 

তবে খালেদ ভাই হাল ছাড়েননি। তিনি যতটুকু সম্ভব বলেই গেছেন। ব্যাংকসহ অর্থকরী খাত ঠিক করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন অনেক, সরকারি নীতি গেছে উল্টো দিকে। তাঁর বলা লেখাগুলো সংকলন করলে সময়ের অর্থকরী খাতের চেহারা অনেকখানি পরিষ্কার হবে। তাঁর মৃত্যুতে কঠিন সত্য বলার একজন শক্তিশালী মানুষকে আমরা হারালাম।

যে সময় প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞজনদের অধিকাংশ লোভ আর লাভের খোপে মাথা গুঁজে রেখেছেন, সে সময় দুজনের মৃত্যু আমাদের সবার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।   

 

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সদস্য সচিব, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন