রূপান্তরের রূপকথা

আব্দুল বায়েস

এক।

দৃশ্যপট গ্রামবাংলা।

পা ফেলেই যেন ধাঁধাঁয় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কৈশোরে পাঠ্যপুস্তকে পড়া কিংবা দুই-তিন যুগের আগের দেখা গ্রাম আর বর্তমান গ্রামের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য। এই গ্রাম তো ঠিক সেই গ্রাম নয়। পানির কলকল ধ্বনি, বর্ষার জলে টইটুম্বুর নদী পুকুর, পাখির কলরব, সারি সারি ছনের ঘর, কুপির টিমটিমে আলো ইত্যাদি তেমন আর আজকাল চোখ পড়ে না।আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে এখন ভরাট হয়ে সোজাসুজি চলছে। মাঠের ধুলা-বালিতে গড়াগড়ি, গাছের ডাল থেকে দুঃসাহসিক লাফ, পুকুরে দাপাদাপি পানির খেলায় মেতে ওঠারমহোত্সব আগের মতো মূর্তিমান নেই; ঐতিহ্যবাহী হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট এমনকি এক্কা-দোক্কা খেলা আধুনিকতার ধাক্কায় যেন কুপোকাত। পতিত জমিতে পাজামা, পাঞ্জাবি টুপি পরা মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা খালি গায়ে একদল শিশু ক্রিকেট খেলছে। গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে যাত্রা, পালা, জারিগান পুথিপাঠ। আর নেবেই না কেন, আজকাল টিভি মোবাইল ফোন উপহার দিচ্ছে ডিসকো গান ধুমধাড়াকা সিনেমা এবং সম্ভবত সেই আফসোস থেকে এই গান গাওয়া:

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া জারিগান আর মুর্শিদি গাইতাম।।

সুতরাং, সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য বলি, প্রথাগত গ্রামের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেখা গ্রামগুলো যে অনেকটা বেখাপ্পা বেমানান সে কথা বলা বাহুল্য। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে প্রত্যাশা প্রাপ্তির এই ব্যবধান আরো একটু পরিষ্কার করে বোঝানো যেতে পারে। দুই দশক আগে কষ্টেসৃষ্টে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে বড়জোর উপজেলা সদর পর্যন্ত যাওয়া যেত; এখন পিচঢালা মসৃণ পথে মোটরগাড়িতে বেশকিছু গ্রামে সরাসরি যাওয়া যায়চাই কি বাড়ির আঙিনায়। আজকাল গ্রামে ছনের ঘরের সংখ্যা ব্যাপক কমে আসছে আর কুপির বাতি বিদায়ের প্রহর গুনছে। এমনকি অতীতের মতো নাকে-মুখে রুমাল গুঁজে গ্রামে ঢুকতে হয় না। প্রতিটি গ্রামের ৬০-৭০ শতাংশ ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং প্রায় প্রতিটি ঘরের জন্য সুপেয় পানির বন্দোবস্ত আছে। বসতবাটি যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার একটা তাগিদ আমাদের চোখ এড়াল না।স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’—এমন পরিবেশ যেন সবার কাম্য। অনেক খানায় বিদ্যুত্ সংযোগ এসে গেছে এবং সেই সূত্রে টিভি ফ্রিজ; অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের ঘরে রঙিন টিভি দামি ফার্নিচার। যেখানে বিদ্যুত্ পৌঁছতে পারেনি (যেমন চরাঞ্চল দুর্গম গ্রাম), সেখানে সোলার প্যানেল লাগিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। তবে টিভি ডিশ উন্নত জীবন-মানের বাহক হলেও অভিযোগ আছে যে সিনেমা, নাটক সিরিয়াল কিশোর-কিশোরীদের খোলা মাঠের খেলা কেড়ে নিচ্ছে। টিভির দোষ দিয়েই বা লাভ কি? গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলার জায়গাগুলোতে গড়ে উঠেছে বসতি, নার্সারি কিংবা ফসলের আবাদ।একশ বিঘার মাঠটাই এই গ্রামের একমাত্র সম্বল’—শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেখা সেই গ্রাম আজকাল কেউ দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। ইদানীং গ্রামে নাটক খুব একটা হয় না। তবে গ্রামের জীবন নানা নাটকীয়তায় ভরা। চলুন তাহলে এমন কয়েকটা নাটকীয় ঘটনার কথা শুনি।


দুই।
দুই দশক আগেও দোকান বলতে গ্রামের কোনো ছোট একটা ঘরে চাল-ডাল, নুন আর তেলের পসরা। অথচ ইদানীং এসে আমাদের দেখা গ্রামগুলোতে গড়পড়তা চার-পাঁচটি দোকান এবং সেই সাথে কোথাও টিভি ফ্রিজ। চা, চানাচুর, চিপস, সাবান প্রসাধনি, আইসক্রিম, কোমল পানীয় এমনকি প্রক্রিয়াজাত মসলা দেদার বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় হাটবাজারের অবস্থা আরো উন্নত এবং শহরের প্রায় সব দ্রব্য ওইসব দোকানে পাওয়া যায়। নাটকীয়তা এসে গেছে দরিদ্রের জীবনেও। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর একদা যে দিনমজুর সন্ধ্যার পরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিত, সে এখন চা, পান সিগারেট সাথে করে মধ্যরাত পর্যন্ত গ্রামের বা হাটের দোকানে টিভির সামনে বসে থাকে। কোথাও আবার দোকানের এক কোণে ক্যারম বোর্ড পাতা আছেমাঝে মাঝে দিনমজুর, যুবক শ্রেণী বেকার পয়সার বিনিময়ে খেলে কিংবা অন্যের খেলা প্রাণভরে উপভোগ করে। রোনালদো, নাইমার, মেসি, শচীন টেন্ডুলকার এখন গ্রামে খুব পরিচিত নাম; খুব দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরাও তরতর করে নাম বলে যেন ওরা ওদেরই সহপাঠী। এমনি করে দুই দশক আগে অচেনা, অজানা পুরো বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ এখন গ্রামে থাকা ওই ছোট দোকানঘরটিতে এক নিমিষে উপস্থিত হয়। সুতরাং কে বলবে এই গ্রাম সেই গ্রাম? স্বভাবতই রবীন্দ্র, শরত্ যুগ এমনকি সত্তরের দশকের গ্রাম ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে শহরভিত্তিক উন্নয়নের ছিটেফোঁটা রাস্তাঘাট বাজারের বদৌলতে গ্রাম-গ্রামান্তর উপচে পড়ছে (ট্রিকল ডাউন); এক কালের বিচ্ছিন্ন বিযুক্ত গ্রাম শহরের কিঞ্চিত রূপ ধারণ করে চলেছে। এই সংযুক্তির সুযোগে খোলা জানালা দিয়ে যেমন নির্মল বায়ু প্রবেশ করছে তেমনি ঢুকছে মশা-মাছি।


তিন। 

মুখ-ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রি থেকে মনে হলো যে গ্রামের আর্থসামাজিক রূপান্তর গল্পের নায়কের নামনয়া ধান, যা সচরাচর সুধী সমাজে সবুজ বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। বিশেষত সেচের সুবিধা আছে এমন অঞ্চলের গ্রামগুলোতে জমি, লিঙ্গ শিক্ষা ভেদে আবালবৃদ্ধবনিতা উফশী (উচ্চফলনশীল) বানয়া ধান-এর জয়গান উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এর পেছনে একটি মাত্র কারণ হলো, শুষ্ক মৌসুমে এইনয়া ধান গ্রামবাংলায় নবদিগন্তের সূচনা করেছে বলে তারা মনে করে। সবুজ বিপ্লবের চাদরে ঢাকা সেচ সারনির্ভর উফশী ধান আসার আগে এসব গ্রামের কৃষিজমি ছিল প্রধানত এক ফসলি; খাদ্য জোগানের একমাত্র উপায় ছিল সনাতন জাতের ধান। সবুজ বিপ্লব তথা উফশীর ঢেউয়ে এখন সেই ধান ভেসে গেছে। দু-একটা গ্রাম ছাড়া এক সময়ের প্রভাবশালী আউশ ধানের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না; বোনা আমন ধান নিশ্চিতভাবে জাদুঘরে।

উফশী থেকে হাইব্রিড ধানহাইওয়ে টু ফুড সিকিউরিটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হাইব্রিড ধানের চাল মোটা ভাত স্বাদহীননিন্দুকের এমনতরো মনমরা মন্তব্য কৃষক এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়।নিন্দুকের কথায় গুলি মারি। বিঘাপ্রতি ৩০ মণ ধান কি যা-তা কথা?’ সুতরাং ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া, অর্থাত্ পেটে দে মা খেয়ে বাঁচিএই হলো বর্তমান অবস্থা। কৃষক এও জানে, এক সময় চীন থেকে এই বীজ আসত বলে ভয়ে মনটা চিনচিনে ছিল; এখন বাংলাদেশেই হাইব্রিড বীজ উত্পন্ন হয় এবং এর বাজারও ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। সুতরাং নো চিন্তা ডু হাইব্রিড। এমনি করে এক সময়ে ম্যালথুসিয়ান দুঃস্বপ্নের দুয়ারে এবং দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি থাকা গ্রামগুলো তীব্র খাদ্য সংকট থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পেয়ে এখনআউট অব দ্য শ্যাডো অব ফেমিন!’ অতএব, নায়করাজ নয়া ধান নমস্য।

তবে ইদানীং খাদ্যনিরাপত্তাজনিত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা পুষ্টিহীনতা নিয়ে গ্রামবাসীর যুক্তি অনেকটা রকম: এক সময় পেট পুরে ভাত খাওয়া ছিল প্রথম প্রার্থনা; পুষ্টি তথা ভারসাম্য খাদ্যতালিকা তখন বিলাসিতা মাত্র। সময়ের বিবর্তনে ভাতের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে বলে আজকাল ভাতের থালায় যিকঞ্চিত মাছ, ডাল, শাকসবজি এমনকি কালভদ্রে মাংস ডিম থাকে। গ্রামের মানুষ খুব সোজা-সরল প্রকৃতির যারা খাদ্যনিরাপত্তার খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। শুধু এটুকু বোঝে যে নায়করাজ উফশী ধান বা হাইব্রিড তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে। সুতরাং তোরা যে যা ভাবিস ভাই, আমরা অন্তত না খেয়ে নাই।

চার।

সিনেমা কিংবা নাটকে নায়ক একা লড়াই করে নাহোক তা নায়িকাকে কাছে পাওয়া, কোনো বস্তি দখলমুক্ত করা কিংবা অপহূত শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়ার কাজে। নায়কের পাশে থেকে শক্তি জোগায় এক বা একাধিক পার্শ্বনায়ক। ওরাল হিস্ট্রি থেকে মনে হলো নায়ক সবুজ বিপ্লবের পার্শ্বনায়ক হচ্ছে অবকাঠামো যথা: পাকা রাস্তা, সেতু, স্কুল, বিদ্যুত্ সেচ সুবিধা। আমাদের দেখা গ্রাম যে সুদূর অতীতের সেই গ্রাম নয়, তার প্রধান কারণ রাস্তাঘাট বিদ্যুত্ আসার ফলে গ্রামের চেহারা একদম পালটে গেছে।কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননীসম্ভবত ঠিক সেইঅপরূপ রূপে পল্লী জননী আজকাল আর ধরা দেয় না:

সে কাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মাঠের বুক চিরিয়া রেললাইন পড়িয়াছে। তার পাশে টেলিগ্রাফ তারের খুঁটির সারি। বিদ্যুত্ শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠোপথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে মোটর বাস ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া খাল কাটা হইয়াছে। লোকে হুক্কা ছাড়িয়া বিড়ি সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো কাপড়ের বদলে বড় বড় ছোকরারা জামা, লম্বা কাপড় পরিয়া সভ্য হইয়াছে। -আনা দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। ভদ্র গৃহস্থের হাল-চাল বদলাইয়াছে (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইকমল)

কথিত পার্শ্বনায়ক রাস্তাঘাট পাকা, সুপ্রশস্ত সুবিন্যস্ত হওয়ার ফলে গ্রাম-শহর দূরত্ব দ্রুত কমেছে এবং বেড়েছে অভিবাসন। ফলে উত্পাদন উপকরণ বিনিময় সহজ ব্যয়সাশ্রয়ী হতে পেরেছে; গ্রামে না হলে শহরে গিয়ে অন্নের সংস্থান করা যাচ্ছে; কৃষি, শিক্ষা স্বাস্থ্য সম্প্রসারণ এমনকি এনজিওর উপস্থিতি ত্বরান্বিত হয়েছে। সুতরাং কেউ বলতেই পারে:

কি কেবলই সড়ক! একটা নতুন জীবনেরও রাস্তাসুখ আর সমৃদ্ধির। রাস্তা দিয়া তরিতরকারি যায় এমনকি থানকুনিপাতা এখানে বনে বাদাড়ে আজন্ম জন্মায় কেহ ফিরিয়াও দেখে না শহরে তাহাতেও পয়সা। ধীরে ধীরে গ্রামের সব বস্তুই শহরমুখী হয়। অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে; গ্রাম-শহর দৌড়াদৌড়ি লেগে যায় (শামসুদ্দিন আবুল কালাম, পথ জানা নেই)

নায়কের ওপর মহানায়ক থাকে। গ্রামের রূপান্তরের প্রধান রূপকার যে সরকার, কথাটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওরাল হিস্ট্রিতে উঠে আসে। বলা যেতে পারে, সরকার হচ্ছেমহানায়ক কিংবা গ্রামীণ রূপান্তর নাটকের পরিচালক। সরকার না থাকলে নায়ক পার্শ্বনায়ক আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারত কিনা কিংবা কতটুকু রাখতে পারত তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে এরা যে সরকার নামক পরিচালকের সৃষ্টি তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

পাঁচ।
কান টানলে যেমন মাথা আসে এবং মায়ের প্রসঙ্গে মাসি, তেমনি কৃষিনির্ভর গ্রামের রূপান্তর ব্যাখ্যায় কৃষি কাঠামোর কথা না এসে পারে না। সত্তরের দশকে এবং বোধ করি এরও অনেক আগ থেকে, বিদ্যমান কৃষি কাঠামো নিয়ে বিতর্ক বিদগ্ধ মহলের চায়ের কাপে ঝড় তুলত। সেই সময় ধরে নেয়া হয়েছিল যে জমির মালিকানায় বিরাজমান বৈষম্য কৃষি উন্নয়নে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে, যাকে বলে ভিলেন অব প্রগ্রেস; বৈষম্য দারিদ্র্যের বাহক হিসেবে কাজ করবে বিদ্যমান সমাজ শ্রেণী কাঠামো। বস্তুত এই যুক্তি সামনে রেখে আদি সমালোচকরা বলতেন যে সবুজ বিপ্লব ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব বানাবে। একদিকে থাকবে ফুলে-ফেঁপে ওঠা তথাকথিতজমিদার শ্রেণী অন্যদিকে প্রান্তিকতার তীরে পৌঁছবে ভূমিহীন দরিদ্র খানাগোষ্ঠী। শেষমেশ দিশেহারা হয়ে এবং মূলত ঋণ নিয়ে খাদ্যের অভাব মোচানোর জন্য শেষোক্ত গোষ্ঠী প্রথমোক্ত গোষ্ঠীর কাছে শেষ সম্বল জমিটুকু সমর্পণে বাধ্য হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলবে: ‘শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে। পরিণতিতে শুরু হবে শ্রেণী সংগ্রাম, যে সংগ্রামের পথ বেয়ে সবুজ বিপ্লবলাল বিপ্লবের রূপ নেয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অতএব, আদি সমালোচকরা মনে করতেন বৈপ্লবিক বা পুনর্বণ্টিত ভূমি সংস্কার ব্যতীত উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে।

এখনো বেঁচে আছে কী করেএই ধাঁধাঁর উত্তর দিতে গেলে আয় উত্সারণে জমির ভূমিকা দেখতে হবে। আমাদের সবার মনে থাকার কথা যে এক সময় খানার মোট আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসত জমিভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে। অথচ আজকাল আসে এক-তৃতীয়াংশেরও কম। নায়করাজ উফশীর কল্যাণে কম জমি দিয়ে খাদ্য ঘাটতি পূরণ হচ্ছে আর তারাই পাশাপাশি থেকে পার্শ্বনায়ক অবকাঠামো এনজিও খামারবহির্ভূত কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। ধনী কিংবা দরিদ্র, কেউই আর আজকাল জমিতে জেঁকে বসে নেই। বড় মাঝারি চাষী উদ্বৃত্ত হস্তান্তর করছে অধিক লাভজনক অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে এবং তাদের জমি বর্গায় চাষ করছে কৃষি শ্রমিক বা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন। দরিদ্র শ্রেণী একদিকে বর্গায় জমি চাষ করে, অন্যদিকে ফাঁকে ফাঁকে অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে ঢুকে পড়ে নতুবা মৌসুমি অভিবাসন ঘটায়। হাতেগোনা দু-একটা গ্রাম ছাড়া অন্য সব গ্রামে খানার মোট আয়ের সিংহভাগ আসে অকৃষি থেকে। শুধু তা- নয়, একদিকে বর্গাবাজার বিস্তৃত হচ্ছে, অন্যদিকে বর্গার শর্ত নমনীয় হতে চলেছে বিধায় এক সময়ের অদক্ষ শোষনমূলক ভাগ চাষ প্রথার জায়গা দখল করে নিচ্ছে অধিকতর দক্ষ বাজারমুখী নির্দিষ্ট খাজনা, লিজ, বন্ধক পদ্ধতি। অর্থাত্, আজকাল বর্গা চাষে অংশীদারিত্বমূলক ঝুঁকি গ্রহণের চেয়ে এককভাবে ঝুঁকি নিয়ে কৃষক বর্গা জমি চাষ থেকে আয় বাড়ানোর মতোরিজিলেন্স খুঁজে পেয়েছে।

প্রত্যেক সিনেমা, নাটক বা গল্পে ভিলেন (খলনায়ক) থাকে। গ্রামীণ বিবর্তন গল্পের বেলায়ও তা যে ব্যতিক্রম নয়, সে কথাটা ওরাল হিস্ট্রি থেকে অকপটে বেরিয়ে এল। নায়কের ভূমিকা যদি হয়ে থাকে মানুষের মুখে ভাত দেয়া, ভিলেনের ভূমিকা সেই গ্রাসটুকু কেড়ে নেয়া। আমাদের কথিত গল্পের নায়ক পার্শ্বনায়ক যথাক্রমে উফশী ধান অবকাঠামো খাদ্যের জোগান এনটাইটেলমেন্ট বৃদ্ধি করতে যখন ব্রতী, ঠিক সেই মুহূর্তে ভিলেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামবাসী এমন কিছু ভিলেনের কথা জানাল, যাদের কারণে তারা আরো বেশিউন্নত/‘ভাল সুখী জীবন থেকে বঞ্চিত থাকছে বলে মনে করে।

শুরুতে বলেছি যে ভারতের স্বাধীনতা লাভের শুভক্ষণটিতে মাহাত্মা গান্ধী অবস্থান করছিলেন দিল্লি থেকে বহুদূরেনোয়াখালীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখান থেকে নতুন শাসকদের কাছে পাঠালেন শুভেচ্ছা এবং তার সাথে একটা সতর্কবাণী: ভারতের উন্নয়ন গ্রামের তথা গ্রামের মানুষের উন্নতি ছাড়া সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব সাহিত্যকর্ম গ্রামকেন্দ্রিক। আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’—সে তো গ্রামেরই মাটিতে মাথা ঠেকানোর আবেদন। গ্রামের জীবন কৃষি তথা কৃষকের উন্নয়নে তিনি কখনো ছিলেন দার্শনিক, পরামর্শক, কখনো অ্যাক্টিভিস্ট। শুধু গ্রামের মানুষের জন্য তিনি কৃষি ব্যাংক কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষিকে আধুনিকীকরণে তার চেয়ে বড় প্রবক্তা কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। কৃষক তথা কৃষি উন্নয়নে এবং সার্বিক অর্থে গ্রামোন্নয়নে তিনি জোর দিয়েছিলেন মূলত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কৃষিঋণ সমবায়ের ওপর। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি শামসুর রাহমানের সাড়া জাগানো অন্যতম কবিতাও অনেকটা একই সুর আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয়—‘স্বাধীনতা তুমি: 

ফসলের মাঠে কৃষকের গান
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার
------------------
বাগানের ঘর, কোকিলের গান
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা
-------------------- 

সুতরাং স্বাধীনতা মানে গ্রামের তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তি; স্বাধীনতা মানে গ্রামোন্নয়ন, অন্যথায় স্বাধীনতা অর্থহীন। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূলএই আপ্ত বাক্যটি ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য, দেশের বেলায়ও তেমন সত্য, দেশের স্বাস্থ্য মানে গ্রামের অর্থনীতির স্বাস্থ্য। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো শুধু এই অর্থে ঘটে যাওয়া বিবর্তন ইতিবাচক মনে হলেও আসলে তো গ্রাম এখনো অবহেলিত। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এখনো দরিদ্র। কৃষি বড় অর্থে গ্রামের ইতিবাচক পরিবর্তন গ্রামের দরিদ্র মানুষের সাস্থ্য পুষ্টি উন্নয়নে তেমন প্রভাব রাখতে পারেনি। এখনো দেশের পাঁচ বছরের নিচে শিশুর ৩৬ শতাংশ খর্বকায়, জনগণের ১৫ শতাংশ অপুষ্টিতে ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাচ্ছে, সন্তানসম্ভবা নারীদের ৪০ শতাংশ এনেমিক এবং শুরুতেই বলেছি, খোলা জানালা দিয়ে নির্মল বায়ুর পাশাপাশি মশামাছি ঢুকছে।

তার পরও গ্রাম আমার গ্রাম। মহামারী করোনাকালে একমাত্র কৃষি শুরু থেকে অদ্যাবধি খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। এখন ঢাকামুখী অভিবাসনের বিপরীতে মানুষ ছুটছে গ্রামের দিকে।

বলা বাহুল্য, প্রকৃত গ্রামোন্নয়ন দেখতে হলে আমাদের পথ হাঁটতে হবে আরো বহুদূর লং ওয়ে টু গো।

গ্রামোন্নয়নের গালগল্প শেষ করে গ্রাম থেকে আমরা ফিরে আসি শঙ্কার শহরে, যে শহরেরইতিকথা গ্রামের মতো নয়: ‘ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা। এখানে আকাশ নেই, এখানে বাতাস নেইএখানে অন্ধ গলির নরকে মুক্তির আকুলতা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন