আলোকপাত

রেলওয়ের ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটি ঝুলে আছে কেন?

ড. মইনুল ইসলাম

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দৈর্ঘ্য মাত্র ১৫০ মাইল অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দৈর্ঘ্য ২১৩ মাইল। আমরা অনেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া হয়ে ২১৩ মাইলের অস্বাভাবিক ঘুরপথের আসল ঐতিহাসিক কারণটি হয়তো উপলব্ধি করি না। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক ভারতে রেলপথ স্থাপন করা হয়েছিল ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তাই আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয়েছিল চট্টগ্রামে এবং সিলেট আসামের অন্যান্য এলাকার শত শত চা-বাগানের উৎপাদিত চা যাতে ওই রেলওয়ের মাধ্যমে সহজে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিবাহিত হয়ে রফতানি করা যায়, সেটাই ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার প্রধান অর্থনৈতিক যুক্তি। সেজন্যই চট্টগ্রাম থেকে বর্তমান রেললাইনটি আখাউড়া হয়ে সিলেট আসামে চলে গেছে। আখাউড়া থেকে ঢাকা যাওয়া আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ওই ঔপনিবেশিক রেলপথ স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল না কিংবা রাজস্ব আহরণের প্রধান সূত্রও বিবেচিত হয়নি। কারণ প্রতিষ্ঠাকালে যাত্রী পরিবহন ওই রেলপথের রাজস্বের মূলসূত্র ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান হওয়ার সময় তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি চা বাগান ভারতের আসাম পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। তবুও পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চা রফতানি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের চা রফতানির একমাত্র নিলাম হতো চট্টগ্রামে, এখন শ্রীমঙ্গলে নিলামের প্রধান অংশটা স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে চা রফতানিও অনেক হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা পূর্ব বাংলা-পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার পর পণ্য পরিবহনের চেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী পরিবহন অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। আর এখন তো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহনের জনপ্রিয় ব্যয়সাশ্রয়ী মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ৭৩ বছর এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের ৪৯ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো আমাদের কোনো সরকার এই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ৬৩ মাইল ঘুরপথ বাদ দিয়ে লাকসাম বা কুমিল্লা থেকে দাউদকান্দি নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথকে মাত্র ১৫০ মাইলে নামিয়ে আনার মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি আজও শুরু করতে পারেনি।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, বিশ শতকের আশির দশকে ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব বর্তমান ২১৩ মাইল থেকে ৬৩ মাইল কমিয়ে ১৫০ মাইলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা প্রকল্প (ফিজিবিলিটি স্টাডি) সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর কী রহস্যজনক কারণে প্রকল্প কোল্ড স্টোরেজে চলে গিয়েছিল, তা জানা যায়নি। অথচ ৬৩ মাইল ঘুরে আখাউড়া-ভৈরব হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার কারণে প্রতিটি ট্রেনের যে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে, তার ফলে ট্রেন যাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং প্রতিজন প্যাসেঞ্জারের সময়ের অপচয় আয়ুক্ষয়ের ব্যাপারটি গত ৩০ বছরে কত হাজার কোটি টাকা গচ্ছার ইতিহাস রচনা করেছে, সেটা কারো বিবেচনায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল না! রেলওয়ে বিভাগ সরকারের আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়ার পর সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ২০১৫ সালের একটি ঘোষণায় আমরা জানলাম যে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনের পরিবর্তে দাউদকান্দি হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা সরাসরি রেললাইন স্থাপনের মাধ্যমে ওই ৬৩ মাইল দূরত্ব কমিয়ে আনা হবে। মন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে তারিখ ঘোষণা করলেন যে পরবর্তী বছরের মধ্যেই ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তিনি যেহেতু লাকসাম-কুমিল্লার সন্তান, তাই আমাদের মধ্যে আশা জেগেছিল যে এবার হয়তো সত্যি সত্যিই তার আগ্রহে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্প সম্পন্ন হলে সত্যিকার অর্থে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হবে। নিমাণাধীন পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হবে। ঢাকা নগরীর মেট্রোরেলের সঙ্গে ঢাকা-কুমিল্লা রেলপথ এবং দক্ষিণাঞ্চলের রেলপথ যুক্ত করে দেয়া হলে সারা দেশে রেল নেটওয়ার্ক একটা আধুনিক যুগে প্রবেশ করবে। দুঃখজনক হলো, ওই ঘোষণার পর আরো প্রায় পৌনে চার বছর পার হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা-কুমিল্লা রেলপথ প্রকল্পের আর কোনো অগ্রগতির খবর জানা যায়নি। অথচ ওই চার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন এগিয়ে চলেছে। এমনকি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মতো লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মহাবিপজ্জনক মেগা প্রকল্পের কাজও সোৎসাহে বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দায়িত্ব গ্রহণের পর পৌনে দুই বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, কিন্তু ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পটি এখনো শুরু করার কোনো আয়োজন চোখে পড়ছে না!

  পরিপ্রেক্ষিতে নীতিপ্রণেতাদের কয়েকটি অত্যাসন্ন বাস্তবতাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। রেলওয়ের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখন এতখানি অগ্রসর হয়েছে যে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে শুধু মিটার গেজ ট্রেন চালাতে হবে এমন ধারণা এখন অচল হয়ে গেছে। সারা দেশে ব্রড গেজ রেলপথ স্থাপনের প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য। আগামী দেড়-দুই দশকের মধ্যে বিশ্ব থেকে ক্রমেই মিটার গেজ ট্রেন বাতিল হয়ে যাবে, তখন দেশের সব রেলপথকেই ক্রমে ব্রড গেজ ট্রেন চালানোর উপযোগী করে রূপান্তর করে ফেলতে হবে। অতএব, প্রস্তাবিত ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইনটি শুরু থেকেই ব্রড গেজ রেলপথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রেলপথকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর করার কাজটি শুরু করলে পুরো ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ব্রড গেজ ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। এমনকি একটু দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়ে এই ১৫০ মাইলের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ইলেকট্রিক ব্রড গেজ ট্রেন চালানোর প্রকল্প গ্রহণ করা সমীচীন মনে করি, তাহলে আড়াই ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়া সম্ভব হবে। সারা দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন হতে চলেছে। অতএব, সারা দেশে ক্রমান্বয়ে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করার ব্যাপারটিও এখন আমাদের চিন্তার জগতে চলে আসা উচিত।

আমি অতীতেও বেশ কয়েকবার লিখেছি যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রেলওয়ে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথে যোগাযোগকে অবহেলা করে সড়ক যোগাযোগকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের নীতি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। পাকিস্তান আমলের এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশেও অব্যাহত থাকায় আমি বারবার হতাশা ব্যক্ত করেছি। রেলওয়ে নৌ-যোগাযোগের মতো পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার পরিবর্তে আমাদের নীতিপ্রণেতারা এখনো কেন সড়ক যোগাযোগকেই অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক একটা দেশে নৌ-যোগাযোগ যে এখনো একেবারেই অবহেলিত অনুন্নত রয়ে গেছে, সেটা একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি  মেনে নিতে পারি না। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, যত্রতত্র অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণের কারণেই সারা দেশের নগর গ্রামগুলোয় পানি নিষ্কাশন বিপর্যস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা সমস্যা দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে এবং আমাদের নদ-নদী খাল-নালাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এটাও হয়তো অনেকের অজানা যে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দৈর্ঘ্যের হিসাবে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সড়কপথ রয়েছে, বেশির ভাগই অবশ্য কাঁচা রাস্তা। এই পরিসংখ্যান নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই, এটা আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ারই প্রতিফলন। যে দেশের ওপর দিয়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা রিভার সিস্টেমের মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পানি নিষ্কাশন সিস্টেমের ২৩০টি বড় নদ-নদী এবং সাতশর বেশি খালের নেটওয়ার্ক প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সে দেশে সড়ক যোগাযোগকে অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি যে কত বড় ভুল, তা আমাদের নীতিপ্রণেতারা এখনো উপলব্ধি করছেন না কেন বোঝা মুশকিল! নদ-নদী-খালের এই নেটওয়ার্ক আমাদের জন্য আল্লাহতায়ালার নেয়ামত, কিন্তু আমাদেরই ভুলে ওগুলো ভরাট করে ফেলে আমরা নানা রকম পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছি। ওগুলোর সাংবৎসরিক নাব্যতা বজায় রাখতে পারলে বন্যার সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান যেমন অর্জিত হবে, তেমনি নৌ-পরিবহনের আধুনিক স্বল্পব্যয়ী নেটওয়ার্কও আমাদের জন্য সহজলভ্য হয়ে যাবে। এর পরের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত রেল যোগাযোগের। রেল যোগাযোগ নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু যে পরিবেশবান্ধব তা নয়, এগুলোকে দরিদ্রবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থাও বলা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিচারেও সড়ক পরিবহনের চেয়ে এগুলো শ্রেয়। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ যাদের হয়েছে, তারা ঠিকই উপলব্ধি করবেন দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্কটিকে কতখানি সহজলভ্য আরামদায়ক করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতে গেলে আমাদের দেশের রেলওয়ের দুর্দশার কথা ভেবে আফসোসের অন্ত থাকে না। ব্রিটেনের মানুষ পারতপক্ষে সড়কপথে ভ্রমণ করে না তাদের রেল যোগাযোগের স্বল্প ব্যয় আরামপ্রদ ব্যবস্থার কারণে। আমাদের রেলওয়েকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার দিন। ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন প্রকল্পকে আর ঝুলিয়ে রাখবেন না।

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন