বোরোতে সাড়ে ১৭ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার

করোনায় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে মজুদ আরো বাড়ানো হোক

সরকার চলতি বোরো মৌসুমে ১৮ লাখ ২৫ হাজার টন খাদ্যশস্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ছয় লাখ টন ধান সংগ্রহ করা হবে। ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত খাদ্যশস্য ক্রয় করবে সরকার। করোনার প্রেক্ষাপটে এবার সরকারের ধান-চাল কেনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় নজরদারি জোরদার করা জরুরি। করোনার অভিঘাত মোকাবেলা এবং তার পরে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাজারে শুধু খাদ্যশস্য থাকলেই হবে না, তা কেনার মতো সামর্থ্যও মানুষের থাকতে হবে। এবার সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো বিস্তৃত করতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ধান-চালের মজুদ প্রয়োজন হতে পারে। এমনিতেই সরকারের গুদামের ধারণক্ষমতা সীমিত, যা ১৬ কোটি মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য চাহিদা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে এবার আঘাত করেছে করোনা। ফলে সরকারকে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ধান-চাল কিনতে হবে। প্রয়োজনে কেনার পরিমাণ আরো বাড়াতে হতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা দরিদ্র-কর্মহীন মানুষদের আগের চেয়ে বেশি খাদ্যসহায়তা জোগাতে হবে। শহর গ্রামে ব্যাপক আকারে চাল সরবরাহের প্রয়োজন দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি গুদামগুলো সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় নিজ অধিকারে নিয়ে সেখানে ধান-চালের মজুদ গড়ে তুলতে পারে। এবার বোরোর ভালো ফলন হয়েছে। আগামী মৌসুমে করোনার আঘাতে ধান-চাল উৎপাদন ব্যাহত হলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ববাজার থেকে কতটা সহায়তা পাওয়া যাবে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ বিশ্ব খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনার কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ খাদ্যশস্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে সংকট মোকাবেলা করতে হবে।

খাদ্যসংকট যেন না হয়, সেজন্য বিশ্বের অনেক দেশেই নাগরিকদের জন্য ব্যাপক আকারে খাদ্যসহায়তা দেয়া শুরু হয়েছে করোনার সময়। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাড়ে সাত কোটি রাজ্যবাসীকে ছয় মাস বিনা মূল্যে খাদ্যসহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কেরালা বিনা মূল্যে রেশন দিচ্ছে। অন্য রাজ্যগুলোও একই পথে হাঁটা শুরু করেছে। এর আগে চীন দক্ষিণ কোরিয়াও একই সুবিধা দিয়েছিল তাদের নাগরিকদের। বিশ্বের তৃতীয় চাল রফতানিকারক দেশ ভিয়েতনাম এবং গম রফতানিতে নবম কাজাখস্তান স্থানীয় বাজারে খাদ্য চাহিদা দেখা দেয়ায় রফতানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। চাল রফতানিতে বিশ্বের প্রথম স্থান দখলকারী ভারতে তিন সপ্তাহের লকডাউন চলছে। পরিস্থিতিতে রফতানি বন্ধের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। 

কৃষকের কাছ থেকে ধান গম সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খাদ্য বিভাগ মিলে একটি যুগোপযোগী কৃষকবান্ধব শস্য সংগ্রহ নীতিমালা প্রণয়ন এবং কৃষি কার্ড প্রবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে। কৃষি কার্ডে কৃষকের মৌসুমভিত্তিক ধান গম উৎপাদনের জমি, মোট উৎপাদিত শস্য, সরকারি গুদামে সরবরাহযোগ্য ধান গমের পরিমাণ এবং মোবাইল ব্যাংকের হিসাব নম্বর উল্লেখ থাকবে। কার্ডের মাধ্যমেই কৃষক সরাসরি সরকারি গুদামে ধান গম সরবরাহ করতে পারবেন এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে সরবরাহ করা শস্যের মূল্য পাবেন। এতে সরকারি গুদামে শস্য সংগ্রহে দুর্নীতি বহুলাংশে কমবে। কৃষক হয়রানি দূর হবে। দূর হবে দলবাজি রাজনৈতিক প্রভাব। নিশ্চিত হবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি। কোনো কাজ সুষ্ঠু সুন্দরভাবে সম্পাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। নীতিমালা যত ভালো হবে, বস্তুনিষ্ঠ হবে, কাজটি তত সুন্দরভাবে সম্পাদিত হবে; যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহের বিদ্যমান নীতিমালাও কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে নয়। নীতিমালার আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খাদ্য বিভাগের উদ্যোগে সরকারি গুদামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান গম সংগ্রহের একটি সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। দাবিকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।

খাদ্যশস্য উৎপাদন বেশি হলেও মানুষের পক্ষে তা কেনার সামর্থ্য না থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ করোনার কারণে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষও রয়েছে। তাদের খাদ্যসহায়তা জোগানো সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি বলেই বিবেচিত হবে। সেটি নিশ্চিত করতে হলে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ধান-চালের মজুদ থাকতে হবে। বোরোর ফলন ভালো হওয়ায় বড় ধরনের মজুদ গড়ে তোলার সুযোগ হয়েছে। এটি কাজে লাগাতে হলে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের বিস্তৃতি আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। কৃষক যেন মাঠ থেকে ধান কাটতে পারেন সঠিক সময়ে, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারের বিধিনিষেধের কারণে শ্রমিকের যাতায়াত কমে যাওয়ায় অনেক স্থানে ধান কাটার জনবলের সংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক কীভাবে দ্রুত ধান কাটা যায়, তার উদ্যোগ কৃষি অধিদপ্তরকে নিতে হবে। নইলে চলতি মাসের দিকে বন্যা, পাহাড়ি ঢলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে, যেমনটি হয়েছিল ২০১৭-১৮ সালের দিকে। এবারের সময়টি অত্যন্ত জটিল। একদিকে স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে জনগণকে খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এজন্য বহির্বিশ্বের দিকে না তাকিয়ে স্থানীয় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে খাদ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে কৃষিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন। আশা করি, কৃষিমন্ত্রী ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান জোরদারের মাধ্যমে বড় ধরনের মজুদ গড়ে তুলবেন; যা করোনার অভিঘাতের মধ্যেও দেশের খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষা করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন