নতুন যুগের শিক্ষায় শিক্ষকের কণ্ঠ

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২৪

মু. নাজমুল হক

আমরা শিক্ষকরা শিক্ষকতা করি বটে কিন্তু নতুন যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে সমাজকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করার কাজে নিজেরা কী ভূমিকা পালন করি? আমরা কি জানি যে আমাদের যুগটা বদলে যাচ্ছে? শিক্ষার্থীরা এখন আর আগের যুগের সুবোধ বালকের মতো ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ এমন ধ্যানধারণাকে আর বহন করে না। বরং অস্থির ও চিত্তচঞ্চল এ একবিংশ শতাব্দীর যুগে সারা দিন শিশুরা আকাশ মাধ্যম ও বাতাস সংস্কৃতির বহমান স্রোতে ভেসে বেড়াতে থাকে। শিশুদের এ ভেসে বেড়ানোর ফলে তাদের চিত্তে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ছাপ সৃষ্টির সুযোগই হয় না। আমরা শিক্ষকরা কি ভাসমান এ শিশুদের চিত্তে গভীর রেখাপাতের কোনো কৌশল অবলম্বন করতে পেরেছি? কারণ কূলে থেকে ভাসমান কোনো প্রস্তরখণ্ডে ছায়াপাত করা যায় না। আমরা যারা কূলে থাকা শিক্ষক অর্থাৎ অতীত যুগের স্থাণু ব্যক্তিত্ব তাদের পক্ষে চলমান, বর্ধিষ্ণু ও অপার তথ্যের মধ্যে ছুটে চলা শিশুদের শিক্ষার ভার বহন করা সম্ভব নয়। 

বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক শিক্ষকের মধ্যে এমন শিক্ষক কতজন আছেন যারা প্রকৃত অর্থেই এসব সাগরে ভাসা সার্ফারদের মতো জ্ঞানের রাজ্যে ভেসে বেড়ানো শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে সক্ষম? শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া কোনো জাতিই জগতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। এখানে শিক্ষক বলতে কেবল শ্রেণীকক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তিকেই বোঝায় না বরং লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজের যেকোনো পর্যায়ের গুরুজন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবও সমাজের শিক্ষক হয়ে থাকেন। এসব শিক্ষকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হয়, যারা পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের জন্য শিক্ষক হিসেবে প্রকাশ পায়। সমাজে শিক্ষকের প্রভাব নির্ভর করে তার তুলনামূলক গভীর জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও বাহ্যিক আচার-আচরণের ওপর। একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার আদর্শ শিক্ষকই পরবর্তী প্রজন্মের উপযুক্ত শিক্ষক তৈরিতে সক্ষম হয়। 

উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবেই সমাজে তৈরি হয় দুর্নীতি, দুরাচার ও নানা রকম সামাজিক অবক্ষয় ও মনোব্যাধি। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যে অবক্ষয়ের নমুনা দেখা যাচ্ছে তাও প্রকৃত অর্থেই এ অপরিণামদর্শী শিক্ষকের প্রভাব। সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের আদর্শের কথা তুললেই পাল্টা জবাব আসে, ‘আমরা কতটা সচ্ছল যে আমাদের কাছে আদর্শ চাওয়া হয়?’ আসলে জীবনাদর্শ, কর্মস্পৃহা, নিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতার সম্পর্ক কমই আসে। আমরা যদি এ উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির দিকে তাকাই তাহলে এ গুণগুলোর সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক কমই পাব। 

সুতরাং প্রয়োজন হলো শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। এর জন্য বাইরের শক্তির যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষক সমাজের ভেতরের সংগঠিত শক্তি ও পচেষ্টা। শিক্ষকতায় কর্মসংস্থানের প্রাচুর্যের কারণে শিক্ষিত তরুণ সাময়িক তাকিদের কারণে সাময়িকভাবে এ পেশায় সংযুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এ পেশাকে জীবনসঙ্গী করার দৃঢ় সংকল্প হয়তো অনেকেরই থাকে না। অতএর যাদের এ পেশায় থিতু হওয়ার ইচ্ছাটা কম থাকে তারাই পেশা পরিবর্তনের চেষ্টায় জীবনের দীর্ঘ একটা সময় অতিক্রম করে যায়। এর পাশাপাশি আর একটি দল শিক্ষকতা পেশাকে স্থায়ী রেখে আনুষঙ্গিক আরো কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে শিক্ষকতার জীবন অতিবাহিত করে যায়। 

উপরোক্ত আলোচনায় মোটামুটি তিন ধরনের শিক্ষক পাওয়া যায়। প্রথমত, যারা নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, অন্য কোনো ধ্যান দ্বারা প্রভাবিত হন না; দ্বিতীয়ত, যারা নানাবিধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তৃতীয়ত, আর এক শ্রেণী যারা অবস্থান্তর পর্যায়ের শিক্ষক, অর্থাৎ পেশা পরিবর্তনে নিরন্তর সচেষ্ট। আমাদের দেশে এই তিন শ্রেণীর শিক্ষকদের মধ্যে কোন শ্রেণীর আধিক্য রয়েছে সেটা অনুমান করার ভার আমি পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম। 

এবার আসা যাক, শ্রেণী শিক্ষকের কর্মযোগ্যতা নিয়ে, যারা বর্তমান সমাজে ভেসে বেড়ানো শিশু-কিশোরদের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এ শিক্ষকের অধিকাংশই একবিংশ শতাব্দীর এসব শিশুকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি অথবা তাদের সেইভাবে প্রশিক্ষিত করাও হচ্ছে না। এখন এই শিক্ষকদের কাছে যদি প্রত্যাশা করা হয় যে তারাই নতুন যুগের এসব শিক্ষার্থীকে মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা ও উপযুক্ত মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে দেবেন তাহলে সেটা কখনই সঠিক হবে না। যুগোপযোগী করে শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষকের সার্বিক চাহিদাগুলো পূরণে আন্তরিক হতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষককে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তার সামাজিক মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পাশাপাশি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম দিয়ে তাদের কর্মে নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে যে রাজনীতি আমরা এতদিন প্রত্যক্ষ করে আসছি সেটা  তাদের মান-মর্যাদাকে এতটাই বিনষ্ট করেছে যে এখন সমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পথে তারা অনেকটা অন্তরায় অনুভব করছে। তাদের মর্যাদাহানিকর অবস্থাটি আমরা তখনই প্রত্যক্ষ করি যখন দেখি যে তাদের ন্যায়সংগত দাবিগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অসম্মানজনকভাবে ফুটপাথে পড়ে থাকতে হয় এবং তার চেয়েও বেশি যখন দেখা যায় যে পুলিশ তাদের গরু-ছাগলের মতো করে তাড়া করে ফুটপাথ থেকে অলিগলিতে নিয়ে যায়। যে সমাজের শিক্ষকরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয় সেই সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনলেও ফলাফল শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট প্রাপ্তি পর্যন্তই গড়াবে। 

শিক্ষার মান উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষকের সার্বিক গুণগত ও সামাজিক মর্যাদার উন্নতি সাধন। শিক্ষকের উন্নতি ছাড়া কোনো শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। একটি আদর্শ ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সাফল্যও মানসম্পন্ন শিক্ষকের ওপরই নির্ভর করবে। অতএব শিক্ষকের মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তার একটি ন্যূনতম পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা, অত্যন্ত উন্নত মানের প্রশিক্ষণ এবং তাকে একটি উঁচু সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এ কাজে প্রধানত দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। তার একটি হলো সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষক সমিতি। 

শিক্ষকের মান বৃদ্ধির জন্য সরকার যৎসামান্য প্রচেষ্ট চালালেও শিক্ষক সমিতি তাদের মান উন্নয়নের বিষয়কে সর্বদাই বেতন-ভাতা ও চাকরির সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। অতএর শিক্ষকদেরই তাদের নিজস্ব মান বজায় রাখার দায়িত্ব নিতে হবে, যেটা তারা সমিতির মাধ্যমে সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করেননি। আমাদের এ সমিতির একটা বড় দুর্বলতা হলো তারা কখনই সকলে এক ছাতার নিচে আসতে পারছেন না এবং সে কারণেই নিজেদের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও তারা কোনো পদক্ষপে নিতে পারছে না। দেশীয় রাজনীতি শিক্ষা প্রসারের আর একটি বড় অন্তরায়। শিক্ষকরা দলে দলে বিভক্ত, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে নেতারাও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। প্রয়োজন জাতীয় নেতাদের মধ্যেও উন্নত শিক্ষা চেতনার বিকাশ ঘটানো।

আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে হলে শিক্ষকদের একত্র হতে হবে, একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে ‘আমরা শিক্ষক আমরা অবহেলার পাত্র নই’। শিক্ষকদের সব অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেদেরই করতে হবে, সরকারের আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। শিক্ষক নিজেরাই নিজের দেশের শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করবে, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করবে, শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করবে এবং শিক্ষকের গ্রহণযোগ্য মান নিরূপণ করবে, তবেই দেশের একটি বহুল প্রত্যাশিত সমস্যার সমাধান নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। 

মু. নাজমুল হক: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫