আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই মাস

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অনন্য ছিলেন যারা

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২৪

শফিকুল ইসলাম

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছেন দেশের প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাদের কেউ ভূমিকা রেখেছেন রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে, কেউ ভূমিকা রেখেছেন রাজপথের আন্দোলনকারীদের নানা ধরনের সহায়তা করার মধ্য দিয়ে। নেপথ্যে থাকা এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ এগিয়ে আসেন পেশাগত দায়িত্বের জায়গা থেকে; কেউ আসেন মানবিকতার দায় থেকে, কেউ আবার আসেন বিবেকের তাড়না থেকে। হতাহতদের কেউ রক্ত দেন, কেউ খাবার দেন, কেউ আবার পাশে দাঁড়ান চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে। হতাহতদের হাসপাতালে নেয়ার ট্রলিতে হাত লাগিয়েও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখেন কেউ কেউ। আন্দোলনে হতাহতদের সাহায্য করতে গিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রোষানলেও পড়েন অনেকে। কিন্তু সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে মানবিকতা ও সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করেন তারা। 

আন্দোলন চলাকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের গুলিতে বিদ্ধ হন হাজারো ছাত্র-জনতা। গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায় বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল। তবে বেসরকারি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অন্তত ২০ জনের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জন ও নিউরো স্পাইন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সুজন শরীফ। তিনি অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক; কাজ করেন ধানমন্ডির ইবনে সিনা স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনসালট্যান্ট হিসেবেও। মূলত বেসরকারি এ দুই হাসপাতালে গুলিবিদ্ধদের অস্ত্রোপচার করেছেন তিনি। 

আন্দোলনের সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে ডা. সুজন শরীফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধদের ইনজুরি নোট লেখার ক্ষেত্রে অনেক বিষয় থাকে। পুলিশ কেস হওয়ায় আমরা চিন্তায় পড়ে যাই। কিন্তু এত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল যে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সরকারিতে স্থানান্তরের মতো অবস্থা ছিল না। বিবেকের তাড়নায় আমরা এসব রোগীকে ভর্তি করাই। আমরা পর্যায়ক্রমে তাদের অস্ত্রোপচার করি।’

সুজন শরীফ বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রের মতো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা কখনই হইনি। আমার মনে আছে, একদিন বেলা ৩টা থেকে শুরু করে পরের দিন ফজরের আজান পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম।’ 

১৮ জুলাইয়ের একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এ চিকিৎসক জানান, বিকালের দিকে ইবনে সিনা স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। জানানো হয়, ইউসুফ নবী নামের এক রোগী মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছে। তার জরুরি অপারেশন লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলামোটর থেকে রিকশা ঘুরিয়ে চলে যান ইবনে সিনায়। গিয়ে দেখতে পান একটি বুলেট রোগীর নাকের বাম দিক থেকে ঢুকে মাথার পেছনে আটকে আছে। কয়েকজন নিউরোসার্জন মিলে তাৎক্ষণিক অপারেশন শুরু করেন। প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগে অপারেশন শেষ করতে। 

সুজন শরীফ বলেন, ‘‌আমি ইবনে সিনায় গেলেই ইউসুফকে দেখতে আইসিইউতে যেতাম। সেখানকার চিকিৎসকরা বলত, এ রোগী বাঁচবে না। আমি তাদের বলতাম, ভালো করে চিকিৎসা দিলে খুব খারাপ অবস্থা থেকেও রোগী বেঁচে যায়। গত ৫ আগস্ট ওই রোগীর জ্ঞান ফেরে। আমি বললাম, ইউসুফ দেশ তো স্বাধীন। আমি তার চোখে হাসির একটা আভা দেখলাম।’

২০ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পান ইউসুফ নবী। তার চিকিৎসায় ব্যয় হয় প্রায় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু ইবনে সিনা কর্তৃপক্ষ ১ টাকাও নেয়নি। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় প্রচুর পরিমাণে রক্তের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে ‘রিদম ব্লাড সেন্টার’। গত ১৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত আহতদের ৭০০ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেয় তারা। বুথ বসানো হয় ঢামেকের সামনে। লাইন দিয়ে মানুষ রক্তদান করে তাদের এ কালেকশন বুথে। মানবিক এ কাজের মূল উদ্যোক্তা রিদম বাংলাদেশ ট্রাস্টের সভাপতি ও রিদম ব্লাড সেন্টারের পরিচালক ডা. এসএম মামুন। তিনি বর্তমানে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। 

ডা. এসএম মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওই সময়টায় রক্তের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের মনে হলো, যদি শুধু রক্তের সাপোর্ট দেয়া যায়, তাহলে হয়তো কয়েকশ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। আমাদের কাছে সংরক্ষিত ব্লাডসহ ফুল ক্যাপাসিটি নিয়ে ঢামেকের জরুরি বিভাগে যাই। সেখানে আমাদের ১৫ জন চিকিৎসককে নিয়ে বুথ বসাই।’

রক্ত জোগান দেয়ার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাসেবা, ইমার্জেন্সি মেডিসিন পরিবহন নিয়েও হতাহতদের পাশে দাঁড়ায় ‘রিদম ব্লাড সেন্টার’। এছাড়া ১১০ জন চিকিৎসকের একটি টিম নিজের দায়িত্বের বাইরে রোস্টার করে সেবা দেন সরকারি পাঁচটি হাসপাতালে। 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমে শিক্ষকতার পাশাপাশি পাবলিক রিলেশন অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন আসিফ বিন আলী। ১৮ জুলাই রাজধানীতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কে নির্বিচারে গুলি চালালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। ওইদিন আহত শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও আটকেপড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন আসিফ বিন আলী। এ ঘটনার জেরে পুলিশ দুই দফা তার বাসায় অভিযান চালায়। 

আসিফ বিন আলী বলেন, ‘১৮ জুলাই বিকাল ৪টার পর থেকে এনএসইউ মেডিকেল সেন্টারে রোগী আসার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ডেইলি এনএসইউ ও এনএসইউ-কেন্দ্রিক যেসব ফেসবুক গ্রুপ শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়। বার্তাটি ছিল আন্দোলনে আহত যে কেউ এনএসইউ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে পারবে। এটি আমরা অফিশিয়ালি করতে পারছিলাম না কারণ সরকার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রচণ্ড রকমের চাপ দিচ্ছিল। এটি যারা সামনাসামনি দেখেনি তারা আসলে বুঝতে পারবে না যে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কী ধরনের চাপ তৈরি করেছিল।’ 

আসিফ বিন আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২৫ জুলাই দুটি জিপ এসে আমার বাসার সামনে থামে। পুলিশ বাসা ঘিরে ফেলে। বাসার দিকে বন্দুক তাক করা হয়। এ অবস্থায় ২ মিনিটের মধ্যে ফোনে শিক্ষার্থীদের কন্ট্যাক্ট লিস্ট ও ল্যাপটপে থাকা আহতদের ছবি ডিলিট করে দিই। এর মধ্যে পুলিশ দরজায় এসে জোরে লাথি মারে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। একজন পুলিশ বলল, আপনি ছাত্রদের উসকানি দিচ্ছেন। তারা সব ঘরে তল্লাশি চালিয়ে কিছু না পেয়ে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর আবার তিন-চারজন পুলিশ এসে জেরা করে। আবার তল্লাশি চালায়। এরপর তারা চলে যায়।’ 

আন্দোলনের সময় ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন হিজড়া প্রিয়া খান। সে সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‌আহত ও নিহত অবস্থায় যাদের আনা হয়েছে আমরা তাদের বহন করেছি। রক্তে ভিজে গেছে শরীর। যাদের ওষুধ দরকার ব্যবস্থা করেছি। অপারেশনের জন্য যেসব প্রসেস লাগে সবকিছুই করেছি। অনেককেই বলেছি আহতদের ধরেন, আমাদের সহযোগিতা করেন, কেউ এগিয়ে আসেনি। এত দেহ টানতে টানতে ক্লান্ত হয়েছি, তবুও সরে যাইনি। কেউ কিন্তু এগুলো করতে বলেনি, মানুষের প্রতি মানুষের টান থেকে নিজেদের উদ্যোগেই করেছি।’ 

শাহবাগ থানার হিজড়া কমিউনিটির এ সদস্যের সঙ্গে আরো ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের মুক্তা, নদী, বৈশাখী, মুগ্ধ ও হাবিবা। গত ১৬ জুলাই রাত থেকে ৬ আগস্ট ভোর ৪টা পর্যন্ত তারা জরুরি বিভাগের সামনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ছিল তাদের এ কার্যক্রম।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রিয়া খান বলেন, ‘‌১৭ জুলাই থেকে শুরু হয় বিভীষিকাময় অবস্থা। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকেই আসে, মরদেহ আসে। শুধু যে ছেলে তা নয়, নারী ও শিশুরাও ছিল। গুরু মাকে বললাম আমরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের থেকে টাকা নিয়াই খাই। তারা বিপদে আছে মানে আমাদেরও বিপদ। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। তখন গুরু মা বললেন কী করতে চাও? আমি বললাম, আমরা যে কজন পারি ঢামেকে স্বেচ্ছাশ্রম দেব। তারপর জরুরি বিভাগে কাজ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করে, কার অনুমতি নিয়ে আমরা এখানে কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে অনেক বাক্‌বিতণ্ডাও হয়। বলেছি, আমরা ঢাবিতে কালেকশন করে খাই, তাই নিজ উদ্যোগে এখানে এসেছি। প্রথমে স্ট্রেচার ধরা শুরু করি। আহত ও মৃত অনেক মানুষ এসেছে তাদের বহন করেছি।’ 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গের গোসলঘরে কাজ করেন মুজিবুর রহমান। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ এলে গোসল করানোর পর কাফন পরিয়ে দেয়াই তার দায়িত্ব। ষাটোর্ধ্ব মুজিবুর দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এ কাজ করে আসছেন। প্রতিদিন তিন-চারটি মরদেহের গোসল করাতে হয়। তবে গত ৪ আগস্ট ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। জীবনের প্রথম একদিনেই তাকে ২৪টি মরদেহের গোসল দিতে হয়। ওইদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এমন অনেক মরদেহ একসঙ্গে দেখেছিলাম রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার সময়। তখন অনেক মানুষের মরদেহ ঢামেকে এসেছিল। কিন্তু ৪ আগস্টের মতো একসঙ্গে এতগুলো কখনো আসেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব মিলিয়ে ৭০টির মতো মরদেহের গোসল করিয়েছি আমি।’

পাঁচ সন্তানের বাবা মুজিবুর রহমানের বাড়ি কুমিল্লায়। ঢাকায় বাস করছেন ২৪ বছর ধরে। ঢামেক মর্গের গোসলঘরে কাজ করছেন সেই তখন থেকেই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সেদিন অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় মর্গে। যেন এক মৃত্যুর মিছিল। একের পর এক মরদেহ আসতে থাকে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫