বন্যায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

শিক্ষায় স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরাতে দ্রুত শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হোক

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২৪

দেশের পূর্বাঞ্চল গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়ে শোচনীয় দিন যাপন করছে দুর্গত অঞ্চলের মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য অবকাঠামো। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলা এ বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৫৩ লাখ ৬ হাজার মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। কেননা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সাধারণত শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্যানুসারে, গত ৩৪ বছরের মধ্যে এ বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। এতে দুর্গত অঞ্চলের অন্তত ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ। একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ভিত গড়ে ওঠে শৈশবে। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ, যার অন্যতম একটি নিয়ামক প্রাথমিক শিক্ষা। সরকারের এ বিষয়ে তৎপর হওয়া জরুরি। 

বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রাম বিভাগের সাত জেলার অন্তত তিন হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে বই, খাতা, স্কুল ড্রেস। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্কুলের অবকাঠামো ও আসবাবপত্র। বন্যার প্রায় এক মাসের বেশি সময় পার হলেও স্কুলগুলোকে পাঠদানের উপযোগী করা সম্ভব হয়নি। পানি নেমে গেলেও শিক্ষা উপকরণ সংকটে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষায় স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরাতে সরকারকে দ্রুত শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষা কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণেও বড় সংকটে রয়েছে স্কুলগুলো। এছাড়া অনেক এলাকায় এখনো বন্যার পানি থাকায় স্কুলের সংস্কার করা যায়নি। এ কারণে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে। স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ স্বাভাবিক করতে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি স্কুলগুলোর দ্রুত সংস্কার করতে হবে। 

চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ হাজার ৫৭৬টি স্কুলের মধ্যে ৩ হাজার ৪৯টি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে ২ হাজার ২৩৩টি স্কুল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব স্কুলের ২ লাখ ৬৯ হাজার ১২ শিক্ষার্থী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলের বই, স্কুল ব্যাগ ও ড্রেসের চাহিদাপত্র হাতে পেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। চাহিদাপত্র অনুযায়ী, বন্যাকবলিত এলাকায় ২ লাখ ৬৬ হাজার ২৮০টি স্কুলব্যাগ, ২ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৭ সেট স্কুল ড্রেস সরবরাহ করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া কী পরিমাণ বইয়ের চাহিদা জরুরি ভিত্তিতে রয়েছে সে বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা কাজ করছেন। কিছু প্রাথমিক চাহিদাপত্র পাওয়া গেছে। তবে চাহিদাপত্র অনুযায়ী বই পর্যাপ্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে কোনো সংকট হবে না বলে জানিয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। 

যদিও ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ভাষ্য, তাদের বর্তমানে প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শেষ করা। তাই শিক্ষার্থীদের খাতায় হাতে লিখে, ফটোকপি করে বা অন্যভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। স্কুলগুলোয় এখনো শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে চেষ্টা করছেন তারা। এছাড়া ফেনী জেলার এক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন যে যতদিন না শিক্ষা উপকরণ হাতে হাতে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে, ততদিন হাতে লিখে বা বই শেয়ারিং বা অন্যান্য উপায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

শিক্ষা অধিদপ্তর যেহেতু জানিয়েছে যে চাহিদাপত্র অনুযায়ী বইয়ের জোগান রয়েছে, তাহলে সেগুলোর দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগও কাম্য। এরই মধ্যে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষা উপকরণের মধ্যে খাতা, কলম, পেনসিল, স্কুলব্যাগ বা ড্রেসসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ রয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় সাধারণত বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এর মধ্যে পানি ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যা বেশি। বড়দের চেয়ে শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই শিক্ষা কার্যক্রম পুরোদমে চালু করার পাশাপাশি জোর দিতে হবে বিদ্যালয়গুলোর পরিচ্ছন্নতায়। বিদ্যালয়গুলো যথাযথভাবে মেরামত করতে হবে এবং সুপেয় ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা জরুরি। পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মশার বিস্তার রোধ করতে হবে।

দেশ যেহেতু দুর্যোগপ্রবণ এবং প্রায় প্রতি বছরই একটা নির্দিষ্ট সময় বন্যার কবলে পড়ে বিভিন্ন জেলা, সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সরকারের নেয়া প্রয়োজন। বন্যার সময় বহুতলবিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলো আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো টেকসই করে গঠন ও মেরামত করতে হবে, যাতে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। কেবল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, সরকারের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টেকসই করতে মনোযোগী হতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে তাগাদা দিতে হবে। প্রয়োজনে বন্যাপ্রবণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫