গমের বিশ্ববাজার নিম্নমুখী হলেও দেশে বাড়ছে আটার দাম

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২৪

ইয়াহইয়া নকিব

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে গতকাল খুচরায় প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছিল ৪৫ টাকায়। খোলা ময়দার দাম ছিল ৬০ টাকা। আর দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম ছিল ১১০ টাকা। আর গত মাসে আটার কেজি ছিল ৩৮-৪০ টাকা। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৫-৭ টাকা। যদিও এ সময় বিশ্ববাজারে গমের দাম ছিল নিম্নমুখী। 

বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আটার দামও বেড়ে যাচ্ছে। তাই ভোক্তার স্বার্থে বাজার নজরদারিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। আমদানি পর্যায়ে আদৌ কোনো নজরদারি আছে কিনা, সে প্রশ্নও তুলছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তবে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ভুসির বিক্রি কমে যাওয়ায় আটার দাম কিছুটা বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পিঙ্কশিটের তথ্যমতে, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গমের টনপ্রতি দাম উঠে যায় ৩৮১ ডলারে। পরে তা কমতে থাকে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিশ্ববাজারে টনপ্রতি গমের দাম ছিল ২৯৮ ডলার। আর চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে টনপ্রতি দাম কমে দাঁড়ায় ২৩৭ ডলার। জুলাইয়ে আরো ১৯ ডলার কমে হয় ২১৮। আর আগস্টে বিশ্ববাজারে টনপ্রতি গমের দাম ছিল ২০৫ ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ গমের দাম ক্রমাগত কমেছে। দেশে আমদানি করা গম আসতে গড়ে দুই মাস সময় লাগে। সে হিসাবে আগস্টে বিশ্ববাজারে হ্রাস পাওয়া দামের প্রভাব অক্টোবরের শুরুতে বাজারে পড়ার কথা। কিন্তু বাজারে ঠিক তার উল্টো চিত্র।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে চালের দাম বেশি। চালের বিকল্প হিসেবে মানুষ আটা খায়। তাই এখন আটার দামও বাড়ছে। কিন্তু আট-নয় মাস ধরে বিশ্ববাজারে গমের দাম ক্রমাগত কমছে। কারণ বিশ্বে গমের উৎপাদন বেশি হয়েছে। কিন্তু আমদানিকারক পর্যায়ে কোনো নজরদারি নেই। ভোক্তার স্বার্থ দেখতে হবে সরকারকে। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’

দেশে গমের চাহিদা ৭০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১০ লাখ টন। বাকিটা আমদানি হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৬৬ লাখ টন গম আমদানি হয়। আমদানির সঙ্গে দেশে উৎপাদিত গম যোগ করলে গমের উদ্বৃত্ত মজুদ থাকার কথা। সরকারি গুদামে গতকাল পর্যন্ত গম মজুদ ছিল ৪ লাখ ৭০ হাজার টনের বেশি। অর্থাৎ সরবরাহের কোনো ঘাটতিও নেই। তবুও বাড়ছে দেশের দ্বিতীয় প্রধান এ খাদ্যপণ্যের দাম।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু বড় আমদানিকারক গম আনতে সমস্যায় পড়ছেন। পরিবর্তিত সরকার ব্যবস্থায় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা ছোট ব্যবসায়ীদের ওপরও প্রভাব ফেলছে। 

নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ আটা-ময়দার অন্যতম পাইকারি বাজার। নিতাইগঞ্জ আটা-ময়দা ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ওয়াজেদ আলী বাবুল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বড় আমদানিকারকদের ব্যবসা ব্যাহত হলে বাজারে অসামঞ্জস্য পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সে আশঙ্কা থেকে আটার দাম কিছুটা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে সরকারি মজুদ বাড়াতে হবে।’ বাজার নজরদারি স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করেন তিনি। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের মেসার্স মালতী স্টোরের স্বত্বাধিকারী সঞ্জয় দে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গমের আন্তর্জাতিক বাজার দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল। কিন্তু কোম্পানিগুলো আটা ও ময়দার দাম কমাচ্ছে না। বরং কিছু কিছু বড় ফ্লাওয়ার মিল আটা ও ময়দার দাম বাড়িয়েছে। তবে খোলা আটা-ময়দার দাম এখনো স্থিতিশীল রয়েছে।’

দেশে আটার বড় জোগানদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য সরবরাহের কোনো ঘাটতি দেখছে না। তবে ভুসির দাম কমে আসায় আটার দামে তা প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত গম রফতানি না করলেও ভুসি ডাম্পিং করছে। আর এখন অফ সিজন হওয়ায় ভুসির দাম কমে এসেছে, যা আটার দাম বাড়াতে কিছুটা প্রভাব ফেলছে। কারণ ভুসির গোডাউন পূর্ণ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে আটা উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়।’

সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘাতকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম আগামীতে বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো জাহাজ পাওয়া যাবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সেভাবে হয়তো কেউ আসতে চাইবে না।’

বাজারে পণ্যের দাম হ্রাসের যে প্রত্যাশা মানুষের, তা পূরণের কোনো লক্ষ্য সরকারের মধ্যে দেখছেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, সরকার পরিবর্তন হলেও আগের মতোই ব্যবসায়ীরা রয়ে যাচ্ছেন নিয়ম-নীতির বাইরে। 

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে ব্যবসায়ীরা যেমন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন, এখনো একই অবস্থা বিরাজ করছে। তাই দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা রেডি থাকলেও দাম কমানোর সময় কোনো খবর থাকে না। যারা বাজার দেখাশোনা করছেন, তাদেরও ব্যর্থতা রয়েছে। বাজার মনিটরিং হচ্ছে না। গা-ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। তাই ডিম-মুরগি ছাড়াও প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। আইনের কোনো প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫