ঊর্ধ্বমুখী বাজার

নিত্যপণ্যের দাম কমাতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারকে তৎপরতা বাড়াতে হবে

প্রকাশ: অক্টোবর ০৪, ২০২৪

দেশে দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। এখনো জ্বালানি, মাছ, মাংস, ডিম, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি কমার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যদিও এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত বুধবার বিবিএস মাসিক হালনাগাদ ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য প্রকাশ করেছে। সেপ্টেম্বরের সিপিআইয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদনে সব ধরনের মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্যে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের চিত্র উঠে এসেছে। ফলে বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে বাজারের বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এছাড়া বিগত সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর অন্যতম কারণ সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুখে মুখে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও কাজে-কর্মে তার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি সেই সময়। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বিবিএসের অবাস্তব পরিসংখ্যানও। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায় তৎপরতা বাড়াতে হবে। 

বিগত সরকারের আমলে আমদানিসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। বাজারে নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। বিগত সরকারের লোক দেখানো উদ্যোগ বাজারের নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। এতে উচ্চ দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এখনো বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ফলে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। 

বিগত সরকারের শাসনামলে দেশের প্রতিটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিবিএস অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকেই বানোয়াট পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করেছে। সরকার পরিবর্তনের পরও বিবিএস আগের সেই ধারা বজায় রেখেছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই ও আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ঠেকেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাসেই (আগস্ট) সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নামে, খাদ্য মূল্যস্ফীতিও নামে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দশমিক ৯৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমলেও দুই অংকের ঘরেই রয়ে গেছে। কিন্তু ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুরেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। গত পাঁচ মাসে ১২ কেজি এলপিজির দাম অব্যাহতভাবে পাঁচ দফায় মোট ৯৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া মাছ, মাংস, চিনি, ডিমসহ নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। ফলে বিবিএসের প্রকাশিত পরিসংখ্যান নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বিশেষত শ্রীলংকা ও পাকিস্তান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সফলতা দেখালেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসার কথা। কিন্তু এখনো বাজারে তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। এর মূল কারণ বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। যার কারণে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোর সুফল পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় সব ধরনের সিন্ডিকেট ভাঙতে ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সরকারকে আরো তৎপর হতে হবে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে সফল হলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিবেশী শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভারত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পেরেছে। এর মধ্যে শ্রীলংকা অন্যতম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা, ভারত ও নেপাল উদাহরণ হতে পারে। 

ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি উসকে ওঠা দেশগুলোর একটি ছিল শ্রীলংকা। দুই বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। বৈদেশিক দায় পরিশোধে ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটির মূল্যস্ফীতি এখন ১ শতাংশেরও নিচে। গত আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক ৫ শতাংশ। ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছে শ্রীলংকা। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘদিন ধরেই ছিল দুই অংকের ঘরে। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটিতে ২০২৩ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৭ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়ায়। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখালেও বাংলাদেশ বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ অর্থ পাচার, সড়কে চাঁদাবাজি ও শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট। এছাড়া ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ বাড়া, ব্যাংক লুটপাট, ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়ন, ডলার ও রিজার্ভ সংকটে দেশের অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে। অথনৈতিক এ সংকটের মধ্যেও সরকারের ব্যয় কমেনি। বরং বেড়েছে। এ অর্থ সংস্থানে নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে দেশীয় ও বিদেশী ঋণের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ায় টাকার মূল্যমান কমে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।

বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা দরকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে খাদ্যপণ্যের মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়ানোও দরকার। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি দেশের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যাবশ্যকীয় সঠিক পরিসংখ্যান। বিবিএসকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশে আরো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫