২০০৬ সালের পুনরাবৃত্তি?

লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান কেন সহজ হবে না

প্রকাশ: অক্টোবর ০২, ২০২৪

বণিক বার্তা অনলাইন

শেষবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন লেবাননে প্রবেশ করেছিল, সেই ২০০৬ সালের অভিযানকে তারা এক প্রকার ভুলেই যেতে চাইবে। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া মাসব্যাপী যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা জড়িয়ে পড়ে তীব্র লড়াইয়ে। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা তাদের একের পর এক পূর্ব পরিকল্পিত ট্যাঙ্ক কলামের ফাঁদে ফেলে। এ যুদ্ধে ইসরায়েলের অন্তত ২০টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ১২১ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হন। যুদ্ধের ফলাফল মূল্যায়নের জন্য গঠিত উইনোগ্রাদ কমিশন জানায়, ইসরায়েল এক দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা স্পষ্টতই সামরিক বিজয় ছাড়াই শেষ হয়।

প্রায় দুই দশক পর, গতকাল মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছে যে, তারা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে দক্ষিণ লেবাননে সীমিত আকারে স্থল অভিযান শুরু করেছে। তবে ইসরায়েলের সৈন্য ও ট্যাঙ্ক মোতায়েন দেখে মনে হচ্ছে, লেবাননে দীর্ঘমেয়াদী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি।

গত সপ্তাহে লেবাননে বোমা হামলার তীব্রতা বাড়ায় ইসরায়েল। এতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহ। গত সপ্তাহে প্রায় ১০ লাখ লেবানিজ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লক্ষ্য অনেকের কাছেই পরিচিত— হিজবুল্লাহ যেন আর ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর সরকার হয়তো হিজবুল্লাহর শক্তি ও সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করছে এবং ইসরায়েল আবারও লেবাননে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

যুদ্ধের প্রস্তুতি

ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হারজি হালেভি ২০০৬ সালের যুদ্ধ থেকে নেয়া শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে সেনাদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মুখোমুখি হলে তাদের দেখিয়ে দেবেন কীভাবে একজন পেশাদার, অত্যন্ত দক্ষ এবং যুদ্ধ-অভিজ্ঞ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়।

৭ম সাঁজোয়া ব্রিগেডের সঙ্গে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের ৯৮তম ডিভিশনের অভিজ্ঞ বিমানবাহিনী সৈন্যদের সমাবেশ করেছে, যারা গাজায় কয়েক মাস ধরে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, এবং উত্তর কমান্ডের অধীনে থাকা ইউনিটগুলোর রিজার্ভ সৈন্যদেরও সক্রিয় করেছে।

আল জাজিরার প্রতিরক্ষা সম্পাদক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোস বলেন, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে তাদের উদ্দেশ্য গুরুত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিতে এলিট ইউনিট পাঠিয়েছে। দক্ষিণ লেবাননে মোতায়েন করা সৈন্যরা যুদ্ধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হলেও তারা এখন ক্লান্ত। কারণ তারা এক বছর ধরে গাজায় লড়াই করছে।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের হাতে আট সৈন্য নিহত এবং দুই অফিসার অপহৃত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তড়িঘড়ি করে অভিযান শুরু করেছিল ইসরায়েল। এবার অবশ্য তেমনটা হচ্ছে না। সামরিক অভিযানের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর লেবানন জুড়ে হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার, গুদাম এবং লঞ্চারগুলো লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত পেজার এবং ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটে। গত শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন।

তবে বাস্তুচ্যুত ইসরায়েলিদের উত্তরে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক লক্ষ্য এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজবুল্লাহ উত্তরের দিকে কয়েকটি রকেট ছুঁড়লে তা ইসরায়েলি নাগরিকদের ফিরে আসাকে অনেক বেশি বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। সামরিকভাবে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা খুব কঠিন।

হিজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কখনোই বন্ধ করেনি হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গ্যাটোপোলোস বলেন, যখন আপনি ভাবেন যে আপনার প্রতিপক্ষ আপনাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না, তখন আপনি তাদের হালকাভাবে নেন। এই অহংকার বেশ বিপজ্জনক।

২০০৬ সালের তুলনায় হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি অনেক বেড়েছে। দক্ষিণে তখন মোতায়েন ছিল প্রায় ৫ হাজার হিজবুল্লাহ সৈন্য, যা এখন লাখো যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। তাদের এলিট রাদওয়ান বাহিনীর যোদ্ধারা দক্ষিণে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং এলাকাগুলো হাতের তালুর মতো চেনে। এই এলিট বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার বলে অনুমান করেন গ্যাটোপোলোস।

হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল মজুদ রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও, ২০১৩ সাল থেকে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখন হিজবুল্লাহর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে শক্তিশালী নজরদারি ড্রোন বহরের ওপর নির্ভর করতে পারে। কিন্তু লেবাননের মাটির নিচের যুদ্ধ টানেলগুলো হিজবুল্লাহকে নিজ দেশে সামরিক সুবিধা দিতে পারে।

গ্যাটোপোলোস বলেন, হিজবুল্লাহরও ড্রোন আছে এবং তারা ২০০৬ সালের তুলনায় ইসরায়েলি বাহিনীর গতিবিধি অনেক ভালোভাবে নজরে রাখতে পারে। উভয় পক্ষেরই যুদ্ধক্ষেত্রে নজরদারির সক্ষমতা রয়েছে। তবে যদি আপনার কাছে মাটির নিচে থাকার বিশেষ ক্ষমতা থাকে যা শত্রু চেনে না, তবে শত্রুকে চমকে দেয়ার সুযোগ থাকবে আপনার হাতে।

যুদ্ধের লক্ষ্য

ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও সাবেক মার্কিন কূটনীতিক নাবিল খুরী আল-জাজিরাকে বলেন, সামরিকভাবে ইসরায়েল নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য বেছে নিয়ে কিছু মানুষকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য আরো বিস্তৃত। তারা গাজার জন্য, পশ্চিম তীরের জন্য এবং এখন স্পষ্টভাবে লেবাননের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাই আমি মনে করি না যে, লেবাননে কোনো স্বল্পমেয়াদি অভিযান চালাবে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলিদের জন্য এটি অবশ্যই সহজ হবে না, প্রচণ্ড কঠিন হবে। এবং লেবাননে তারা যে ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে তাতে আইডিএফ না চাইলেও সেখানে দীর্ঘ সময় থেকে যেতে বাধ্য হবে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী শেষ পর্যন্ত হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার জন্য একটি ‘সীমিত’ অভিযান চালানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করার চেষ্টা  বারবার করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।

বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার মতো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দক্ষিণ লেবাননে একটি বাফার জোন তৈরি করার কথা ইসরায়েল বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে।

তবে এই সমাধান গ্যাটোপোলোসকে মনে করিয়ে দেয় ২০০০ সালে শেষ হওয়া দীর্ঘ দখলের কথা। সে কথা ভেবেই তিনি বলেন, সমাধানটি কাজ করবে না। তিনি বলেন, আপনি যদি একটি বাফার জোন তৈরি করতে চান, তবে সেখানে সৈন্য রাখতে হবে। আর তারা হবে হিজবুল্লাহর আদর্শ লক্ষ্যবস্তু। এর ফলে ইসরায়েল তার ‘সীমিত’ পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে নতুন করে লেবাননে সামরিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়বে।

এর পাশাপাশি, হিজবুল্লাহর কাছে এমন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বড় মজুদ রয়েছে যা লেবাননের যে কোনো স্থান থেকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে বাফার জোন উত্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসরায়েল কতদূর যেতে রাজি তা নৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে এখনো পরিষ্কার নয়। গ্যাটোপোলোস বলেন, ইতিহাস যদি নির্দেশক হয়, তবে এটি ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খল এক অভিযান হতে চলেছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫