বাংলার চিত্রকলায় চৈতন্য প্রভাব

প্রকাশ: অক্টোবর ০২, ২০২৪

মুহম্মদ আল মুখতাফি

বাংলায় ইসলাম প্রবেশের বহুদিন পেরিয়ে গেছে। ইসলাম ও স্থানীয় সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে নানা মত। রাজধানী গৌড় ছিল সেদিক থেকে নানা আদর্শের পীঠস্থান। যদিও দরবারে পারসিক ও আরব সংস্কৃতির প্রভাব ছিল তীব্র। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার সূত্র ধরে পারসিক চিত্রকলা উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে সুলতান নুসরত শাহের দরবারে। তবে সেই তুর্ক ও পারসিক বলয়ের মধ্যেই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নবদ্বীপ। নুসরত শাহের পিতা হোসেন শাহের আমলে সেখানে আবির্ভূত হন শ্রী চৈতন্য, বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের পুরোধাব্যক্তিত্ব। এ অঞ্চলে চৈতন্যের মাধ্যমেই শুরু হয় নতুন যুগ প্রবণতার। সে সময় নবদ্বীপে চিত্রকলার চর্চা কতদূর ছিল; তা ঠিক পবিষ্কারভাবে জানা যায় না। তবে গৃহস্থালি জীবনে পূজা ও অর্চনায় আলপনা রচনা ও বিয়েতে পিঁড়ি অঙ্কনের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ নেই। চৈতন্যদেবের আদর্শ প্রচারের বড় মাধ্যম ছিল শিল্প। ফলে নৃত্য ও গানের পাশাপাশি চিত্রকলার উপস্থিতি থাকাও স্বাভাবিক। চৈতন্যযুগে চিত্রকলা চর্চার সবচেয়ে বড় উদাহরণ অধুনা আবিষ্কৃত বংশীবদনের লেখা ‘শ্রীগৌরাঙ্গলীলামৃত’ গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে কেবল চৈতন্যের প্রভাব নিয়ে না, সে সময়ের চিত্রকলা নিয়েও সম্যক ধারণা হাজির হয়েছে।

বংশীবদন ছিলেন চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি লিখেছেন, শ্রীরাসমন্দিরে জনৈক ভাস্কর শ্রীগৌরাঙ্গকে শ্রীকৃষ্ণের ‘গোদোহনলীলা’ চিত্রপটে প্রদর্শন করলে গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ ভাবাবেশে ‘গোপলীলানুকরণ’ করে নৃত্য করেছেন। অন্যত্র বলা আছে, প্রসাদ গ্রহণের পর শ্রীগৌরাঙ্গ ‘চিত্রগৃহে’ বিশ্রাম নিলেন। এভাবে চৈতন্যদেবের ধর্মকে আশ্রয় করে নৃত্য-গীত-অভিনয়ের সঙ্গে চিত্রকলার বিকাশ ছিল স্বাভাবিক। চৈতন্য তার প্রেমভক্তিকে ভাবোন্মাদনার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে শিল্পানুভূতিকে সম্মিলিত করেই সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। 

ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতি স্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ভিত্তিতে। সে ধর্মান্দোলন এক নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলার চিত্রকলাকেও বিশেষভাবে সঞ্জীবিত করে তুলেছিল। ঘটনাটি ঘটে ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে। বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে শাস্ত্র অধ্যয়ন ও গোপাল ভট্টের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর বৃন্দাবনের গোস্বামীদের রচিত শাস্ত্রগ্রন্থ নিয়ে বাংলায় ফিরছিলেন শ্রীনিবাস আচার্য। দুর্গম জঙ্গলপথ পেরিয়ে গাড়ি বন-বিষ্ণুপুর পৌঁছলে গোপালপুর গ্রামে একদল দস্যু ধনদৌলত মনে করে বৈষ্ণবগ্রন্থাদি লুঠ করে নেয়। লুণ্ঠিত গ্রন্থের উদ্ধারের আশায় শ্রীনিবাস হাজির হন বন-বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা বীর হাম্বীরের রাজসভায়। হাম্বীর তার সাত্ত্বিক রূপদর্শনে ভাবান্তর হয়ে সপরিবারে তার কাছে দীক্ষা নেন। এ ঘটনায় কেবল মল্লভূমির নয়, সারা বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে রূপান্তর দেখা দেয়। হাম্বীর এবং তার পুত্র ও পৌত্র রঘুনাথ সিংহ এবং বীর সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তদশ শতাব্দীজুড়ে বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণবধর্মাশ্রিত সাহিত্য ও সংগীত, মন্দির-স্থাপত্য ও চিত্রকলা অভূতপূর্ব সৃজনশীলতায় বিকাশলাভ করে। এ সাংস্কৃতিক বিকাশ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অর্থাৎ ইংরেজ শাসনের সূচনাকালে বিষ্ণুপুর রাজাদের বিপর্যয় ঘটার পূর্ব পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থেকে বাংলার চিত্রশিল্পকে আধুনিককালে পৌঁছতে সেতু হিসেবে কাজ করেছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫