রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ড. ইউনূসের সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখনো বেশ সীমিত

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

জোশুয়া কারলানজিক

বেশকিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও ন্যূনতম স্থিতিশীলতা আনয়ন ও সরকারি পরিষেবা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। অতি ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী, তোষণমূলক অলিগার্ক নেটওয়ার্ক ও রাজনৈতিক দলগুলো এ পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে হাজির রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসে (সিএফআর) প্রকাশিত একটি ব্লগপোস্টে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নিয়ে তার মূল্যায়ন তুলে ধরেন জোশুয়া কারলানজিক। তিনি সিএফআরের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো। অনুবাদ করেছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার। এতে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীরা। দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতনে ঢাকাসহ সারা দেশেই শুরুর দিকে মানুষকে বেশ উল্লাস করতে দেখা গেছে। আগে বেশ কয়েকবার যেমনটা হয়েছে, এবার সামরিক বাহিনী তেমন হস্তক্ষেপ করেনি, নিজেরা ক্ষমতা দখল করে বসেনি। বরং তারা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সহায়তা করেছে। এ সামরিক বাহিনীই সাম্প্রতিক অতীতে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। হাসিনা পলায়নের পর থেকেই বেশকিছু ইতিবাচক কথা বলেছে সেনাবাহিনী। গ্রীষ্মের আন্দোলনে কঠোর দমন-পীড়ন ও নির্মমতায় জড়িতদের কঠিন শাস্তি দেয়ার কথাও বলেছেন তারা। 

দায়িত্ব গ্রহণ করেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার এবং ভবিষ্যতের কোনো একসময়ে নতুন নির্বাচনের পরিকল্পনা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রায় মাসদুয়েক পর দৃশ্যকল্প মনে হচ্ছে দ্বিদলীয় বলয়ের বাইরে বহুদলীয় ক্যানভাস দেখতে পারি। এদিকে ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার ন্যূনতম স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সংগ্রাম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী, সিভিল সার্ভিস, বিচার বিভাগ, পুলিশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংস্কার করার। এ সংস্কারগুলোর সবই যদি সফল হয়, তাহলে দশকের পর দশক ধরে চলা প্রায়ই সহিংস রাজনীতির ধারায় পরিবর্তন আসতে পারে। তোষণমূলক রাজনীতিতে গত কয়েক দশকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। 

ড. ইউনূস হয়তো তোষণমূলক অর্থনীতির কিছু সংস্কার করার চেষ্টাও করতে পারেন। পোশাক খাতের বাইরেও বিদেশী বিনিয়োগের দরজা খুলে যেতে পারে। এ সম্ভাবনা দেখে এরই মধ্যে নানা সংস্কারে সরকারকে সহায়তার জন্য বড় অংকের অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশে সংস্কার পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি কিছু প্রয়োজন। এগুলো আবার নিজে নিজে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো ডোনার কনফারেন্সের মতো কিছু ইভেন্ট আয়োজন করতে পারে। বিশেষত জাপান এ রকম বেশকিছু সম্মেলন আয়োজন করেছে। ডোনার কনফারেন্সের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আসতে পারে। এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার, নতুন নির্বাচনের প্রস্তুতি, অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হতে পারে।

কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো বিশ্ব এখন নানাবিধ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈদেশিক অংশীদারের মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরেই তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং ৫ আগস্টের পর নানা উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। ডোনার কনফারেন্স হয়তো ভালোভাবে নেবে না নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত চীনের দ্বারস্থই হতে পারে, যেমনটা শেষ বছরগুলোয় হাসিনা সরকার করে আসছিল। এতে ভারত, চীন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

এদিকে, সেনাবাহিনী থেকে অনেক প্রয়োজনীয় কথা আসছে। এতে হাসিনাকে উৎখাতকারী অ্যাক্টিভিস্ট এবং তরুণদের পুরো আস্থা আছে তা বলা কঠিন। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হচ্ছে, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের নেয়া সংস্কার পরিকল্পনা ‘যা-ই হোক না কেন সমর্থন করবে’। সেটা হতে পারে সামরিক বাহিনীতে বেসামরিক প্রভাব দূর করা থেকে শুরু করে তাকে আরো পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে কদাচিৎই এটা একটি পেশাদার বাহিনী ছিল। এছাড়া সেনাপ্রধান এটাও বলছেন এক থেকে দেড় বছরের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান কাম্য নয়। 

রাজনীতিতে জড়িত অনেক বাংলাদেশী তরুণের জন্য এটা বেশ দীর্ঘ সময়ই হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনা, বিশেষ করে ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হতে পারে। এরই মধ্যে দেখা গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, এমনকি সাধারণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থমকে দাঁড়িয়েছে। পুলিশকে কার্যকর বাহিনী হিসেবে দাঁড় করাতে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, যদিও গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এরই মধ্যে বিচারিক ক্ষমতা নেয়ার মাধ্যমে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে। অতীতেও অনেকবার এভাবে দায়িত্ব নিয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী। 

সর্বোপরি, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণ এখনো বেশ সীমিত। দেশের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ বিভিন্ন সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা দেয়ার কাজ করছে সেনাবাহিনী। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো (প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র স্তরের) পুরোপুরি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল, সেখান থেকে উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো বেশ নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আগস্টে তো পুলিশ বাহিনী একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এখনো স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। 

ড. ইউনূস নিজেই সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে মব ভায়োলেন্স ও খুনোখুনি একটি বড় সমস্যা। বেশ কয়েকটি জায়গায় আবার জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষেই আইন-শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য সরকারি পরিষেবা স্বাভাবিক করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদি তা এভাবে চলতে থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে দুর্বল করবে। অন্যদিকে সরকার যে বিস্তৃত সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তা প্রধান দুটো দলসহ বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের বাধার মুখোমুখি হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারই আনুক না কেন স্পষ্টতই দুটো দলের একটিই পরবর্তী নির্বাচনে জয়ের সবচেয়ে বড় দাবিদার। যদি দুটি প্রধান দলের মধ্যে একটি জয়ী হয়, তাহলে যেকোনো উচ্চাভিলাষী সংস্কার দীর্ঘস্থায়ী হবে সে ব্যাপারে আস্থা রাখা কঠিন।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫