রিমোট কন্ট্রোলের মুঠোয় জীবন

সব ক্ষেত্রেই উপস্থিতি ইলেক্ট্রো মার্টের

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

হংকংয়ের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ১৯৮০ সালে পরিচয় হয় ফেনীর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নূরুন নেওয়াজ সেলিমের। বিদেশী ওই বন্ধুর পরামর্শে তিনি টিভি আমদানি করে তা দেশের বাজারে বিক্রি শুরু করেন। প্রথমদিকে চট্টগ্রামে একটি ছোট অফিস নিয়ে হংকং ও সিঙ্গাপুর থেকে আনা ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করতেন পাইকারি দামে। পরবর্তী সময়ে জাপান, কোরিয়া, চীন ইত্যাদি দেশ থেকেও বিভিন্ন পণ্য এনে দেশের বাজারে সরবরাহ করেন। 

এ ট্রেডিং ব্যবসায় উদ্যোক্তা নূরুন নেওয়াজ সেলিমের পুঁজি ছিল মাত্র কয়েক লাখ টাকা। তার যোগ্য নেতৃত্বে পরে এ ব্যবসায় যুক্ত হন তিন সহোদর মো. নূরুল আমিন, মোহাম্মদ নূরুচ্ছাফা ও মো. নূরুল আফছার। চার ভাইয়ের কর্মদক্ষতা ও দিকনির্দেশনায় গড়ে ওঠে বৃহৎ ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনমুখী শিল্প গ্রুপ ইলেক্ট্রো মার্ট। যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় সাত হাজার লোকের। সেই সঙ্গে ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের বিশ্বমানের পণ্য পৌঁছে গেছে বাঙালির ঘরে ঘরে। প্রয়োজন মেটাচ্ছে গ্রাহকদের চাওয়া-পাওয়ার। 

বাংলাদেশে যেকোনো কারখানা নির্মাণের বড় চ্যালেঞ্জ পছন্দমতো জমি খুঁজে পাওয়া। সেই সঙ্গে কারখানার জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির জোগান পাওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি ও নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। ফলে চাইলেও পূর্ব নির্ধারিত সময়ে কারখানা চালু করা সম্ভব হয় না। ইলেক্ট্রো মার্টেরও চ্যালেঞ্জ শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ দিয়ে। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রথমে ১০ বিঘা জমির ওপর দুটি বিল্ডিং তৈরি করে ২০১৮ সালে তাদের কারখানার কাজ শুরু হয়। উৎপাদন শুরু হয় কনকা ব্র্যান্ডের পণ্য যৌথ কারিগরি সহযোগিতায়। ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে এখন প্রায় ৬০ বিঘা জায়গাজুড়ে সাত-আটটি বিল্ডিংয়ে চলছে ইলেক্ট্রো মার্টের কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে ২০২০ সাল থেকে গ্রী-এর সঙ্গে যৌথভাবে পণ্য উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

কারখানা চালুর চেয়ে ইলেক্ট্রো মার্টের ব্যবসা শুরুর গল্প অনেক বড় আর পুরনো। কনকা টিভি আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যে রঙিন টিভি বাজারে এনেছিল তারা। গ্রী ব্র্যান্ডের মাধ্যমে মানুষকে সহজলভ্য এসির অভিজ্ঞতাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আমদানির মাধ্যমে দেশে ব্যবসা শুরু করলেও কনকা ও গ্রী-এর মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের গায়ে এখন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্রেডমার্ক লাগিয়েছেন ইলেক্ট্রো মার্টের প্রতিষ্ঠাতা মো. নূরুন নেওয়াজ সেলিম। 

কনকা, গ্রী ও নিজেদের হাইকো ব্র্যান্ডের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বিশাল বিনিয়োগে চালু হয় ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে ইলেকট্রনিকস প্ল্যান্ট। সেখানে বিদেশী টেকনোলজি ব্যবহার করে উৎপাদন হচ্ছে হাইকো ব্র্যান্ডের পণ্যও। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যৌথভাবে বাংলাদেশের জন্য পণ্য তৈরির প্রয়োজনে রয়েছে নিজস্ব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ। দেশের আবহাওয়া ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন মডেল নিয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) টিম। এ খাতে আরো বিনিয়োগ করে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপ। 

কনকা, গ্রী ও হাইকো ব্র্যান্ডের ফ্রিজ, এসি ও সিলিং ফ্যান শতভাগ নিজেদের কারখানায় তৈরি করে ইলেক্ট্রো মার্ট। টিভি, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকুলার, এয়ারকার্টেন, ডিহিউমিডিফায়ার ও অন্যান্য হোম অ্যাপ্লায়েন্সের পণ্যের বেশকিছু যন্ত্রাংশ আমদানি করে দেশে সংযোজন করা হয়। এ গ্রুপের কনকা ও হাইকো ফ্রিজ অন্যদের চেয়ে আলাদা। দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা থাকায় ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ প্রযুক্তি। ফলে ১২৫ থেকে ২৬৫ ভোল্টেজ পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি আপডাউন করলেও আলাদা করে ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের কোনো প্রয়োজন হয় না। ইলেকট্রিক ফ্লাকচুয়েশন বা শর্ট সার্কিটের কারণে যেন ক্ষতি না হয় তার জন্য ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে ডাবল ইলেকট্রিক প্রোটেকশন টেকনোলজি। বিদ্যুৎ সাশ্রয়, শব্দদূষণ রোধ এবং দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে স্মার্ট ইনভার্টার টেকনোলজি। 

ফ্রিজে ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ডোর গ্যাসকেট সমন্বয় করা হয়েছে, যার কারণে দরজাটি শতভাগ এয়ারটাইট এবং কোনো ফাঙ্গাল অ্যাটাক হয় না। একটি বাগানে সবজি যেমন ভিটামিনসমৃদ্ধ ও ফ্রেশ থাকে, ভিটামিন ফ্রেশ টেকনোলজির মাধ্যমে ফ্রিজেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত সবজিগুলো ফ্রেশ থাকে। বাংলাদেশে কনকা ফ্রিজেই প্রথম ডোর অ্যালার্ম টেকনোলজি ব্যবহার হয়েছে। ৩০ সেকেন্ডের বেশি ফ্রিজের দরজা খোলা থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সচেতনতামূলক অ্যালার্ম দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ব্যবহার করা হয় আমেরিকান এফডিএ সার্টিফায়েড ১০০% ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক ম্যাটেরিয়াল। ফ্রিজের লাইনারে ব্যবহার হয় এনভায়রনমেন্টাল স্ট্রেস ক্র্যাকিং রেজিস্ট্যান্স সমৃদ্ধ প্লাস্টিক, যা ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। কনকা ফ্রিজের অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ডিওডোরাইজার ব্যাকটেরিয়াকে ৯৯.৯% পর্যন্ত ডিঅ্যাক্টিভ করে খাবারের গুণগত মান ঠিক রাখে। ফলে এক খাবারের গন্ধ আরেক খাবারে যায় না। খাবার ভালো থাকে দীর্ঘদিন। 

দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে নিজেদের উৎপাদনক্ষমতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই এসি তৈরি করছে ইলেক্ট্রো মার্ট। শুরুটা অবশ্য আমদানি দিয়ে, চায়নার জনপ্রিয় ব্র্যান্ড গ্রী-এর এসি ১৯৯৮ সালে দেশে এনে বিক্রি শুরু করে তারা। অর্থাৎ বৈশ্বিক এ কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে মার্কেটিং শুরু করে। তারপর ২০০৪ সালে দেশেই অ্যাসেম্বলিং ফ্যাক্টরি করে। পূর্ণাঙ্গ জয়েন্ট ভেঞ্চারে ফ্যাক্টরি স্থাপন কার্যক্রম শুরু করে ২০১৫ সালে। এখন পুরোপুরি বাংলাদেশেই তৈরি হয় বিশ্বের এক নম্বর এসি গ্রী । জনপ্রিয় এ ব্র্যান্ডের এসি জিরো কার্বন সোর্স অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত। এতে রেফ্রিজারেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয় পরিবেশবান্ধব আর৩২ গ্যাস। একই সঙ্গে এই এসি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। বিশ্বের প্রথম জি-বুস্ট ইনভার্টার কমপ্রেসার থাকায় গ্রী এসি সর্বাধিক মাত্রায় ৭০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে। গ্রী এসি ন্যানোটেকনোলজি জি-বুস্ট কমপ্রেসার প্রযুক্তিসমৃদ্ধ। টি-৩ ওয়ার্কিং কন্ডিশনে এয়ার ফ্লো সর্বনিম্ন ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে, যা গ্রাহককে দেবে চূড়ান্ত শীতলতা ও আরামদায়ক অবস্থান।  

দেশে বর্তমানে ইলেক্ট্রো মার্টের সরাসরি আউটলেট রয়েছে ৭০টিরও বেশি। কোম্পানির অর্থায়ন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন যৌথ এক্সক্লুসিভ পয়েন্ট রয়েছে ১০০টির মতো। একই সঙ্গে চ্যানেল পার্টনার ও পার্টনারের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। ফ্রিজ ও এসিতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত সমাধানের জন্য সারা দেশেই রয়েছে নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার। আছে সেন্ট্রাল কল সেন্টার। ১৬৬৪৯ বা ০৯৬৭৮৩৩৩৬৬৬ নম্বরে ডায়াল করে গ্রাহক কোনো অভিযোগ জানালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা সমাধান করতে রয়েছে নিজস্ব টেকনিশিয়ান।    

দেশের বাজার দখলের পাশাপাশি নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত ফ্রিজ, এসি ও সিলিং ফ্যানসহ সব ধরনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স রফতানির পরিকল্পনাও রয়েছে ইলেক্ট্রো মার্টের। তাই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন যন্ত্র যোগ করে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো ও কারখানার সম্প্রসারণে কাজ করছে তারা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫