আলোকপাত

পতনের মুখে ব্যাংক খাত, দায় কার?

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪

ড. এ কে এনামুল হক

ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুরবস্থা এখন আর গল্পের বিষয় নয়, প্রকৃত সত্য। কিছুদিন আগে আমি কয়েকটি চেক ইস্যু করেছিলাম আমার অফিস থেকে। দুদিন পর আমার সহকর্মী জানাল, স্যার চেক ফেরত পাঠিয়েছে ব্যাংক। অবাক হলাম। বেশি টাকার চেক নয়। তবে কি ব্যাংক আমাকে চেক ক্লিয়ার করার ফোন করে পায়নি? মোবাইলে চেক করে দেখলাম নাহ্‌, ব্যাংকের কোন কল আসেনি। বিব্রত ও লজ্জিত হলাম। ফোন করলাম ব্যাংকেরই একজনকে। কী ব্যাপার? সহজ উত্তর ব্যাংকে ক্যাশ সংকট। সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে যাওয়ায় এ দুরবস্থা। আমরা হিমশিম খাচ্ছি। কোথাও ক্যাশ পাচ্ছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকও কিছু সাহায্য করছে না।

সরকার পতন কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে গভর্নরের পলায়ন কিংবা খতিবের পলায়ন মনে করিয়ে দেয় পচন কত দূরে পৌঁছেছিল। তবে এখন তো নতুন গভর্নর। আইএমএফ পাস। বহুদিন সেখানে চাকরি করেছেন, তার এ দুরবস্থা কেন? উত্তর নেই। হয়তোবা আইএমএফ থেকে ফর্মুলা আসেনি। তাকে সমালোচনা করতে আমি বসিনি। তবে তার অক্ষমতা কি শেষ পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলবে। আমার দুরবস্থা বোঝেন। সহকর্মীর কাছে লজ্জিত। এ ব্যাংকে কি টাকা রাখা যায়? হাজার হাজার আমানতকারীর কথা ভাবুন।

দেশের ব্যাংক খালি। গালগল্পে সবাই মশগুল। কিন্তু কেন? হতে পারে ব্যাংকগুলোর তথাকথিত মালিক বা লুটেরারা নামে-বেনামে টাকা তুলে নিয়েছেন। কিন্তু কোনো ব্যাংক অফিসার কি এ কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন। কাগজপত্র ছাড়া শুধু মুখের কথায় ভোল্ট খুলে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা তো বহু আগেই পতিত সরকার থাকাকালেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। তখন অভিযোগ হয়নি সংগত কারণেই। তবে এখন কেন সেই অভিযোগে কেউ অভিযুক্ত হচ্ছেন না! যাকেই জিজ্ঞাসা করবেন—এক উত্তর। প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার দলের কেউকেটাদের কেউ কাজটি করেছেন। বাকি যারা বিভিন্ন পদে রয়েছেন তারা কেবল হুকুম পালন করেছেন। তারা সাধু-সন্ন্যাসী কিংবা বলতে পারেন অনুগত গোলাম। অনুগত গোলামের শাস্তি নেই? তারা তো দাস ছিলেন না যে দাসত্বের কারণে তাদের অপরাধ বিবেচিত হবে না। গরু যখন অন্যের জমির ঘাস খায় তখন বিচারে গরুর শাস্তি হয় না। শাস্তি হয় মালিকের। আমাদের অফিসগুলোয় কি সবাই গরু? প্রত্যেকের দায় ও দায়িত্ব ছিল। তাদের শাস্তি না হলে আবারো একই অবস্থা ফেরত আসবে। পরিবর্তন হবে না। কেবল সরকারের পতন নিয়েই আমাদের খুশি থাকতে হবে। নতুন বাংলাদেশ আর হবে না।

ব্যাংক খালি কিন্তু সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কেবল টক শো করছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন—গেল গেল সব নিয়ে গেছে! এমনতর বক্তব্য দেয়ার সময় শিগগিরই শেষ হবে। কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সরকারকে। গভর্নর বলেছেন, যেসব ব্যাংকের ক্যাশ সংকট তাদের তারল্য সহায়তা দেয়া হবে। এ পর্যন্তই। তরল কিছুর দেখা মেলেনি। তারা নিজেরই ঢাকঢোল বাজিয়ে বলেছেন ১০-১১টি ব্যাংকের অবস্থা ভালো না। কী দরকার ছিল এ বক্তব্যের? তাতে কি ব্যাংকগুলোর ওপর গ্রাহকের আস্থা বাড়বে? নিশ্চয় নয়। দায় কি শেষ পর্যন্ত আমানতকারীর ওপর বর্তাবে? বিষয়টির ব্যাখ্যা করা দরকার। 

আমাদের দেশে শাখা ব্যাংকিং পদ্ধতি। এখানে একই ব্যাংকের শত শত শাখা রয়েছে। অধিকাংশ শাখায় ব্যাংকারকে ভরসা করে মানুষ তাদের অর্থ আমানত রাখে। এদের অধিকাংশই সাধারণ জনগণ। গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অধিকাংশ শাখায়ই বিনিয়োগের চেয়ে জমা বেশি। দেশের অর্থনীতি সমানভাবে সারা দেশে বিস্তৃত না হলে শাখা ব্যাংকিং ছাড়া ব্যাংক চলবে না। ব্যাংকগুলো শাখার উদ্বৃত্ত টাকা যেসব শাখায় কর্মযজ্ঞ বেশি বা বিনিয়োগের চাহিদা বেশি সেখানে স্থানান্তর করে। বিনিয়োগের লাভ শেষ পর্যন্ত আমানতকারী ভোগ করে। এটাই শাখা ব্যাংকিংয়ের ধর্ম। যেহেতু আমানতকারীর শাখা ও বিনিয়োগকারীর শাখা এক নয়, তাই আমানতকারীদের আস্থার স্থান কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের তৈরি নীতিমালা, নির্দেশনা ও তাদের দক্ষতার ওপর শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থা নির্ভর করে। অন্যদিকে শাখাবিহীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীর একই ব্যাংক। তাই সেখানে ব্যাংকারের ওপর আস্থা রেখেই চলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। মার্কিন মুলুকে এ ব্যবস্থা প্রচলিত তাই দেখবেন অতিসহজেই সেখানে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। একটি ব্যাংক দেউলিয়া হলে সেখানে কেবল একটি শাখাই দেউলিয়া হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় কেবল আমানতকারীদের অর্থের গ্যারান্টি তৈরি করা (আংশিক বা পূর্ণ)। শাখা ব্যাংকিংয়েও এ ব্যবস্থা রয়েছে তবে তা কেবল কাগজে-কলমে। এখানে কোনো ব্যাংকের পতন হলে লাখ লাখ আমানতকারী বিপদে পড়েন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় এখানে এতটাই বৃহৎ হবে যে তা মেটানো অসম্ভব হয়। তাই দেখবেন এখানে গভর্নর কখনই ব্যাংক দেউলিয়া হতে দেয় না। নিজের অক্ষমতার দায় এড়ানোর জন্য অন্য এক অক্ষমকে ব্যাংকের প্রশাসক হিসেবে বসিয়ে দিয়ে বাহবা কুড়ায়। ভাবখানা এই যে অনেক কিছু করলাম, লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির! প্রশাসক বসিয়ে ব্যাংক বাঁচানোর চেষ্টা নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার নামান্তর। যখন ব্যাংক অনিয়ম করছিল তখন কিছুই করেননি। এমনকি তার জন্য কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা আজও অভিযুক্ত হলেন না, এখন বলছেন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে! এ রকম দায়সারা গোছের বক্তব্য কেবল পুরনো বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দেয়, নতুন বাংলাদেশকে নয়। নতুন বাংলাদেশের সংজ্ঞার সঙ্গে তা মানায় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলল, তারল্য সহায়তায় তারা গ্যারান্টি দেবে। কিন্তু কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি পাচ্ছে না কিংবা তা নিতে রাজি হচ্ছে না। হয়তোবা কল মানিরেট অনেক বেশি। প্রতিনিয়ত সুদের হার বাড়ালে এসব ব্যাংক আরো বিপদে পড়বে। অথবা হতে পারে সব ব্যাংকই ক্যাশ সংকটে ভুগছে কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি ব্যাংকারদের নির্ভরতা দিতে পারছে না। হয়তোবা কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বাংলাদেশ ব্যাংক দিতে পারেনি। যা-ই হোক না কেন, ব্যাংকের নগদ অর্থের অভাব হলে আমানতকারীরা গণহারে টাকা উঠিয়ে নিতে চাইবে। সেক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় ধস নামবে। 

আমার এক সহকর্মী জিজ্ঞাসা করল, সুদের হার বাড়িয়ে যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমানো যায় না তা তো আমি পড়িয়েছি। কিন্তু এখন সেই নীতি কেন? তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। চাঁদাবাজি নেই, পুলিশ ভদ্র হয়ে গেছে কিন্তু দাম কমছে না। কমবে কী করে? ব্যবসার মূলধনের খরচ তো বেড়ে গেল। আমাদের দেশে তো মূল্যস্ফীতি তৈরি হয় চাহিদার চেয়ে জোগান কম বলেই। চাহিদা কমানোর সুযোগ কোথায়। কী উত্তর দেয়া যায়! ভেবে বললাম, হয়তোবা সুদের হার বাড়িয়ে মানুষের হাতের নগদ টাকা ব্যাংকে ফেরত আনার প্রচেষ্টা চলছে। না স্যার মানুষ এত পাগল না। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে পারে। কেন? কারণ ব্যাংক যেখানে নির্ভরযোগ্য নয় সেখানে পাগল না হলে কেউ কি টাকা ব্যাংকে রাখবে? আর যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ব্যাংকগুলোর ওপর ভরসা রাখতে পারছে না সেখানে তো বটেই। তবে ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি সবাই (যেমন দুদক কিংবা এনবিআর) বিনা ওয়ারেন্টে খোঁজ পেয়ে যায় তাহলে সেখানে টাকা রাখা মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা। তাই রাজনীতিবিদ কিংবা ধান্দাবাজরা টাকা ব্যাংকে রাখে না। ওরাই বুদ্ধিমান। ঠকে গেল আমাদের মতো লোকরা। যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছিল। আমরা জানি, বাজার ব্যবস্থায় আস্থাই আসল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের প্রতি আস্থা তৈরি করা। 

ব্যাংক কমিশন কাজ করছে। সংস্কার হবে। মনে পড়ে গেল বাংলার সেই বিখ্যাত প্রবাদবাক্যটি ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেছে। সংস্কার দরকার। ব্যাংক চোর গুটিকয়েক। কিন্তু সব ব্যাংকই কীভাবে বিপদে পড়ে? প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। আমানতকারী ও ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের রক্ষা করার জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র পরিচালক। তাদের দায় কী ছিল? তারা কি অভিযুক্ত হবেন না? তাদের অনেকেই ছিলেন রাজনৈতিক মদদপুষ্ট (সরকারি ব্যাংকে) কিংবা সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব বা সমজাতীয় কর্মচারী (বেসরকারি ব্যাংকে)। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে, তাদের অনেকেই ছিলেন ব্যাংক মালিকের পোষ্য যারা তাকে ব্যাংক দখলে সহায়তা করেছিলেন। বিষয়টি বললাম, কারণ তাদের সবার ব্যর্থতার দায় কেবল এস আলম কিংবা সালমান এফ রহমানের ওপর দিয়ে চালালে ভবিষ্যতে আরো অনেকেই একই পথে পা বাড়াবেন। 

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ২০১৪ সাল। এক বন্ধু আমাকে দাওয়াত দিলেন এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজনে। আমাকে ও অন্য এক অধ্যাপককে। কী কারণ! বুঝে উঠতে পারলাম না। হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবেন! তাই গেলাম। সেখানে অন্য এক অবসরপ্রাপ্ত সচিব উপস্থিত। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। গল্প করতে ভালোবাসেন। দেশের অর্থনীতি নিয়ে তার প্রচণ্ড আগ্রহ। সেই ২০১৪ সালেই তিনি দেশে দুর্নীতির প্রসারে অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন। বললেন দেশ রসাতলে গেছে। শিক্ষকরা এখন শিক্ষকতা করতে চান না। ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বন্ধু অধ্যাপক আসতে আসতে বললেন, আপনি খুব একটা আলোচনায় জড়ালেন না। কেন? বললাম ঠিকই ধরেছেন। কিছু বলিনি, কারণ তিনি একজন সাবেক সচিব আর এ ব্যবসায়ী সেই মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রাক্টর। তিনি অবসর গ্রহণ করে তারই কন্ট্রাক্টরের অফিসে বসে আমাক শোনাচ্ছেন দুর্নীতির কথা! আমি কি বলতে পারি তাকে? চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।

শেষ কথায় আসি। ব্যাংকের দুর্বলতার অনেক কারণ রয়েছে। মূলত দায় রয়েছে ব্যাংকারদের, মালিকদের, স্বতন্ত্র পরিচালকদের এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের। অথচ এখন মনে হচ্ছে সব দায় এস আলমের আর আমানতকারীদের! এস আলম টাকা নিয়েছেন, দেশ ছেড়েছেন, নাগরিকত্ব পরিবর্তন করেছেন। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে আপাতত। ফেঁসে গেছেন আমানতকারীরা। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল বোর্ড বদলিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজন দায়িত্ববোধ। 

ড. এ কে এনামুল হক: অর্থনীতিবিদ ও পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫