বেড়েই চলেছে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৪

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

চাল ও গমের পর দেশের প্রধানতম ভোগ্যপণ্য ভোজ্যতেল ও চিনি। গুরুত্বের বিচারে দ্বিতীয় সারিতে থাকলেও ভোগ্যপণ্যের সার্বিক বাজারের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এ দুটি পণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। দেড় মাসের মধ্যে পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৮ ও চিনি কেজিপ্রতি বেড়েছে ৭-৮ টাকা। আমদানি প্রক্রিয়ায় ডলার ও ব্যাংক খাতের জটিলতা কমে এলেও বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধিকে এর জন্য দায়ী করছেন আমদানিকারকরা। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনজনিত কারণকেও সামনে আনছেন ব্যবসায়ীরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক মাস আগেও ডলারের উচ্চ মূল্য, ঋণপত্র খুলতে বিড়ম্বনায় ছিলেন আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এলসি মার্জিনে শিথিলতাসহ ডলারের বিনিময় মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকায় আমদানিতে সংকট অনেকটাই কমে এসেছে। তবে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে দেশের বাজারে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম। গত চার-পাঁচ মাস ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে পণ্য দুটির দাম পুনর্নির্ধারণ না হওয়ায় পাইকারি বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোজ্যতেলের দামের বিষয়ে আমরা বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। দেশীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে বিগত সরকার আমদানির ওপর আরোপিত নানামুখী শুল্ক কাটছাঁট করে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। মাঝে দেশে আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ভোজ্যতেল কিংবা চিনির বাজার নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আমদানিকারকরা ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের আবেদন করলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বাজারে মোড়কজাত সয়াবিন ও চিনি আগের নির্ধারিত দামে লেনদেন হলেও খোলা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে আমদানিকারকদের নির্ধারিত দামে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের দাম দেড় মাসে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) প্রায় ৭০০ ও চিনির দাম মণপ্রতি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২০০ টাকার বেশি। 

দেশের অন্যতম ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক মাস আগেও পাম অয়েলের বুকিং ছিল টনপ্রতি ৯০০ ডলারের কিছু কম। বর্তমানে বুকিং বেড়ে ১ হাজার ৮০ ডলারে পৌঁছেছে। ফলে পাম অয়েলের দাম সয়াবিনকেও ছাড়িয়ে গেছে। চিনির বাজারও বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে। তাই বাজার তার স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে। এতে আমদানিকারকদের কোনো দায় নেই।’  

আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৭ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ান পাম অয়েলের বুকিং দর ছিল টনপ্রতি ৩ হাজার ৭৫২ দশমিক ৬ রিঙ্গিত। বুধবার তা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭০ রিঙ্গিত। অর্থাৎ তিন সপ্তাহের ব্যবধানে পাম অয়েলের বুকিং দর বেড়েছে ৩১৮ ডলার। অন্যদিকে ১০ সেপ্টেম্বর অপরিশোধিত চিনির বুকিং দর ছিল প্রতি পাউন্ড ১৮ দশমিক ৫৪ সেন্ট। যদিও সর্বশেষ গতকাল প্রতি পাউন্ড চিনির বুকিং দর বেড়ে লেনদেন হয়েছে ২৩ দশমিক ২৪ সেন্টে। সে কারণে দেশের পাইকারি বাজারে চিনির দাম মণপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকায়। সাম্প্রতিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় চিনির বাজার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। 

বিশ্ববাজারে বুকিং দর বাড়লেও দেশের বাজারে দ্রুত মূল্যবৃদ্ধিকে অবশ্য অযৌক্তিক বলে মনে করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, বিশ্ববাজারে দুই সপ্তাহ আগেও পাম অয়েলের দাম ছিল খুবই কম। কিন্তু সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে আমদানিকারকরা বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমান দামেও পাম অয়েল আমদানি হলে মণপ্রতি ৫ হাজার টাকার নিচে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। অথচ পাইকারি বাজারে মণপ্রতি পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত এক সপ্তাহে সয়াবিন তেলের দামও মণপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৬ হাজার ১০০ টাকায়।

দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। এখান থেকেই প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সারা দেশের বাজারগুলোয় সরবরাহ হয়। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাইকারি বাজার কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেও পরবর্তী সময়ে লেনদেন শুরু হলে ভোজ্যতেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। ওই সময় মণপ্রতি পাম অয়েলের দাম ছিল ৪ হাজার ৮০০ টাকা। সেই দাম উঠে গেছে ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। এসও (সাপ্লাই অর্ডার) পর্যায়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকা হলেও খুচরায় প্রতি মণে দাম আরো ২০০ টাকা বেড়েছে। পাম অয়েল, সুপার পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের পাশাপাশি বাড়তে শুরু করেছে চিনির দামও। মূলত তীব্র গরমে চাহিদা বৃদ্ধিতে সরবরাহ চাপে চিনির দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে গত সপ্তাহে মণপ্রতি পরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। 

পাইকারি ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বেসরকারি পর্যায়ে চিনির মিল রয়েছে মাত্র একটি। সেই এস আলম সুগার মিল নিয়ে পাইকারি বাজারে একাধিক গুজবের কারণেও চিনির বাজার বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। গত সপ্তাহের শেষ দিকে মণপ্রতি চিনি এসও পর্যায়ে লেনদেন হয়েছিল ৪ হাজার ৩৫০ টাকায়। যদিও গতকাল লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ৫২০ থেকে ৪ হাজার ৫৫০ টাকায়। বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় প্রতি মুহূর্তেই দাম বাড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে ডাল, মসলাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী হলেও ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ছে। এর কারণ পণ্য দুটির যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে সে অনুপাতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে দাম বাড়ছে। সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার মনিটরিং কমিটির নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে মিলগুলো থেকে সরবরাহ বাড়াতে না পারলে নিত্যপণ্য দুটির দাম আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫