সাক্ষাৎকার

পরাধীন আমলে তৈরি হওয়া নন্দনতত্ত্ব এখনো প্রভাবশালী

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪

অভ্যুত্থানে জনমনস্তত্ত্ব গড়ে তোলায় চিত্রশিল্প কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেবাশিস চক্রবর্তী। জুলাইয়ের অভ্যুত্থান চলাকালে তার সৃষ্টিকর্ম ঘুরেফিরে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দেয়ালে। তিনি তার শিল্পভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ দীন রুমি

অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান দেখেছে বাংলাদেশ। ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে আপনার সৃষ্টিকর্ম। কাজের এমন স্বীকৃতিকে কীভাবে দেখছেন?

সত্যি বলতে খুব একটা উত্তেজিত বোধ করছি না। তবে এটা ঠিক কাজগুলোর মোক্ষম ব্যবহার হয়েছে। কাজে দিয়েছে। বহু মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিয়েছে।

শিল্পীরা সমাজের কণ্ঠস্বর। অথচ গত দিনগুলোয় ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্ন না করার ক্ষেত্রে অঘোষিত ঐকমত্য দেখা গেছে। এমনটা হলো কেন?

ব্যক্তিগতভাবে আমি শিল্পীদের ওপর অতিরিক্ত মাহাত্ম্য আরোপ করতে চাই না। একটু খেয়াল করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। অন্য নানা পেশাজীবীর মধ্যেও নির্লিপ্ততা ছিল। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিল্পীরা নিজেদের এক্সক্লুসিভলি সাংস্কৃতিক পরিসরের লোক বলে মনে করেন। জনমানসেও তাদের চেহারা-ছবি সাংস্কৃতিক। ভেজালটা আসলে এখানেই। বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতির মতো সাংস্কৃতিক রাজনীতিও দুভাগে বিভক্ত। অ্যাসেন্সিয়ালাইজেশনের ঝুঁকি সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে, সাংস্কৃতিক পরিসরের একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগের শাসনে মানসিক আরাম পান। গত এক দশকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের পজিশন রিভাইস করতে পারেননি। বিপদটা এখানেই হয়েছে। তাছাড়া কিছু মানুষ যে সরাসরি সুবিধাভোগী সেটা সবাই জানেন। তাদের পক্ষে চাইলেও প্রতিবাদী-প্রতিরোধী অবস্থান নেয়া সম্ভব ছিল না। এছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর শিক্ষা ব্যবস্থার মতো শিল্পশিক্ষায়ও ভেজাল আছে। উপনিবেশিক রোগ আছে। মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন এবং স্বশাসিত জনগোষ্ঠীর মানসিক গঠন-বিকাশের উপযোগী না। পরাধীন আমলে তৈরি হওয়া শিক্ষাব্যবস্থা এবং নন্দনতত্ত্ব এখনো প্রভাবশালী। যেখানে আমাদের পূর্বজ আর্টিস্টের পক্ষে নাগরিক হওয়া সম্ভব ছিল, জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না, সে সময়ের চিন্তাধারা এখনো মোটাদাগে প্রভাবশালী। আমি বলছি না যে সে সময়ের আর্টিস্টরা তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেননি। কিন্তু তাদের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব ছিল না। আরোপিত দুর্বোধ্যতা বিচ্ছিন্নতার বাতিক ছিল। ধারাই মূলধারা। যাকে বলা যায় প্রতিক্রিয়াশীল আধ্যাত্মিকতা আক্রান্ত। বলয়ের মধ্যেই যেকোনো আর্টিস্টকে বেড়ে উঠতে হয়। আমাকেও বেড়ে উঠতে হয়েছে। আমার শুরুর দিকের কাজগুলোকেও প্রতিক্রিয়াশীল আধ্যাত্মিকতার আবহে পড়া যাবে। বলার মানে এই যে সামষ্টিক যে আবহ বিরাজ করছে, তাতে দলছুট কিছু ব্যক্তি আর্টিস্ট পাওয়া গেলেও সামষ্টিকভাবে বহু আর্টিস্ট পাওয়া যাবে না। একে তো রাজনীতির সংস্কৃতির কারণে পুরনো ধারার আর্টিস্টরা বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, বিশেষ-বিশেষ মতাদর্শের ওপর অনড় আস্থা প্রকাশ করেন, আরেকদিকে সৌন্দর্য উৎপাদনের উছিলায় বিচ্ছিন্নতা উদযাপনের বাতিক আছে। দুই রোগের কারণে বিপদটা ঘনীভূত হয়ে থাকতে পারে। এখানে বলে রাখা ভালো আর্টিস্ট বলতে কবি, সাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকা, চিত্রকর, ভাস্কর ইত্যাদি সবাইকে বুঝিয়েছি।

যেকোনো গণ-অভ্যুত্থানের পর শিল্প সংস্কৃতিতে নয়াযুগ প্রবণতা তৈরি হয়। তেমন কোনো সম্ভাবনা সামনে দেখছেন কি?

শুধু শিল্প-সংস্কৃতি না, অপরাপর সব পরিসরেই নতুন প্রবণতা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সময় খুব অল্প গেছে। তবে প্রাত্যহিক অনুশীলনের লিপ্ততার ওপর নির্ভর করছে এর ভবিষ্যৎ।

আন্দোলনের বড় অংশজুড়ে ছিল আনাড়ি হাতের গ্রাফিতি দেয়ালচিত্র। চিত্রকরদের কেউ সে অর্থে পেশাদার না। আঁকাও হয়েছে গেরিলা কায়দায়, তার পরও জনগণকে ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেছে। শিল্পের সঙ্গে জনমনস্তত্ত্ব নিয়ে কিছু জানতে চাই।

বহু মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বলেই আমরাগণ-অভ্যুত্থান কথাটা বলতে পারছি। তত্ত্বায়নের জায়গা থেকে একেকালচারাল রেজিস্ট্যান্স বাসাংস্কৃতিক প্রতিরোধ বলা চলে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের গতিপ্রকৃতিই রকম। আনাড়ি হাতে আঁকা, হেঁড়ে গলায় গাওয়াএসবই সংগ্রাম-প্রতিরোধের অংশ। হাই-আর্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার লেন্স থেকে দেখলে একে বোঝা যাবে না। দেশে দেশে, নানা সময়ে, প্রবল প্রতাপ ক্ষমতা বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ এমন গেরিলা কায়দায়ই হয়েছে হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে দেশে সবার আগে কোন দিকগুলোকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন বলে মনে হয় আপনার?

অচল রাষ্ট্রকাঠামোয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র চলছে, ব্যাপারে অনেকদিন ধরেই; এমনকি অবদমিত অবস্থায়ও বাংলাদেশে নানা পক্ষ একমত ছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী নিপীড়ক চরিত্রের বদলে কল্যাণকর চরিত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার-পুনর্গঠন, নানা উদ্যোগ আয়োজনের মাধ্যমে প্রাথমিক শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের আয়-উন্নতির ব্যবস্থা করা সম্ভব।

নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে অপটিক্যাল ফটোগ্রাফিক টেকনিককে বেছে নেয়ার পেছনে কোনো গল্প আছে কি?

আমার প্রাইমারি প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং ফটোগ্রাফির, বিশেষত ডকুমেন্ট্রি ঘরানার। তবে ব্যক্তিগত ঝোঁক অপটিকসের দিকে। অপটিকসের দিকে ঝোঁকটা ঠিক সচেতন না। বেড়ে ওঠার সময়ই আগ্রহটা তৈরি হয়েছিল। কেন হয়েছে জানি না। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার শুরু দিকেও সে ঝোঁকটা কাজ করেছে। ব্যাপারটা অনেকটা শিশুর ভাষা শিক্ষার মতো। যতটা না সচেতন তার চেয়ে বেশি অচেতন। প্রাথমিক সময় তাই নিজের প্রবণতাগুলোই অনুসরণ করেছি। পরে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার পর নানা জটিলতা, ক্ষমতা-সম্পর্কের অসম অবস্থার ব্যাপারে সজ্ঞান হওয়ার পরে সচেতনভাবেই কাজের বিষয়বস্তু নির্ধারণের এবং প্রয়োজনমাফিক বিভিন্ন কারিগরি দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছি। এটা দ্বিতীয় পর্যায় বলা চলে। যদি দীর্ঘজীবন পাই সক্রিয় থাকার সৌভাগ্য হয়, তবে তৃতীয় পর্যায়েও পৌঁছানো সম্ভব হবে। তৃতীয় পর্যায়ে শুধু আর্টিস্ট না সব সক্রিয় মানুষের বেলায় ধারণা খাটে, আগে থেকে ঠিক করা অনড়-অচল কোনো পজিশন ঠাঁই দাঁড়িয়ে না থেকে ক্রমে বদলে যাওয়া জটিল পৃথিবীর সঙ্গে ক্রিটিক্যালি সম্পৃক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত নিজের পজিশন রিভাইস হতে থাকবে। বাংলাদেশে পূর্বজদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা আমরা নিতে পারি। দীর্ঘজীবনে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে কোনো রকম বাছবিচারে না গিয়ে অনেকেই অনড়-অচল অবস্থানে ছিলেন। জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হতে পেরে, মহৎ-বৃহৎ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন। সাবধানতার জন্য বলে রাখি, মহৎ-বৃহৎ হওয়াটাই কারো একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। সময় মানুষই সেটা ঠিক করে দেয়। আবার লজ্জা-বিনয়বশত নির্বিষ হয়ে থাকাটাও কাজের কথা না।

সমাজ রাষ্ট্রের কাছে শিল্পী শিল্পের দায়টা কোথায় আসলে? ‘আর্ট ফর আর্ট সেইক দিনশেষে কতটুকু থই পায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দাবির সামনে?

আগে যেমনটা বলেছি আর্ট বা আর্টিস্টকে আমি বেশি মাহাত্ম্য দিতে রাজি নই। তবে আর্টের বিশেষ কিছু গুণাবলি নিশ্চয়ই আছে। হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতায় আর্টের নানা ফর্ম টিকে আছে। কারণ আছে বলেই টিকে আছে। আর্ট মানুষের জীবনকে ইমিটেট করতে পারে। অনুপস্থিত বাস্তবতা হাজির করতে পারে। আর্টের নানা ফর্মে মানুষ তার নিজের মুখ দেখতে পায়। ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষাকে আর্ট ধারণ করতে পারে, ভাষাহীনকে ভাষা দিতে পারে। যে যতটা কার্যকরভাবে, সক্ষমতার সঙ্গে কাজটা করতে পারে, তার কাজ তত বেশি গ্রাহ্যতা পায়। এখানে বলে রাখা ভালো, আর্টিস্টের কাজের এরিয়া বা পরিসর থাকে। ব্যক্তি আর্টিস্ট যেমন প্রেম-দুঃখ-স্বপ্নে আক্রান্ত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করার তাড়না পান, ঠিক তেমন বৃহৎ-সামষ্টিক পরিসরেও যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে কাজ করতে পারে। প্রেম যেমন ব্যক্তি আর্টিস্টকে আক্রান্ত করে, ঠিক তেমনি মশার কামড়ে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া জ্বরেও তিনি আক্রান্ত হন। বোঝানোর সুবিধার জন্য বলছি শুধু প্রেমটাকে ধরার সামষ্টিক প্রবণতা মুখ্য হয়ে গেলে সমস্যাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমাদের সমস্যা আছে। ব্যক্তিগত আবেগ-আনন্দ বা বিমূর্তভাব নিয়ে কাজ করতে নিষেধ করছি না। সে শখ আমার নেই। তবে জনগোষ্ঠীর যদি আর্ট সম্পর্কে ধারণা রাখে বা প্রায় সব আর্টিস্টের প্রবণতা একরকম হয়ে গেলে অনড়-অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। মোটাদাগে সমস্যা আমাদের আছে। কেন আমরা মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে সৃষ্টিশীল শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাই না, সেটা ভেবে দেখতে হবে। কেউ তো ধরে রাখেনি।

নতুন কয়েকজন চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আন্দোলনের জেরে। নতুন প্রজন্মের ভাষার মতো। তাদের মাথা উঁচু করা ঠিক কতটা আশাজাগানিয়া?

সময় তার নিজের মানুষ তৈরি করে নেয়। রাজনীতিতে, নেতৃত্বে যেমন নতুন মানুষ তৈরি করে ঠিক তেমনি অন্যান্য পরিসরেও করে। বর্তমান সময়ের প্রতিরোধী শক্তির ঢেউ সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন কল্পনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আশাজাগানিয়া তো বটেই। আগে যেমন বলেছি, ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে সামষ্টিক উদ্যোগ-আয়োজন লিপ্ততার ওপর এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

আন্দোলনে নতুন শিল্পধারা হিসেবে ক্যালিগ্রাফি দারুণ জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে। দেশে শিল্পধারার ভবিষ্যৎ কেমন মনে হয়?

বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে বেশকিছু ক্যালিগ্রাফির নজির আমরা দেখতে পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি অভিভূত। সারা দুনিয়ায়ই ক্যালিগ্রাফি একটা প্রতিষ্ঠিত আর্ট ফর্ম। বাংলাদেশে যারা করছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বেশির ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সঙ্গে জড়িত না। মূলধারার উদ্যোগ-আয়োজন-উদযাপনে এমন স্বশিক্ষিত শিল্পীদের কাজ যুক্ত করতে হবে। ব্যাপারটা কালচারাল বাইনারি অপজিশনের মামলা না। প্রয়োজনীয় স্পেস দেয়া গেলে বাংলাদেশ থেকে ক্যালিগ্রাফির স্বতন্ত্র একটা ধারা তৈরি হতে পারে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫