জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটি অনুসারে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর সর্বত্রই রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। মূলত সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। কিছু সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়েছে; অন্য সংস্কার কাজগুলো অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হবে—এ আশায় রইলাম।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে চার কোটির অধিক শিক্ষার্থী ও প্রায় ১৩ লাখ শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত শিক্ষা ব্যবস্থাটির সংস্কার অতীব জরুরি। শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে শিক্ষকের দায়িত্বের জায়গা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের নিমিত্তে কিছু প্রস্তাব রাখছি:
১. প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক; মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক; কারিগরি ও মাদ্রাসা এবং উচ্চ শিক্ষার সমন্বয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গঠিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন, টেকসই ও কর্মসংস্থানমুখী করার নিমিত্তে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষা গবেষকের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। ওই কমিশন মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার টিচিং-লার্নিং, কারিকুলাম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি মনিটরিং করে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। মন্ত্রণালয় সেই মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট অফিস যেমন ইউজিসি, শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তা বাস্তবায়ন করবে।
২. বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পঠন-পাঠনকেন্দ্রিক ক্লাস-পরীক্ষা মুখ্য; কাঠামোগত ত্রুটির কারণে গবেষণা হয়ে থাকলে গৌণ। অথচ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে গবেষণা-উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্য সামনে রেখে জাতীয় গবেষণা কাউন্সিল (এনআরসি) গঠন করা অতীব জরুরি। গঠিত এনআরসি প্রণীতব্য গবেষণা নীতিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যুভিত্তিক প্রস্তাব আহ্বান করবে। প্রাপ্ত গবেষণা প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে রিভিউ করে গবেষণা প্রস্তাবগুলো নির্বাচন করবে। ফলে দেশে একটি গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে যা প্রকারান্তে শিক্ষার মান উন্নয়নসহ বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সুনিশ্চিত করবে।
৩. যেকোনো স্তরের মানসম্পন্ন পঠন-পাঠনের জন্য দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার নিমিত্তে একটি আদর্শ প্রক্রিয়া, যেমন লিখিত পরীক্ষা, ডেমনস্ট্রেশন ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল যোগ করে সমন্বিত স্কোরের ভিত্তিতে মেরিট লিস্ট অনুযায়ী শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্ণিত নিয়োগ প্রক্রিয়ার পয়েন্টের সঙ্গে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল, গবেষণা প্রবন্ধ, কনফারেন্স পেপার, পিএইচডি (যদি থাকে) ইত্যাদি বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে মাল্টিপল ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ "পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে।
৪. ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. কর্মমুখী ও চাহিদাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম জন্য শিল্পের সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনগুলোর সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তে সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।
৬. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মোকাবেলায় ও কর্মবাজারে প্রবেশের জন্য যে ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন সে অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষায়তনে যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ওপর জোর দিতে হবে। উপরন্তু বর্তমানে কারিগরি স্কুল, টেকনিক্যাল কলেজ, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষতাভিত্তিক মানব উন্নয়ন অতীব জরুরি।
৭. শিক্ষায়তনের বিদ্যমান আইন, বিধিবিধানগুলো যথাযথ প্রয়োগপূর্বক সব মত ও পথের শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া হলগুলোয় যতটুকু সম্ভব মেধাভিত্তিক আসন বণ্টন করে সৃজনশীল ও মননশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। এজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি। তবে শিক্ষায়তনের আইনগত কাঠামোর আওতায় বিধিবিধান প্রয়োগ করে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।
৮. প্রত্যেক স্তরের শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে যাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনো ইনস্টিটিউট/একাডেমি নেই। হেকেপ প্রকল্পের আউটকাম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি (ইউটিটিএ) প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ থাকলেও আজও তা হয়নি। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ওই একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। ওই প্রশিক্ষণ একাডেমিতে একাডেমিক (কারিকুলাম, কো-কারিকুলাম, এক্সট্রা কারিকুলাম), প্রশাসনিক, আইন-সংবিধি, আর্থিক নিয়মাবলি, তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা-প্রকাশনা-উদ্ভাবনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কমপক্ষে চার মাস মেয়াদি একটি ফাউন্ডেশন ট্রেনিং চালু করলে তা উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
৯. ক্লাসে পাঠদান নিয়মিতকরণ ও পাঠদান প্রক্রিয়াকে উপভোগ্য, আনন্দদায়ক ও অনুসন্ধিৎসুময় করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১০. তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতি এবং তাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট অভিভাবকদের অবহিতকরণসহ শিক্ষায়তনের আপডেট তথ্যাদি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য জনসাধারণের মতামত তৈরির জন্য ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে বর্ণিত প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করা হলো। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া অতীব জরুরি। ওই মিথস্ক্রিয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে বহুমত থাকা স্বাভাবিক। তবে বহুমতকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমন্বিতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আশা করি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো হবে, যা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষাঙ্গনগুলো জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রাণ কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে অনেকাংশে সহায়ক হবে।
ড. মো. আবু তাহের: সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়