রাবিতে নবীন শিক্ষার্থীকে র‍্যাগিং

‘তোর মাকে কল দিয়ে বল, আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে’

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, রাবি

'তোকে গেস্টরুমে নিয়ে যাব, গেস্টরুমে নিয়ে তোকে আদর-আপ্যায়ন করব। শেষবারের মতো তোর মাকে কল দে, কল দিয়ে বল, আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে। আবরার ফাহাদকে কীভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল জানিস? পিটিয়ে মারা হয়েছিল।' এমন করেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক নবীন শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসের নিজ কক্ষে র‍্যাগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে নিজের নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। তবে বিষয়টিকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলছেন অভিযুক্তরা।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মোহাম্মদ রকি। তিনি দর্শন বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আর তাকে হুমকি দেয়ায় অভিযুক্ত মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস, একই বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন নাবিল ও তার কয়েকজন সহযোগী।

মোহাম্মদ রকির অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুরের লেবুবাগান এলাকার বিশ্বাস ম্যানসন ছাত্রাবাসের ২০৪ নম্বর কক্ষে থাকেন তিনি। গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত মানসিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন তিনি। একই ছাত্রাবাসের ২০১ নম্বর কক্ষের নাজমুল হোসেন নাবিল ও ২০৫ নম্বর কক্ষের অন্তর বিশ্বাস রাত পৌনে ১২টায় ভুক্তভোগীর কক্ষে প্রবেশ করেন। শুরুতেই অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রকিকে নানা রকম বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। ফলে ভুক্তভোগী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন।

এক পর্যায়ে ওই দুইজন শিক্ষার্থী বলেন, 'তোকে গেস্টরুমে নিয়ে যাব, গেস্টরুমে নিয়ে তোকে আদর-আপ্যায়ন করব। শেষবারের মতো তোর মাকে কল দে, কল দিয়ে বল, আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে। আমি কোনো ভুল করলে আমাকে মাফ করে দিও।’

অভিযুক্তরা আরো বলেন, ‘আবরার ফাহাদকে কীভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল জানিস?’ উত্তরে ভুক্তভোগী বলেন, ‘জ্বি ভাই, পিটিয়ে মারা হয়েছিল।’ তারপর অভিযুক্তরা বলেন, ‘তোকে এভাবে মারলে তখন কী করবি?’ উত্তরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী চুপ থাকেন। এরপর রকিকে হুমকি দিয়ে একাধিকবার হলের গেস্টরুমে যেতে বলেন অভিযুক্তরা। মোহাম্মদ রকি গেস্টরুমে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তারা বলেন, তুই যদি হলের গেস্টরুমে যেতে না চাস তাহলে, মেসে শিবির ডেকে নিয়ে এসে তোকে মারব।

পরে অভিযুক্তরা রকিকে বলেন, ‘তোর রুমমেটদের সেমিস্টার ফাইনাল ৭ তারিখে শেষ হবে। ৮ তারিখ থেকে রাতে তোর সাথে আমরা পার্টি দেব।’ এরপর তারা আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।

ভুক্তভোগী তার অভিযোগপত্রে বলেন, ‘এমতাবস্থায় আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টর অফিসে দুই পক্ষকে ডাকা হয়। এ সময় দুই সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দীন ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মশিহুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

অভিযুক্ত মার্কেটিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন নাবিল বলেন, ‘গতকাল আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভাগের বড়ভাই ওই ছেলের রুমে নিয়ে যায়। যখন আমি রুমে যাই, তখন আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই তার (রকি) সঙ্গে মজা করে। আমিও ছিলাম পিছনে। কিন্তু আমি সেরকম ইনফ্লুয়েন্স করিনি। শিবির সংশ্লিষ্ট কথাবার্তা, মারা বা কোনো অত্যাচার করিনি। আমি তাকে বলে এসেছি তোমরা ফ্লোরে এক সঙ্গে আছো, মিলেমিশে থাকবা। রুমে আসবা আড্ডা দিবা। তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে নক করতে পার।’

আবরার ফাহাদের মতো হত্যার হুমকি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা উদাহরণ হিসেবে বলেছি। আমরা বলেছি বিশ্ববিদ্যালয় এখন সে রকম নেই যে আবরার ফাহাদের মতো হবে। তার সঙ্গে এমন হলে আমাদের জানাতে বলেছি, কিন্তু সে বিষয়টি অন্যভাবে নিয়েছে।’

অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী মো. অন্তর বিশ্বাস বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে নরমালি কথা বলি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু ব্যাপারটা এতোদূর চলে যাবে আমি বুঝতে পারিনি। ওই শিক্ষার্থীকে আমরা হুমকি দিয়েছি এই ব্যাপারটি ভুল। আমি তাকে বলেছিলাম, আবরার ফাহাদের সঙ্গে যেটা ঘটেছে ওটা র‍্যাগিং, তোমার সঙ্গে যেমনভাবে কথাবার্তা হচ্ছে এটাকে তুমি র‍্যাগিং হিসেবে নিও না আর শিবিরের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একজন নতুন শিক্ষার্থীকে যেভাবে র‍্যাগিং দেয়া হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। একদিন আগেই আমরা নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। আমরা অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। অভিযোগ ও স্বীকারোক্তির তথ্যগুলো আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিভাগে পাঠাব। বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটি সুপারিশমালা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিতে দেবে। সেই অনুযায়ী শৃঙ্খলা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।’

এর আগে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‍্যাগিং-সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রক্টর জানান, র‍্যাগিং একটি সামাজিক অপরাধ। এর ফলে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া ছাড়াও র‍্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা হয়। এ কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোথাও কোনো প্রকার র‍্যাগিং না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কেউ র‍্যাগিং করলে বা কাউকে র‍্যাগিং করতে উদ্বুদ্ধ করলে প্রমাণ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক শাস্তি দেয়া হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫