আলোকপাত

গণকর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে সমাজ কি দায়মুক্ত

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪

মো. আবদুল হালিম

শিশুকালে গ্রামে গরুর ক্ষুরা রোগ বা কাঁধে জোয়াল লেগে ঘা হলে তার চিকিৎসার একটি অদ্ভুত প্রথা দেখেছি। প্রথা না বলে একে কুসংস্কার বলা শ্রেয়। ক্ষুরা রোগ বা কাঁধের ঘা সারানোর জন্য সাতজন সুদখোর বা ঘুসখোরের নাম কাগজে লিখে মাদুলিতে ঢুকিয়ে তা রোগাক্রান্ত গরুর গলায় ঝুলিয়ে বা পায়ে বেঁধে দেয়া হতো। তারা বিশ্বাস করত রোগ-জীবাণু বা রোগের পোকা সুদখোর-ঘুসখোরদের সঙ্গে সহাবস্থান করবে না। এদের প্রতি ঘৃণা থেকে এরা গরুর শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে আর গরুর রোগ ভালো হয়ে যাবে। এটি অপচিকিৎসা বা কুসংস্কার বটে।

অপচিকিৎসা বা কুসংস্কার যা-ই বলি না কেন, এর একটি সামাজিক প্রভাব ছিল। এতে বোঝা যায় যে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় সুদখোর-ঘুসখোররা কতটা ঘৃণিত ছিল। সমাজ তাদের ঘৃণার চোখে দেখত। সুতরাং কেউ দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করলেও তা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করত। কালক্রমে আমাদের সামাজিক কাঠামোর অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামপ্রধান সমাজ থেকে গ্রাম ও শহরের মিশ্রিত সমাজ গড়ে উঠেছে। এখন টাকা তথা অর্থবিত্তই সবকিছুর নিয়ামক হয়ে উঠেছে। 

এ নিবন্ধে গণকর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে সমাজের দায় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। গণকর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধে সরকার, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন বা বিচার বিভাগের ভূমিকা আলোচনা করা হলো না। শিরোনামের সঙ্গে মিল রাখার জন্য রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী ও অন্যান্য প্রভাবশালীর দুর্নীতি, অর্থ পাচার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কর্মকর্তা শব্দের উল্লেখ নেই। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সবাই কর্মচারী। এজন্য শিরোনামে গণকর্মচারী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীর সর্বোচ্চ বেতন সবাই জানেন। একজন সরকারি কর্মচারী তার বৈধ আয়ে কী ধরনের জীবন যাপন করতে পারেন, কতটুকু সম্পদ আহরণ করতে পারেন তা একজন সাধারণ বোধসম্পন্ন মানুষের বোঝার কথা। বাস্তবে তার চেয়ে বহুগুণ ব্যয় করে আয়ের সঙ্গে ব্যাপক সামঞ্জস্যহীন জীবন যাপন করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি কেউ প্রশ্ন করেন না। ফলে সমাজ থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা একধরনের প্রশ্রয় পায়, বৈধতা পায়। 

পার্সেন্টেজ, কমিশন, ঘুস, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারী সরকারি কর্মচারীরা সমাজে তেমন ঘৃণিত নন। তাদের কেউ কেউ দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। মিডিয়ার কারণে কারো কারো হোটেল, রিসোর্ট, বাগানবাড়ি, খামারের খবর জাতি জানতে পেরেছে। তারা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। তারা দানবীর। তাদের নেটওয়ার্ক অনেক বড়। তারা দান-দক্ষিণা করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন গড়ে তুলে সমাজে ভদ্র, দানশীল পরোপকারী, সমাজহিতৈষী হিসেবে স্বীকৃত। পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বিভিন্নভাবে দান-দক্ষিণা পাওয়া প্রতিষ্ঠান ও উপকারভোগীরা তাদের করিৎকর্মা, সফল বলে গুণগান করে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ তাদের বাড়া ভাতে ছাই ফেলেছে। বুক ফুলিয়ে চলার পরিবর্তে অন্যভাবে চলতে হচ্ছে। কীভাবে চলছেন, সেটি তারাই ভালো জানেন। 

পক্ষান্তরে সৎ কর্মচারীর পক্ষে দান-দক্ষিণা তো দূরের কথা, একান্ত আপনজনদের সঙ্গে সামাজিকতা রক্ষা করাই কঠিন। একান্ত আপনজনও এদের কৃপণ, বোকা, বর্তমান সমাজে অচল, কারো জন্য কিছুই করেনি—এ ধরনের অপবাদ দেয়। 

সবাই আশা করেন সরকারি কর্মচারীরা সৎ থাকবেন। তাদের জন্য প্রযোজ্য আইন-বিধিও তাই বলে। একজন সরকারি কর্মচারী আর্থিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সৎ থাকবেন, তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পেশাদারত্বের সঙ্গে পালন করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এটা বাড়তি বা বিশেষ গুণ নয়। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় একে অনেকেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলতে চান। বর্তমান বাস্তবতায় সততার নার্সিং প্রয়োজন। বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ সরকারি চাকরিজীবী। এর একটি ক্ষুদ্র অংশই দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত। বেশির ভাগেরই দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। আবার সুযোগ থাকলেই যে সবাই দুর্নীতি করে তাও সত্য নয়। কিন্তু পেশাগত দক্ষ, সৎ কর্মচারীদের জীবনধারণকে সামাজিকভাবে বা মিডিয়ায় তেমন হাইলাইট করা হয় না। সমাজ বা মিডিয়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রায়ই তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি তুলে ধরছে। মিডিয়া দুর্নীতিবাজদের পাশাপাশি সততার সঙ্গে জীবনযাপনকারী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের হাইলাইট করতে পারে। সৎ ও অসৎ উভয় ধরনের কর্মচারীদের সংবাদ প্রকাশ সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা তৈরিতে অবদান রাখবে। সততার সঙ্গে জীবিকা নির্বাহকরা সাহস পাবেন, হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। যারা  দিক ঠিক করতে পারছেন না তারাও সঠিক পথ, সততার পথ বেছে নিতে পারবেন।

কানাডার রেসিডেন্টদের জীবনযাত্রার ওপর বাড়তি চাপ ফেলার কারণে কানাডা সরকার আইন করে নন-রেসিডেন্টদের জমি ও বাড়ি ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কানাডার মতো একটি উন্নত দেশ, যার নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের নাগরিকদের বহুগুণ। সে দেশের সরকার যদি অনুপার্জিত আয়ের অসম প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচানোর জন্য আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়, তাহলে প্রজাতন্ত্রের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী ও অন্যদের অনুপার্জিত আয়, বৈধ আয়ে জীবনযাপনকারীদের কেমন প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয় তা সহজেই বোধগম্য। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ যিনিই হোন না কেন, তিনি আপনার, আমার হক, সম্পদ চুরি/লুণ্ঠন/ছিনিয়ে নিয়ে তা থেকে ছিটাফোঁটা বিলি করে দাতাকর্ণ সাজেন। গরু মেরে জুতা দান। সুতরাং যারা সততার সঙ্গে জীবন যাপন করছেন, তাদের নিজেদের স্বার্থেই অসৎ, দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, কানাডায় গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে কেউ বাড়ি, গাড়ি কিনলে সেখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটি তাদের বর্জন বা এড়িয়ে চলে। নিঃসন্দেহে এটা খুবই একটি আশাজাগানিয়া সংবাদ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, আপনজনদের ছেড়ে বিদেশে গিয়ে মেধা ও শ্রম দিয়ে, গড়পড়তা জীবন যাপন করে মূ ল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে বিদেশে বাংলাদেশীরা দেশে অর্থ পাঠাবেন। পক্ষান্তরে আরেক দল বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচার করে সেসব দেশে নিয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে আরামদায়ক জীবন যাপন করবে, এটি বেমানান। স্বাভাবিকভাবেই দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের চোখে খারাপ লাগার কথা। কানাডায় বাংলাদেশী কমিউনিটির মতো অনুরূপ সংবাদ সিঙ্গাপুর, দুবাই, আবুধাবি, লন্ডন থেকে পাওয়া গেলে দুর্নীতিবাজরা একটু চাপের মধ্যে পড়বে বৈকি। 

আসুন, আমরা বিরাজমান অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যার যার জায়গা থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখি। পার্সেন্টেজ, কমিশন, ঘুস বা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকারী সরকারি চাকরিজীবী বা যিনিই হোন না কেন তাকে দেশে-বিদেশে বুক ফুলিয়ে চলায় সহায়তা না করি। 

মো. আবদুল হালিম: সাবেক সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয় ও

সাবেক কমিশনার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫