জুলাইয়ের তীব্র আন্দোলনেও প্রভাব পড়েনি রফতানিতে

প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে নিরবচ্ছিন্ন রফতানি নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪

অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানি। রফতানি আয়ের ভিত্তিতে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা পরিকল্পনা নেয়া ও বাস্তবায়ন হয়। ডলার সংকট ও রিজার্ভ পতনের মতো গুরুতর সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এজন্য রফতানি প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকা আবশ্যক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ের রফতানির প্রবৃদ্ধি প্রকাশ করেছে। ব্যাংকটির ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটর: মান্থলি আপডেট’ শীর্ষক আগস্টের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়েছে ৩৮২ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের। ২০২৩ সালের একই মাসে পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ছিল ৩৭১ কোটি ৫৬ লাখ বা ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে জুলাইয়ে।

গত বছরের জুলাই আর এ বছরের জুলাইয়ের সার্বিক অবস্থা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে পুরো দেশ ছিল উত্তাল। একের পর এক প্রাণহানির ঘটনায় আন্দোলন তীব্র হলে এক ধরনের অচল হয়ে পড়ে দেশ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কারফিউ জারি করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। শুল্কায়ন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় রফতানিতে স্থবিরতা নেমে আসে, স্থবির হয়ে পড়ে পণ্য জাহাজীকরণ। দেশের এ পরিস্থিতির কোনো ছাপ নেই রফতানি পরিসংখ্যানে। উল্টো রফতানি প্রবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। আমরা এটিকে একটি ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখতে চাই। দেশে যেকোনো বিরূপ অবস্থায় রফতানি বাণিজ্য যেন ব্যাহত না হয়, তা আমাদের দেশের অর্থনীতির স্বার্থে নিশ্চিত করা হবে, এমনটিই প্রত্যাশা। 

কিন্তু মুদ্রার দুই পিঠের মতো এ পরিসংখ্যানেরও একটি উল্টো পিঠ রয়েছে। আর তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। সেটিও অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে কার্যকর নীতি প্রণয়নে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া অত্যন্ত জরুরি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাইয়ে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল এতে রফতানি প্রবৃদ্ধির এ তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার পরও এর যথার্থতা যাচাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ে ঈদের ছুটির কারণে উৎপাদন বন্ধ থাকার বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছেন তারা। তাদের মতে, চলতি বছর জুলাইয়ে রফতানি বিঘ্নিত হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য। পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় আমদানীকৃত কাঁচামালের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পোশাক রফতানির চূড়ান্ত মূল্যে পড়ে থাকতে পারে। আবার ভ্যালু অ্যাডেড বা মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক রফতানির ফলে পরিমাণে কম হলেও অর্থমূল্যের প্রবাহ বেশি হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং পরিসংখ্যানের যথার্থতা নির্ণয়ে এসব খতিয়ে দেখা দরকার। রফতানিকারকরাও এসব পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিশ্চিতের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছেন। কারণ তাদের মতে, বাস্তবতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য সংগতিপূর্ণ নয়।

রফতানি তথ্যে অসংগতির বিষয়টি বেশ আগে থেকেই চলে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রফতানি পণ্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। সে রফতানির বিপরীতে আয় প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত পরিসংখ্যানের মধ্যে বরাবরই বিস্তর তফাত দেখা যাচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানির তথ্য সংশোধন করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। যেখানে গত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রফতানি দেখানো হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ ওই সময়ে ইপিবি রফতানি দেখিয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ইপিবির তথ্য সংশোধন করে সেখান থেকে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে রফতানি পরিসংখ্যানে তথ্যগত গরমিল সংশোধনের জন্য গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আগামী তিন মাস ইপিবি রফতানির তথ্য প্রকাশ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে রফতানির তথ্যে গরমিল হওয়ার কারণ খুঁজে বের করে সংশোধন করার পর পুনরায় মাসভিত্তিক তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এ থেকে বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত সম্প্রতিক প্রতিবেদনের যথার্থতা রয়েছে। যেহেতু এরই মধ্যে রফতানি তথ্য সমন্বিতভাবে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে পোশাক পণ্য। এ খাতের নিটওয়্যার পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১৭২ কোটি ৯১ লাখ ডলার। গত বছর জুলাইয়ে রফতানি হয়েছিল ১৬৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাইয়ে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের বা ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেশি নিটওয়্যার পোশাক রফতানি হয়েছে। 

তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পোশাকের রফতানির অর্থমূল্য চলতি বছরের জুলাইয়ে ছিল ১৪৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই মাসে রফতানি হয় ১৩৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের ওভেন পোশাক। এ হিসাবে ৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের বা ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি রফতানি হয়েছে।

বস্ত্র খাতের হোম টেক্সটাইল ছিল জুলাইয়ে রফতানি হওয়া তৃতীয় বৃহত্তম পণ্য। এ খাতের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে হোম টেক্সটাইল রফতানির অর্থমূল্য ছিল ৫ কোটি ২৩ লাখ ডলার। চলতি বছরের একই মাসে রফতানি হয়েছে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল। এছাড়া কৃষিপণ্য রফতানিতে চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ। 

জুলাইয়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রফতানির এ তথ্যগুলো সুখবরই বটে। তবে দেশের বর্তমান অবস্থা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভের জেরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। প্রতিদিনই বাড়ছে তার সংখ্যা। বেতন ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি এবং সমানুপাতিক হারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে অসংখ্য পোশাক কারখানার উৎপাদন। পোশাক শিল্পের এ অস্থিরতায় এরই মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে গেছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

উদ্ভূত এ পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হলে রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সংকটে থাকা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর এক অন্যতম মাধ্যম হতে পারে রফতানি আয় বৃদ্ধি। এজন্য দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে রফতানির অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা আবশ্যক। যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সরকারের এ বিষয় সুরাহা করা প্রয়োজন। নয়তো তা সরকারের জন্যও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আরো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫