সময়ের ভাবনা

ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে নজর দেবেন কি

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪

হানযালা হান

গত ১১ আগস্ট একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যানজটে আটকা পড়ে আছেন। এ দৃশ্য সত্যি আমাদের আশাবাদী করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে দাবি উঠেছে, তা যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুধাবন করতে পেরেছেন, এ ছবি তারই প্রমাণ। সভ্য সমাজে সব নাগরিক সমান। সেখানে কেউ ভিআইপি সুবিধা পেতে পারেন না। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার এ যেন কেবল শুরু। আমরা আশা করব, রাষ্ট্রপতিও রাস্তায় বের হলে জনসাধারণের চলাচলের পথ আর বন্ধ করবেন না। ভবিষ্যতে যারা প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হবেন, তারাও এ পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। আমরা একই সঙ্গে ভিআইপি বিধি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।

এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এ কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান। তিন মাসের মধ্যে সংস্কার পরিকল্পনা সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। আমরা সরকারের এ সংস্কার কর্মসূচির উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এর সঙ্গে আমরা কিছু কথা যোগ করতে চাই।

আমরা মনে করি, কমিশন ছাড়াই কিছু কিছু বিষয় সংস্কার করা যায়। যেমন চিকিৎসকরা যে প্রেসক্রিপশনে ওষুধের নাম লেখেন তা বন্ধ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চাইলে ওষুধের নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশনা দিতে পারে। আর প্রেসক্রিপশন বাংলায় লেখাটাকে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তেমনি আদালতের ভাষাও বাংলায় হওয়া উচিত। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করা আবশ্যক। এটা না করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। একই সঙ্গে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেট/কোচিং সেন্টারে পড়ানো বন্ধের নির্দেশ দিতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিচার বিভাগ স্বাধীন করার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে আইনজীবী এবং আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোভের শিকার হয়ে মামলা ঝুলে থাকার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হয়ে আসার উপায় বের করতে হবে।

আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই সংবিধান সংস্কার কমিশনের। এ কমিশন আশা করি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার উপায় খুঁজে বের করবেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা। পৃথিবীর ৯৭টি দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিল। অথচ ৫২ শতাংশ মানুষ তাদের ভোটই দেয়নি। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে এ ধরনের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

‘পরপর দুই মেয়াদের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’ বলে বিএনপি যে দাবি তুলছে, আমরা এ বাক্যের ‘পরপর’ কথাটাকে সন্দেহের চোখে দেখি। এতে একই ব্যক্তি পরপর না হলেও বিরতি দিয়ে বহুবার প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। তাই আমাদের দাবি, এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি কোনো পদেই থাকতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যে পদেই থাকুন না কেন, এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুবার এ দুই পদের যেকোনো একটি বা উভয়টিতে বসার সুযোগ পাবেন। এটা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এক ব্যক্তি একবার প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। আবার একবার প্রধানমন্ত্রী হলে আরেকবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। তবে দুবার প্রধানমন্ত্রী হলে আর একবারের জন্যও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। দুবার রাষ্ট্রপতি হলে আর একবারের জন্যও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এ কথাগুলো একেবারে সুস্পষ্ট করার কারণ রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি ১৯৯৯-২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি, ২০০৮-১২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এবং ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে রয়েছেন। আমরা চাইব না, ‘পরপর দুই মেয়াদের’ সুযোগে এ দেশে একজন ভ্লাদিমির পুতিনের উত্তরসূরি জন্ম নিক।

এ দেশে যে কর্তৃত্ববাদ তৈরি হয়েছে, এর প্রধান কারণ বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোয় গণতন্ত্র না থাকা। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কোনো পদে নেতা/কমিটি নির্বাচনে গণতন্ত্র চর্চা করা হয় না। সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে যে কোনো রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র চর্চা না করলে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন সংস্কারবিষয়ক কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আইন প্রণয়ন করে দিতে পারে। সেখানে ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতা/কমিটি নির্বাচনে ভোটাভুটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রয়োজনে এ ভোটাভুটি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এছাড়া একই ব্যক্তি যাতে দুই মেয়াদের বেশি দলের কোনো একটি পদে থাকতে না পারেন সেটিও বাধ্যতামূলক করতে হবে। না হলে উপজেলা/জেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো এক পরিবারের মুঠোবন্দি হওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বের হওয়া যাবে না। এছাড়া গ্রাম/শহরের মাস্তান যুবকের নেতা হওয়ার যে প্রবণতা সমাজে তৈরি হয়েছে, তা ঠেকানোর কৌশল বের করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। আর সরকার পরিচালনা করে রাজনৈতিক দল। ফলে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এটা করতে না পারলে কর্তৃত্ববাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

তবে সংবিধান সংস্কারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সার্বভৌম ক্ষমতার অংশে। বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সংবিধানের হাতে (৭ নম্বর অনুচ্ছেদ: প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে৷)। ফলে প্রায় প্রতিটি সরকার ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন করেছে। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কোনো গ্রন্থের হাতে থাকতে পারে না। এটা জনগণের হাতেই থাকতে হবে। না হলে নেতা/আমলা/সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখে জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার যে প্রবণতা, সেখান থেকে আমরা বের হতে পারব না।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি, আমরা গণমাধ্যমের খবরে দেখেছি সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে ব্রিটিশ পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। এর মানে তিনি দ্বৈত নাগরিক। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের বিদেশে নাগরিকত্ব/সেকেন্ড হোম রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে এর আগে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম আহমেদ খানের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকার কথা শোনা গেছে। এর বাইরেও বহু নেতা ও আমলার বিদেশে নাগরিকত্ব/সেকেন্ড হোম থাকার কথা শোনা যায়। অথচ বিদেশী নাগরিকত্ব থাকলে এ দেশের ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের কোনো পদে যাওয়ার সুযোগ থাকার কথা নয়। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারদের পদমর্যাদাক্রমের এই ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে যারা থাকবেন তাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

আমরা মনে করি, ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে থাকা ব্যক্তিরা প্রতি বছর সম্পদের হিসাব জমা দেবেন। এগুলো জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে যারা থাকবেন তারা কেউ বিদেশী/দ্বৈত নাগরিক হতে পারবেন না। দায়িত্ব পালনের আগে বা দায়িত্ব পালনকালীন বিদেশে/দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে পারবেন না, বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। বিদেশে বাড়ি/জমি ক্রয় বা বিনিয়োগ করতে পারবেন না। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে যারা থাকবেন তাদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করতে পারবেন না। তবে কারো জীবন সংকট তৈরি হলে/জরুরি প্রয়োজনে বিদেশে চিকিৎসার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। আবার মেধা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সন্তানরা পেতেই পারেন।

আমরা একটি বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। রক্ত ও লাশ মাড়িয়ে যে অভ্যুত্থান, তার সাফল্য নির্ভর করছে সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ার ওপর।

হানযালা হান: কবি ও জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, বণিক বার্তা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫