নিঃশেষের কাছে বিবিয়ানার গ্যাস

জ্বালানি নিরাপত্তায় গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ নির্ণয় ও নতুন কূপ খননে জোর দিতে হবে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪

দেশে জ্বালানি চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয়ে থাকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে। আর জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎসের মজুদ বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড। জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন যুক্ত হওয়া ২ হাজার ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে যোগ হয় ১ হাজার ২ মিলিয়ন ঘনফুট বা ৩৯ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে তাই এখান থেকে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর করে তুলবে। এর প্রভাবে দেশের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জও আরো বেড়ে যাবে। কেননা জাতীয় গ্রিডে এ মুহূর্তে বিবিয়ানার গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। এ অবস্থায় সরকারের উচিত জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিবিয়ানায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত মজুদ নির্ণয় করা। একই সঙ্গে নতুন কূপ খননে জোর দিতে হবে। 

গ্যাস মজুদের টুপি (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) হিসাব অনুযায়ী, বিবিয়ানায় গ্যাসের মজুদ থাকার কথা প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। যদিও এরই মধ্যে এখান থেকে উত্তোলন ছয় টিসিএফ ছাড়িয়েছে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাসও সিংহভাগ উত্তোলন হয়েছে। সে হিসেবে দেশের গ্যাস উত্তোলনে শীর্ষে থাকা ক্ষেত্রটির মজুদ এখন নিঃশেষের কাছাকাছি। আবার গ্যাস মজুদের প্রাথমিক প্রাক্কলিত হিসাব জিআইআইপি (গ্যাস ইনিশিয়ালি ইন প্লেস) অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৮৩ বিসিএফ। তবে এ গ্যাসের পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, গ্যাস রিকভারি ফ্যাক্টর অনুযায়ী এ ধরনের গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের ৭০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য। সুতরাং গ্যাস সংকট মোকাবেলা করতে হলে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের প্রকৃত মজুদ নিরূপণ করা জরুরি। বিবিয়ানায় চিহ্নিত মজুদের বাইরে গ্যাসের আর কোনো বড় মজুদ আছে কিনা তা অনুসন্ধান করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখান থেকে উত্তোলনযোগ্য আরো এক-দুই টিসিএফ মজুদ পাওয়া গেলে তা দেশের জ্বালানি খাতে গ্যাস সংকটের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। 

পেট্রোবাংলার সূত্রের ভিত্তিতে বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেয়া শেভরন করপোরেশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশে তাদের অধীন গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ বেড়েছে ৪৮১ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে শেভরন কোনো গ্যাস ফিল্ডের কথা উল্লেখ না করলেও অনুমেয় যে এ মজুদ বিবিয়ানা ফিল্ডেরই। সে অনুযায়ী এখানে মোট মজুদ ৬ হাজার ২৩৬ বিসিএফ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৭৫ বিসিএফ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো অন্তত ৮৭ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে বিবিয়ানা থেকে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৬২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে চলতি মাস পর্যন্ত। ফিল্ডটিতে তাহলে আর অবশিষ্ট থাকবে ১৭৪ বিসিএফের মতো।

এর মধ্যে আবার গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে গত বছর বিবিয়ানায় মূল্যায়ন কূপ (বিবিয়ানা-২৭) খনন করে শেভরন। যদিও সেই ফিল্ডের ফলাফল কী সে বিষয়ে এখনো জানা যায়নি। শেভরনকে এক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনাটাও জরুরি এবং তাদের কাজের শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। 

এদিকে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের মতো এত বৃহৎ সক্ষমতার জোগানের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই পেট্রোবাংলার কাছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করার একটি উপায় হতে পারে আমদানি। কিন্তু দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে আমদানি করাটা এখন কোনো সমাধান নয়, বরং উল্টো নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার সবসময়ই ভূরাজনীতি, উৎপাদন ও নানা কারসাজিতে পূর্ণ থাকে। ফলে এ বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। উদাহরণস্বরূপ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথাই বলা যায়, যার প্রভাব কাটিয়ে স্থিতিশীল পর্যায়ে আসতে আন্তর্জাতিক বাজারের দীর্ঘ সময় লেগেছে। দাম বেড়েছিল রেকর্ড পরিমাণ। এ বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞরা এলএনজির ওপর অতিনির্ভরতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ ছিল, নবায়নযোগ্য ও দেশীয় জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এলএনজি, জ্বালানি তেল প্রভৃতির বাজার অস্থিতিশীল। এর দাম দ্রুত ওঠানামা করে। এছাড়া এলএনজির দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যায়, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব রাখে। যদিও এসব সুপারিশ-উপদেশ অগ্রাহ্য করেই বিগত সরকার জ্বালানি খাতকে ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর করে তোলে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ছিল উপেক্ষিত, যার দরুন বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টি নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সমাধানে আসা দরকার।

দেশীয় যেসব গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদনে আমরা বরাবরই কম গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। গোষ্ঠী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে গিয়ে জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধান তো হয়নি, বরং পরিস্থিতির ক্রমে অবনমন ঘটেছে। এর ভুক্তভোগী পুরো দেশ। দেশ আরো একবার রেকর্ড লোডশেডিংয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ বিদ্যুৎবিহীন তীব্র গরমে নাজেহাল অবস্থায় দিন যাপন করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিবিয়ানাসহ অন্য গ্যাস ক্ষেত্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে হবে। গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর অনাবিষ্কৃত এলাকায় নতুন করে খনন কার্যক্রম চালালে সেখানে আরো গ্যাস পাওয়া যেতে পারে, যা বিদ্যমান সংকটকে প্রশমিত করতে পারে। 

দেশে গ্যাস সংকট কেবল জ্বালানি অনিরাপত্তা নয়, সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং ফেলছে। এরই মধ্যে চাপে পড়েছে শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানার উৎপাদন। বিপাকে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান, যেখানে উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত মোট কর্মসংস্থানের ৬৮ শতাংশই বৃহৎ শিল্পে। কাঁচামালের ৬৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির ৫৬ শতাংশই ব্যবহার করে এ শিল্পগুলো। বিদ্যুৎ খাতেও সংকট প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মতে, দেশে বর্তমানে দিন ও রাত মিলিয়ে গড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। একইভাবে ব্যাহত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার সার কারখানার উৎপাদন। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি কারখানার উৎপাদন। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না হলে যথাসময়ে কৃষককে সার সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে আসবে, যা খাদ্যনিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার এক ক্রান্তিকালে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু এখন থেকেই জ্বালানি নিরাপত্তার মতো একটি আবশ্যকীয় বিষয়ে নজর না দিলে তা আরো কঠিন ঝুঁকিতে ফেলবে এ সরকারকে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিষয়ে কৌশলী হওয়া বর্তমানে সময়ের দাবি। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫