হিমায়িত চিংড়ির রফতানি নেমেছে ৫০ শতাংশের নিচে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বিশ্ববাজারে হিমায়িত চিংড়ির চাহিদার কারণে প্রায় দুই যুগ আগে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা পণ্যটি রফতানিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সাল-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দাম কমে যায়। তখন থেকেই বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত বাগদা বা গলদা চিংড়ির চাহিদা কমতে শুরু করে। এক যুগ আগেও বছরে ৫০ হাজার টন চিংড়ি বিশ্ববাজারে রফতানি হতো। কিন্তু সমাপ্ত অর্থবছরে তা নেমেছে প্রায় ২৪ হাজার টনে, যা অর্ধেকেরও কম। একই সময়ে হিমায়িত চিংড়ি থেকে রফতানি আয় ৫৭ কোটি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ডলারে। এদিকে বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় সমাপ্ত অর্থবছরের শুরুতে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। তবুও অর্থবছরের শেষে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু না করা, চাষের জমি কমে যাওয়া এবং কাঁচামালের সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রফতানি কমে যাচ্ছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ অনেক কারখানা।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার টন চিংড়ি রফতানি হয়েছিল। যার বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ৫৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে ঠিক এক যুগের ব্যবধানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন, আর্থিক অংকে যা প্রায় ২৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক যুগের ব্যবধানে চিংড়ি রফতানি কমেছে প্রায় ২৭ হাজার টন বা ৫২ শতাংশ। আর্থিক অংকে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ডলার বা ৫৭ শতাংশ। বিগত এক যুগের হিমায়িত চিংড়ি রফতানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই কমেছে চিংড়ির রফতানি। 

অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের চিংড়ি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের চিংড়ি রফতানি করা সম্ভব হয়। যে কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের। বছর শেষে সেটা নেমে আসে মাত্র ২৪ কোটি ডলারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চিংড়ি রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনলেও সেই পরিমাণ অর্থের চিংড়ি রফতানি করা যায়নি।

লক্ষ্যমাত্রার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে চিংড়ি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, ৪১ কোটি ৫০ লাখ, ৩৩ কোটি, ৫০ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। 

গত এক যুগের মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চিংড়ি রফতানি সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে ৩৩ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৪০ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার ডলারে ৩০ হাজার ৫৭১ টন চিংড়ি রফতানি হয়। মূলত কভিড মহামারীকালে বিশ্ববাজারে চিংড়ির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে তখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রফতানি সম্ভব হয়েছিল।

বিএফএফইএ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আশরাফ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হিমায়িত চিংড়ির রফতানি কমে যাওয়ায় আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রতি বছর বিশ্ববাজারের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশে ভেনামি জাতের চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় আমরা বাজার হারিয়েছি। প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। ব্যাংকের সুদ দিতে না পেরে অনেকে কারখানাও বিক্রি করে দিয়েছেন।’

তথ্যমতে, দেশে চিংড়ি চাষের উপযোগী প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। যার মধ্যে ২ লাখ হেক্টরে চাষ হয় বাগদা চিংড়ি। এছাড়া হিমায়িত মাছ রফতানি খাতে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১০। এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা সাড়ে ৩ লাখ টন। মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া-রামপুরা মৌজায় চিংড়ি চাষের উপযোগী সাত হাজার একর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। এ এলাকাটিকে চিংড়ি চাষের জোন হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোর চাহিদার ৮০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চকরিয়া-রামপুরা এলাকায় যে চিংড়ি এলাকা আছে তাতে বড় পরিসরে চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। এ জমিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার না করে শুধু চিংড়ি উৎপাদনে ব্যবহার করা হোক এবং রফতানিকারকদের অনুকূলে দীর্ঘমেয়াদি লিজ প্রদান করে চিংড়ি চাষের সুযোগ চান তারা। এছাড়া যেসব ব্যবসায়ী পাইলট প্রকল্পের অধীনে রফতানির জন্য ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছেন, তাদের প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানান তারা।  

এ প্রসঙ্গে এমইউ সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সারা বিশ্বে যেখানে চিংড়ি রফতানির প্রায় ৮০-৮২ শতাংশই হয় ভেনামি চিংড়ি, সেখানে আমরা ২০ শতাংশের বাগদা বা গলদা চিংড়ি নিয়ে কাজ করছি। প্রতি বছর এ রফতানি কমে আসছে। দেশের প্রথম ভেনামি চিংড়ি চাষের পাইলট প্রকল্পটি আমার হাত ধরেই শুরু হয়। হেক্টরপ্রতি যেখানে আমরা আট হাজার কেজি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করি, সেখানে বাগদার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৬০০-৮০০ কেজি। বিশ্ববাজারে এ চিংড়ির চাহিদা বেশি।

ভেনামি চিংড়ি চাষের পরিকল্পনা করতে করতেই রফতানি খাতটি হাতছাড়া হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৃহৎ উদ্যোক্তারা এ চিংড়ি চাষে না এলে মাঠ পর্যায়ের চাষীদের দিয়ে বড় পরিসরে উৎপাদন সম্ভব নয়। তাছাড়া চিংড়ি উৎপাদনে কোনো বৃহৎ দিকনির্দেশনাও বিগত সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি। আমরা চাই সরকার কৃষিপণ্যের মতো চিংড়ি চাষকে গুরুত্ব দিক। তাহলে এ খাতটির বড় সম্ভাবনা আছে।’ 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এখন ৯৫ শতাংশই ভেনামি চিংড়ি। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া চিংড়ির মধ্যে ৯৫ শতাংশই বাগদা চিংড়ি। ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষে উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ শতাংশ কম। তাই কম উৎপাদনশীল গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। এ অবস্থায় ভেনামি চিংড়ির রফতানি বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ প্রয়োজন। এছাড়া বাগদা চিংড়ির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে এটিকেও নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫