অভিমত

খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধানে কৃষিপণ্যের উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

ড. জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। তার পরও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমরা আমদানি করছি প্রতি বছর। এর মধ্যে আছে চাল, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য। শুধু দানাদার খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ৭০-৮০ লাখ টন। এর সঙ্গে অন্যান্য কৃষিপণ্য যেমন ডাল, তেলবীজ, চিনি, মসলা ও দুগ্ধজাত পণ্য যোগ করা হলে মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০-১০০ লাখ টন। টাকার অংকে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা। তার পরও দেশে খাদ্যনিরাপত্তার ঘাটতি আছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বর্তমানে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটি দূর করতে হলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন আরো দ্রুত বাড়াতে হবে। তার মাত্রা হতে হবে ন্যূনপক্ষে বছরে গড়ে ৪-৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। কৃষিপণ্যের বাজারজাত উদ্বৃত্ত আরো বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে কৃষিজমি হ্রাস, আবাদযোগ্য জমি চাষের বাইরে ফেলে রাখা, জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, খাদ্য অপচয়, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে চাষাধীন জমির পরিমাণ কম। মোট ১ কোটি ৮৬ লাখ একর বা ৭৫ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। জনপ্রতি প্রাপ্যতা মাত্র ১১ শতক। দ্রুত এর পরিমাণ কমছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯২০ লাখ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে তা ৮২ লাখ, ২০০৮ সালে ৭৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে তা ৭৫ লাখ হেক্টরে হ্রাস পায়। শতকরা হিসাবে আবাদি জমি হ্রাসের গড় হার ছিল ১৯৮৪-৯৬ সাল পর্যন্ত বার্ষিক শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ, ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শূন্য দশমিক ৭৪ এবং ২০০৮-১৯ সাল পর্যন্ত শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। ১৯৮০ সালে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল মোট জমির ৬৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশে হ্রাস পায়। এভাবে কৃষিজমি হ্রাসের প্রধান কারণ হলো শিল্পায়ন, নগরায়ণ, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন বসতবাড়ি স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ইটভাটা স্থাপন, নদীভাঙন ইত্যাদি। সম্প্রতি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে জমি হ্রাসের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে। কিন্তু তা এখনো উদ্বেগজনক ও বিপদাশঙ্কাপূর্ণ। আগামীতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিজমি অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে তিন ও দো-ফসলি জমি কোনোভাবেই অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি জমি অন্য খাতে ব্যবহার করতে হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা দরকার।

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হলো আবাদযোগ্য পতিত জমির আধিক্য। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ হেক্টর। মোট আবাদযোগ্য জমির ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ হচ্ছে পতিত জমি। দেশের বিভিন্ন চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেল বিভাগে চাষযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনস্থল এবং ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানার চারপাশেও অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যে পরিমাণ জমি দখলে নেয়া হয় তার বেশির ভাগই স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যবহার হয় না। বাকি জমি ফেলে রাখা হয় খালি। ঢাকা মহানগরের চারপাশে আবাসন কোম্পানিগুলোর অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখা যায়। তার চারপাশে পতিত ফেলে রাখা হয়েছে শত শত একর আবাদি জমি। ঢাকার বাইরেও চোখে পড়ে এমন অনেক দৃশ্য। অপেক্ষাকৃত উঁচু, নিচু ও সমস্যাসংকুল অঞ্চলে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। এরূপ জমি অপচয়ের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। সম্প্রতি কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও চাষের আওতাভুক্ত কিছু জমি পতিত ফেলে রেখেছেন অনেক কৃষক। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণেও অনেক সময় কৃষক চাষাবাদে অনীহা পোষণ করেন। তাতে ফসলের উৎপাদন হয় কম। এ অবস্থায় সব পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এক্ষেত্রে শস্য বহুধাকরণ, স্বল্প সময়ের শস্য আবাদ, শস্যক্রমের বিন্যাস পরিবর্তন। হাওর অঞ্চলের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ফল, কাজুবাদাম ও কফি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। বছরের বিভিন্ন সময়ে মাঠের জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সে বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জমি পতিত রাখার জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয় (সেট এ সাইড পলিসি)। তাতে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায় এবং বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্যের মূল্যপতন ঠেকানো যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো খাদ্যনিরাপত্তা সংকটে থাকা একটি দেশে পতিত জমি আবাদের জন্য কৃষকদের সহায়তা দেয়া হবে খুবই যুক্তিসংগত।

চাষযোগ্য মাটির গুণাগুণ হ্রাস কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায়। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মোট জমির শতকরা ৭৬ দশমিক ২ ভাগ এখন মোটামুটি অনুর্বর। এর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০০ সালে ১ দশমিক শূন্য ৭ কোটি হেক্টর জমি উর্বরতা হারিয়েছে বলে ধারণা করা হতো। বর্তমানে তা ১ দশমিক ১২৪ কোটি হেক্টরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে হুমকি। এর কারণ বহুবিধ। এরমধ্যে জমিতে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, চিংড়ি চাষের জন্য মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড় করা এবং জমিতে শিল্প ও ওষুধ বর্জ্য ফেলা অন্যতম। জমি গুণমান হারানোর ফলে শস্যের পুষ্টিমান হ্রাস পায় এবং বন্যা ও খরায় তা ফসল উৎপাদনের জন্য ঘাতোপযোগিতা হারায়। এক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে জমিতে ফসল চক্রের পরিবর্তন, জৈব সার প্রয়োগ, শিল্পবর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকা, বনভূমির গাছ কাটা থেকে নিবৃত হওয়া এবং ফসলি জমিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণে নিরুৎসাহিত করা দরকার। তাছাড়া তামাক চাষ সম্প্রসারণ লাভজনক হলেও পরিবেশ ও মাটির গুণাগুণ সংরক্ষণের জন্য তা পরিহার করা উচিত।

বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। এর প্রভাবে বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। উপকূল এলাকায় জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার সম্প্রসারণ ঘটে। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেক কৃষিজমি। সম্প্রতি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তাতে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বিঘ্নিত হয়েছে পানি সেচ। উপযুক্ত অভিযোজন কর্মসূচি বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে লাগসই কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবনে যত্নবান হওয়া দরকার। এরই মধ্যে বন্যা, খরা, জলমগ্নতা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশকিছু ফসলের জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এগুলোর ক্রমাগত উন্নয়ন সাধন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো আবশ্যক। তাছাড়া জমির ফসলক্রম পরিবর্তন এবং শস্যবহির্ভূত কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি বীমা চালু করতে হবে। 

আমাদের দেশে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যের অপচয়। এটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় বাধা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছে। খাদ্য অপচয়ের এ পরিমাণ ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে ভারতে ৫৫ কেজি, যুক্তরাজ্যে ৭৬, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ এবং রাশিয়ায় ৩৩ কেজি খাবার অপচয় করছে। ২০১৯ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশী বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য নষ্ট করেছিলে। তাতে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয়ের প্রবণতা বছরের পর বছর বেড়েছে বলে প্রতীয়মান। অনুরূপ খাদ্য অপচয় মাঠ পর্যায়ে ফসল উৎপাদন থেকে বিপণন ও গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ, পরিবেশন ও খাবার টেবিল পর্যন্ত বিস্তৃত। দানাদার শস্যের ক্ষেত্রে অপচয় কম। ফলমূলের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০-৩৫ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ। কারণ এগুলো দ্রুত পচনশীল। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে অপচয়ের পরিমাণ ৩০ শতাংশ এবং আলুতে ২০ শতাংশ। বাসাবাড়িতে ও হোটেল রেস্টুরেন্টে অপচয় হয় অনেক বেশি খাবার। কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ৫-১৩ শতাংশ। রেস্টুরেন্টে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অপচয় হয়। নিম্ন থেকে উচ্চ আয়ের মানুষের অপচয়ের মাত্রা বেশি। আগের রিপোর্ট অনুযায়ী ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হয়। অন্যদিকে বাড়িতে ও হোটেল রেস্টুরেন্টের টেবিলে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক শূন্য ৭ কোটি টন। সর্বসাকল্যে বার্ষিক অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন, যা দিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে তিন মাস খাওয়ানো সম্ভব। এ অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে খাদ্যশস্য আমদানির কোনো প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে যখন গরিব ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে তখন অতিমাত্রায় খাদ্য অপচয় মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অতএব এখনই তা রোধ করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি, ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন, ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশনে ভালো প্রশিক্ষণ প্রদান। এক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটি হলো কৃষি উৎপাদনে টেকসইতা বাড়িয়ে ২০৩০-এর মধ্যে খাদ্য অপচয় অর্ধেক কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একযোগে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।

কৃষি উপকরণ জোগানে আমদানিনির্ভরতা আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা। একসময় দেশের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৭০ শতাংশ রাসায়নিক সারের চাহিদা দেশের উৎপাদন থেকেই মেটানো হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। দেশের পাঁচটি সার কারখানার মধ্যে মাত্র একটি এখন চালু আছে। বাকি চারটি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ সার মজুদ আছে তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। এরপর শুরু হবে রবিশস্যের আবাদ ও বোরো ধানের চাষ। এরই মধ্যে আমন ধানের উপরি প্রয়োগ করতে যত পরিমাণ সারের প্রয়োজন শেষকালে তারও কিছুটা ঘাটতি হতে পারে। রবি ও বোরো ফসলের জন্য লাগবে প্রায় ৪০ লাখ টন সার। এদিকে ডলার সংকটের কারণে সার আমদানির জন্য এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রয়েছে। বকেয়া পরিশোধে অপারগতার কারণে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আনতে পারছেন না বিদেশ থেকে। এ অবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় সার আমদানির ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। তারও বেশি দরকার দেশের বন্ধ সার কারখানাগুলো চালু করা। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রতি টন ইউরিয়া সারের খরচ দাঁড়ায় ৩২-৩৩ হাজার টাকা। এর আমদানি খরচ দাঁড়ায় প্রতি টন ৫০-৫৫ হাজার টাকা। সুতরাং রাসায়নিক সার দেশে উৎপাদন করা অনেক বেশি লাভজনক। পানি সেচ ও মাটি কর্ষণের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এসব যন্ত্রের উৎপাদন বাংলাদেশেই হতে পারে। প্রয়োজনে বিদেশের সঙ্গে সমঝোতা করে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা স্থাপনে তাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। 

আমাদের কৃষিপণ্যের বাজার অদক্ষ। এখানে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতাই বেশি, প্রতিযোগিতা কম। সে কারণে বাজারে পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও মূল্য থাকে চড়া। ব্যবসায়ীদের অশুভ আঁতাত এর জন্য দায়ী। তাতে কম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টভোগ করে। তাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঠকেন কৃষকরা। বাজার শৃঙ্খলের এ দুই প্রান্তে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাজার দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া উচিত।

ড. জাহাঙ্গীর আলম: পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইনোনমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫