অগ্রগতির চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যই বেশি

ক্ষমতাঘনিষ্ঠরা নয়, জনগণই হোক তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রকল্পগুলোর প্রকৃত সুবিধাভোগী

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

বিগত সরকার তার ক্ষমতাঘনিষ্ঠদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্পগুলো জনগণের জন্য নেয়া হলেও স্বার্থ ও সুবিধাভোগী হয়েছেন বিগত সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠরা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারঘনিষ্ঠরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে লুফে নিয়েছে বিপুল মুনাফা। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু এর সুবিধা পায়নি জনসাধারণ। দক্ষ মানবসম্পদ গঠন করা যায়নি। ফলে জনগণ প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিগত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ২০১০ সাল থেকে ‌‘ডিজিটাল বাংলাদেশ-২০২১’ স্লোগানে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মূল লক্ষ্য হিসেবে দেশের প্রতিটি খাতকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও এর মাধ্যমে ডিজিটাল রূপান্তর নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে আনা হয়। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ স্লোগান পাল্টে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র ধারণা সামনে আনেন তৎকালীন সরকারপ্রধান। এর মূল উদ্দেশ্য হিসেবেও ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের সব সেবা ও মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তর, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার কথা বলা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সব মিলিয়ে ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইসিটি বিভাগের মাধ্যমে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। আইসিটি খাতে নেয়া এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ হয়নি। কারণ ক্ষমতাঘনিষ্ঠদেরই স্বার্থ ও সুবিধাকে গুরুত্ব দিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে ঘটেছে অনিয়ম ও দুর্নীতির মতো ঘটনা। এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই ফলপ্রসূ হয়নি। এ খাতে বিপুল ব্যয়ের বিপরীতে উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি প্রকল্পগুলো। আবার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে বেশকিছু প্রকল্প নেয়া হলেও সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। জনগণের অর্থে নেয়া এসব প্রকল্পের প্রকৃত সুবিধাভোগী হয়ে উঠুক জনগণ। আর এসব প্রকল্পের অর্থ কীভাবে ব্যয় হয়েছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এজন্য দরকার যথাযথ তদন্ত, যার মাধ্যমে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে। জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলোকে জনগণের স্বার্থেই বাস্তবায়নে সরকারের পদক্ষেপ কাম্য। 

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নেয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। সারা দেশে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীনে গড়ে তোলা হচ্ছে হাই-টেক পার্ক, আইটি পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর সেন্টার, ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৭৮৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এছাড়া ১০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১২৯ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন বাবদ নিষ্ফল বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে হাই-টেক পার্কের প্রকল্পগুলো। কেননা হাই-টেক শিল্পের বিকাশে দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান শুরুর দিকে গেলেও নানা সংকটের কারণে পরে তারা ফেরত আসে। এর মূল কারণ হাই-টেক পার্ক বলা হলেও এসব অবকাঠামো ঘিরে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মীরা সেখানে যেতে চান না। কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে। এছাড়া সিলেট ও রাজশাহীতে নির্মিত হাই-টেক পার্কে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব পার্কে খুব সামান্য পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে।

ব্যর্থতার বড় কারণ হচ্ছে বিগত সরকার দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক মডেলের ভিত্তিতে এসব প্রকল্প নেয়নি। তাছাড়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার মতো কোনো মডেল দেখানো যায়নি। ফলে অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার পাশাপাশি পরিকল্পনাও সঠিক ছিল না। আইসিটি খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণে বড় ধরনের বিনিয়োগ করলেও এসবের সুবিধা শিক্ষার্থীরা পায়নি। কেননা সরকারের প্রকল্পগুলোয় শিক্ষিত স্নাতকদের কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ফলে এ খাতে যারা কাজ করছেন তারা যথাযথ দক্ষতা অর্জনও করতে পারছেন না। এটি সরকারের সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতির কারণেই হয়েছে।  

জনমুখী এসব প্রকল্প নেয়া হলেও ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে জনগণ এর প্রকৃত সুবিধা পায়নি। তথ্যপ্রযুক্তি খাত শিল্পও সুবিধা নিতে পারেনি। যেমন ইনফো সরকার-৩ নামেও একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল সংযোগ, ব্রডব্যান্ড সংযোগ গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এখনো গ্রামের মানুষজন মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপরই নির্ভরশীল। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শিল্পগুলো দক্ষ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায় না—এমন অভিযোগ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শিল্প মালিকদের। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীনরা সুবিধা নিয়েছেন। খেয়ালখুশিমতো প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। টেন্ডার থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব পর্যায়েই প্রভাব খাটাতেন ক্ষমতাঘনিষ্ঠরা। ফলে জনগণ ও শিল্প মালিকদের স্বার্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। 

কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই নিজেদের মতো প্রকল্প তৈরি করার অভিযোগ আছে। দক্ষ জনশক্তি গঠনের চেয়ে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন বিগত সরকারের নীতিনির্ধারকরা। কেননা অবকাঠামো তৈরিতে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, অনিয়ম-দুর্নীতিরও সুযোগ থাকে। এসব খাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থের নিদারুণ অপচয় ঘটেছে। যেসব প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণসহায়তা নেয়া হয়েছে, সেই ঋণের বোঝাও জনগণকেই বহন করতে হবে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের আমলে নেয়া প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে নতুনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। জনগণ যাতে এর প্রকৃত সুবিধাভোগী হয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ খাত টেকসই করতে দক্ষ জনবল প্রস্তুতেও মনোযোগী হতে হবে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫