লেবাননে একসঙ্গে এতগুলো বিস্ফোরণ কীভাবে সম্ভব হল

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

বণিক বার্তা অনলাইন

লেবাননে শত শত হিজবুল্লাহ সদস্যের ব্যবহৃত পেজার বিস্ফোরিত হওয়ার পরদিন গতকাল বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আবারও দেশটিতে তারবিহীন এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের এই অত্যাধুনিক ও প্রাণঘাতী হামলাগুলো বিপুল সংখ্যক মানুষকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয় বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আরো ধারণা করা হচ্ছে যে, উভয় হামলাই চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে দুই পক্ষের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। কারণ, পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় কেবল হিজবুল্লাহ সদস্যরাই নন, বিপুল সংখ্যক বেসামরিকও হতাহত হয়েছেন।

গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) লেবানন এবং সিরিয়ার বিভিন্ন অংশে প্রায় একই সময়ে শত শত হিজবুল্লাহ সদস্যের ব্যবহৃত পেজার বিস্ফোরিত হয়। এই হামলায় কমপক্ষে ১২ জন নিহত হন। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। এই প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের একদিন পর গতকাল বৈরুত এবং লেবাননের অন্যান্য অংশে আরো বিস্ফোরণ ঘটে। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এই দ্বিতীয় আক্রমণে কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং আরো অন্তত ৪৫০ জন আহত হয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আমেরিকান কর্মকর্তা বার্তাসংস্থা এপিকে বলেছেন যে, ইসরায়েল এই অভিযানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছিল। অল্প অল্প করে শত শত পেজারের মধ্যে লুকানো বিস্ফোরক একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছিল। লেবানন সরকার এবং ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহও এই প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। শত্রুপক্ষের পেছনে অত্যাধুনিক অভিযান পরিচালনার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।

বুধবার সৈন্যদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর বিস্ফোরণের বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাজের প্রশংসা করে বলেছেন, আমরা যুদ্ধের একটি নতুন ধাপের সূচনায় রয়েছি।

লেবাননের সরকারি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে যে, বৈরুত এবং দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন এলাকার বাড়িতে সোলার প্যানেলেও বিস্ফোরণ ঘটেছে, যেখানে কমপক্ষে একজন নারী আহত হন।

এই দুই দিনের হামলা হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও প্রচুর সংখ্যক বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির খবরও পাওয়া গেছে। এর কারণ, বিস্ফোরণগুলো হিজবুল্লাহ সদস্যদের পেজার যেখানে ছিল সেখানেই ঘটেছে—যার মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, মুদি দোকান এবং ক্যাফেগুলোও ছিল।

বহু বছর ধরেই পেজারকে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে হিজবুল্লাহ। সম্প্রতি হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ দলের সদস্যদের মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন এ কারণে যে, ফোন ট্র্যাক করার মাধ্যমে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাদের গতিবিধি অনুসরণ করতে পারে। পেজারগুলো মোবাইল ফোনের চেয়ে ভিন্ন তারবিহীন এক নেটওয়ার্কে চলে। জরুরি সময়ে পেজার অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর থাকে। ইসরায়েলের ইলেকট্রনিক নজরদারি এড়াতে হিজবুল্লাহর মতো একটি গোষ্ঠীর জন্য পেজার ছিল বেশ কার্যকর এক উপায় কারণ, পেজারের প্রযুক্তি সহজ এবং মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের চেয়ে সেখানে নজরদারির ঝুঁকি কম।

ব্রাসেলস ভিত্তিক বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক এলিয়াহ জে. ম্যানিয়ার হিজবুল্লাহ সদস্য এবং হামলায় জীবিতদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণগুলোতে ব্যবহৃত নতুন ব্র্যান্ডের পেজারগুলো ছয় মাসেরও বেশি আগে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেগুলো কীভাবে লেবাননে এসেছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তাইওয়ানের কোম্পানি গোল্ড অ্যাপোলো বুধবার জানিয়েছে যে, তারা এআর-৯২৪ পেজার মডেলে তাদের ব্র্যান্ডের ব্যবহার অনুমোদন করেছে। তবে হাঙ্গেরি ভিত্তিক কোম্পানি বিএসি এই পেজারগুলো উৎপাদন ও বিক্রি করেছে।

তাইওয়ানের অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে যে, গোল্ড অ্যাপোলো পেজার লেবাননে সরাসরি রফতানির কোনো রেকর্ড তাদের কাছে নেই। হাঙ্গেরি সরকারের মুখপাত্র দাবি করেছেন যে, পেজার ডিভাইসগুলো কখনো হাঙ্গেরিতে ছিল না এবং বিএসি শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল।

বুধবার বিস্ফোরিত ডিভাইসগুলোর উৎস সম্পর্কেও জল্পনাকল্পনা চলছে। জাপানি ওয়াকিটকি নির্মাতা আইকমের যুক্তরাষ্ট্র শাখার একজন বিক্রয় নির্বাহী এপিকে বলেছেন যে, লেবাননে বিস্ফোরিত রেডিও ডিভাইসগুলো নকল পণ্য বলে মনে হচ্ছে এবং সেগুলোর নির্মাতা আইকম নয়। আইকম দুই দশকেরও বেশি আগে ভি-৮২ মডেলটি চালু করেছিল এবং এটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, সাপ্লাই চেইনে একটি পক্ষের হস্তক্ষেপের ফল হতে পারে মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ। পেজারগুলোতে অল্প পরিমাণ বিস্ফোরক বসানো সম্ভব। এরপর রেডিও সিগনালের মাধ্যমে একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। ডিভাইসগুলোর ভেতরে ১ থেকে ৩ গ্রাম (০.০৪ থেকে ০.১১ আউন্স) শক্তিশালী বিস্ফোরক লোড করা হয়ে থাকতে পারে। মূলত এই তথ্য মার্কিন কর্মকর্তার থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সাবেক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন যে, একটি বিস্ফোরক ডিভাইসে পাঁচটি প্রধান উপাদান থাকে— একটি কন্টেইনার, একটি ব্যাটারি, একটি ট্রিগারিং ডিভাইস, একটি ডেটোনেটর এবং একটি বিস্ফোরক চার্জ। তিনি বলেন, একটি পেজারে সেই পাঁচটির মধ্যে তিনটি উপাদানই থাকে। আপনাকে শুধু ডেটোনেটর এবং চার্জ যোগ করতে হবে।

সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা এবং বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় বিশেষজ্ঞ শন মুরহাউস এই ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েলের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পক্ষে এমন হামলা চালানো খুবই সম্ভব। কারণ, এ ধরনের হামলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাদের।

কয়েকজন হিজবুল্লাহ সদস্যের ধারণা, বিস্ফোরণগুলোর সঙ্গে ব্যাটারির যোগসূত্র রয়েছে। রয়টার্স অনুযায়ী, বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলের এক উপশহরে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় একটি রেডিও বিস্ফোরিত হওয়ার পর কয়েকজন দ্রুত তাদের রেডিওর ব্যাটারি খুলে ফেলে দেন।

পেজার এবং রেডিও দুটোই রেডিও ট্রান্সমিশন ও রিসেপশন ব্যবহার করে। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত ডিভাইস যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশ ছিল। তবে অন্য ধরনের ডিভাইসও বিস্ফোরিত হয়েছে বলে খবর এসেছেন যেমন, সোলার প্যানেল। অন্তত একটি সোলার প্যানেল বিস্ফোরণে এক নারী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বুধবারের বিস্ফোরণগুলোর সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আরো বেশি ইলেকট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণের ঘটনা লেবাননের সরবরাহ শৃঙ্খলে আরো গভীরভাবে কোনোপক্ষের ঢুকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়। এত বড় মাপের হামলার পরিকল্পনা করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা। সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণগুলোর পরিকল্পনা করতে কয়েক মাস থেকে দুই বছরও লেগে থাকতে পারে।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব প্রফেশনাল স্টাডিজের সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের সহকারী অধ্যাপক নিকোলাস রিজের দাবি, হামলার ধরন ইঙ্গিত দেয় যে, দীর্ঘ সময় ধরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে হামলাকারীরা। তিনি বলেন, এ ধরনের বড় মাপের হামলার জন্য পেজারগুলো বিক্রির আগেই সেগুলোর কাছে শারীরিকভাবে পৌঁছাতে হয়েছে। ডিভাইসে বিস্ফোরক বসানোর প্রযুক্তিও তৈরি করতে হয়েছিল। সে সঙ্গে, লক্ষ্যবস্তুরা যে পেজারগুলো বহন করছে তা নিশ্চিত হয়ে অপারেটরদের জানানোর জন্যও কার্যকর একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছে।

হিজবুল্লাহর সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতার বরাতে এলিয়াহ জে. ম্যানিয়ার জানান, বিস্ফোরণগুলোর জন্য কী ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল তা খতিয়ে দেখছে হিজবুল্লাহ। তারা মনে করছে এটি আরডিএক্স বা পিইটিএন, যা অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরক। ৩-৫ গ্রামের মতো অল্প পরিমাণ বিস্ফোরকই প্রচুর ক্ষতি করতে পারে। তারা আরো খতিয়ে দেখছে, ডিভাইসে কোনো জিপিএস সিস্টেম ছিল কিনা, যা ইসরায়েলকে হিজবুল্লাহ সদস্যদের গতিবিধি অনুসরণ করতে সহায়তা করেছিল।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫