ডেইরি শিল্পের বিকাশে বড় নাম ‘প্রাণ ডেইরি’

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুগ্ধ শিল্প একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিশেষ করে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে এটি একটা প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। দেশের সামগ্রিক কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও দুগ্ধ শিল্প আশানুরূপ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত গুঁড়া দুধ দিয়ে দেশে দুধের চাহিদা মেটাতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে এ খাত নিয়ে স্বপ্ন দেখে প্রাণ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠা করা হয় নরসিংদীতে প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের কারখানা। খামারিদের সহায়তার মাধ্যমে একদিকে দুধ সংগ্রহ, অন্যদিকে সংগৃহীত দুধ কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে দুগ্ধজাতীয় পণ্য উৎপাদন করে এ শিল্পের বিকাশে কাজ করছে প্রাণ ডেইরি।

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে তরল দুধের চাহিদা বার্ষিক প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টন। যেখানে দেশীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৯৪ লাখ টন, যা বার্ষিক উৎপাদন চাহিদার অর্ধেকের একটু বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক গড় দুধের চাহিদা ২৫০ মিলিলিটার। এর বিপরীতে পর্যাপ্ততা রয়েছে ১২৫ মিলিলিটার। 

শুরুর গল্প ও চ্যালেঞ্জ 

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আমজাদ খান চৌধুরী কৃষিকে ভালোবাসতেন, কৃষককে ভালোবাসতেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও কৃষককে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ডেইরি শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যদিও শুরুর পথ মসৃণ ছিল না, অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। আমদানীকৃত গুঁড়া দুধ সংরক্ষণ ও বাজারজাত সহজ। কিন্তু তরল দুধ পচনশীল। সে সময় বিতরণ নেটওয়ার্ক ছিল না। তখন আড়ং ও মিল্ক ভিটা কেবল কৃষকের কাছ থেকে দুধ নেয়া শুরু করেছে। একদম বেসরকারি পর্যায়ে কিন্তু কেউ ছিল না। দুধ যতটুকু উৎপাদন হতো তা বাজারে চলে যেত। কিন্তু দুধের উৎপাদন বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে তেমন কাজ হয়নি। তখন আমজাদ খান চৌধুরী একটি উদ্যোগ গ্রহণ করলেন যে কীভাবে দুধের উৎপাদন বাড়ানো যায়। ২০০১ সালে দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাণ ডেইরির যাত্রা শুরু হয়। 

সে সময় বাঘাবাড়ী ও বেড়ায় মাত্র দুটি সংগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রাণ ডেইরির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে মাত্র ২৫ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ হতো। পরবর্তী সময়ে এ কলেবর বাড়ানো হয়। অনেক ভেটেরিনারি চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়। সে সময় মাত্র দুটি সংগ্রহ কেন্দ্র থাকলেও বর্তমানে রয়েছে ১১৩টি। প্রতিদিন আটটি হাবের মাধ্যমে মৌসুমভেদে গড়ে দুই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়। আজকের এ পথচলার পেছনে রয়েছে আমজাদ খান চৌধুরীর দৃঢ় মনোবল ও একাগ্রতা। তিনি দেখেছিলেন বাংলাদেশ আমদানীকৃত গুঁড়া দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখতে সুষম খাদ্য হচ্ছে দুধ। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ মিলিলিটার দুধের প্রয়োজন হয়, অথচ বাংলাদেশে তখন এর গড় পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০ মিলিলিটার। দুগ্ধজাত পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমজাদ খান চৌধুরী ঘোড়াশালে প্রাণ ডেইরির প্রক্রিয়াজাত কারখানা শুরু করেন। শুরুতে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ, পরবর্তী সময়ে দুধ সংগ্রহের বিস্তৃতি নাটোর ও রংপুরে সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তী সময়ে তার সন্তান আহসান খান চৌধুরী দুগ্ধ খাতে নতুন নতুন পণ্য যোগ করে, কারখানায় আরো বিনিয়োগ করে প্রাণ ডেইরিকে আরো সমৃদ্ধ করেন। বর্তমানে নরসিংদীতে প্রাণের নিজস্ব শিল্প এলাকায় ডেইরি কারখানার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 

কারখানার কর্মযজ্ঞ

এ শিল্পের যন্ত্রপাতি একটু ব্যয়বহুল, যেহেতু এটি খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প। এর কোনো মেশিনারি বাংলাদেশে তৈরি হয় না। অধিকাংশ মেশিন ইউরোপ থেকে আনতে হয়। 

দেশে প্রাণের শতাধিক দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। নিজস্ব যানবাহনের মাধ্যমে সেখান থেকে ডেইরি হাবে দুধ জমা করা হয়। এরপর বড় ট্যাংকারের মাধ্যমে সেই দুধ নিয়ে আসা হয় নরসিংদী প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের কারখানায়। প্রতিদিন গড়ে আড়াই লাখ লিটার দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে প্রাণ ডেইরির। টেট্রাপ্যাক ও উন্নতমানের ফুড গ্রেডেড ফয়েল প্যাকে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব পণ্য। এসব পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে কাজ করছে প্রায় ৩ হাজার জনবল।

নরসিংদীর পলাশে প্রাণ ডেইরির কারখানায় বর্তমানে ১২ ধরনের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইউএইচটি ও পাস্তুরিত তরল দুধ, গুঁড়া দুধ, ঘি, মাখন, পনির, লাচ্ছি, দই, মাঠা, লাবাং, চিজ ও ফ্লেভার্ড মিল্ক। উন্নত কাঁচামাল, আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যসম্ভারের কারণে প্রাণের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য এরই মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

দুধের গুণগত মান রক্ষা

দুধের গুণাগুণ জানতে সংগ্রহ কেন্দ্রে প্রথমে ওরগানোল্যাপটি টেস্ট করা হয়, যার মাধ্যমে দুধে ফরেন পার্টিকেল, ময়লা রয়েছে কিনা বা দুধের স্বাদ ও গন্ধ অক্ষুণ্ন রয়েছে কিনা তা জানা যায়। এছাড়া আল্ট্রাসনিক মিল্ক অ্যানালাইজার মেশিন দিয়ে দুধে ননির পরিমাণ, প্রোটিন ও সলিড অংশ এবং দুধে অতিরিক্ত পানি আছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।

এরপর কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করা হয়। এখানে দুধের ফ্যাট, সিএলআর, সিওবি, সোডা, অ্যালকোহলিক ও ফরমালিন টেস্ট করা হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে খামারিদের কাছ থেকে দুধ গ্রহণ করা হয়।

সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে দুধ নরসিংদী কারখানার মাদার সেন্টারে নিয়ে আসা হয়। এখানে পুনরায় কেমিক্যাল টেস্ট করা হয়। অত্যাধুনিক কিউসি ল্যাবে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্ট করা হয়। সংগ্রহকৃত দুধ অসুস্থ গরুর কিনা তার জন্য সোমাটিক সেল কাউন্ট করা হয়। অন্যদিকে দুধে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি জানতে টোটাল প্লেট কাউন্ট টেস্ট করা হয়। পাশাপাশি দুধে ভেজাল বা তেলের মিশ্রণ রয়েছে কিনা তার জন্য রিফ্যাক্টোমিটার টেস্ট করা হয়। এছাড়া নিয়মিত সিসা ও অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট করা হয়।

দুধের মান উন্নয়নে ডেইরি হাব প্রতিষ্ঠা

প্রাণের ডেইরি হাব স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুগ্ধ শিল্পে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং সরাসরি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা, যাতে তারা ন্যায্যমূল্য পান। ডেইরি হাবের ধারণাটি প্রাণই দেশে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছে। পাবনার চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বাঘাবাড়ী, রংপুর, যশোর, বগুড়া ও সাতক্ষীরায় প্রাণ ডেইরির আটটি হাব রয়েছে। এসব হাবের অধীন ১১৩টি দুগ্ধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র রয়েছে। দুগ্ধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্রে খামারিরা সরাসরি দুধ সরবরাহ করেন। প্রত্যেক হাবের আওতায় ২০টি দুগ্ধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রের মাধ্যমে এর আওতাধীন খামারিদের সব ধরনের সেবা প্রদান করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রশিক্ষণ, জাত উন্নয়নে সিমেন/উন্নত প্রজাতির ষাঁড়ের বীজ সরবরাহ, ভ্যাকসিন ও ট্রিটমেন্টে সহায়তা ও স্বল্প সুদে ঋণ সরবরাহের ব্যবস্থা। প্রাণ ডেইরির বর্তমানে ১২ হাজার চুক্তিভিত্তিক চাষী রয়েছেন, যারা গরু পালন করেন। এসব চাষীর অধীনে ৫০ হাজার গরু রয়েছে। দুগ্ধখামার করে এসব খামারি নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে এনেছেন।

প্রাণ ডেইরি প্রথম দেশে ইউএইচটি দুধ নিয়ে আসে। এ খাতে প্রাণ ডেইরি বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এছাড়া দুগ্ধ খাতের সব পণ্য মিলিয়ে প্রাণ ডেইরি এখন দেশের শীর্ষ ডেইরি প্রতিষ্ঠান।  

আগামী দিনের লক্ষ্য

আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে প্রাণ ডেইরি। এক্ষেত্রে শুধু তরল দুধ না, উন্নত দেশগুলোয় যেভাবে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন হয় চিজ, বাটার, ইয়োগাট, চকলেট মিল্ক, পুডিং—এ জাতীয় নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে এবং অনেক পণ্য যোগও হচ্ছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫