বিআরটিএ

সড়ক দুর্ঘটনার দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়মিতকরণে উদ্যোগ কাম্য

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

যেকোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দরকার সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন। যদিও সংগঠনগুলো দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে তথ্য প্রকাশ করে, সে পরিসংখ্যানও ভিন্ন হয়। ফলে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নিয়মিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর মূল লক্ষ্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যানে গরমিল নিরসন এবং দুর্ঘটনার ‘‌সঠিক তথ্য’ প্রকাশ। জানুয়ারি থেকেই বিভাগীয় অফিসগুলোর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত বছরের মে পর্যন্ত সংস্থাটি প্রকাশ করে মাসভিত্তিক দুর্ঘটনার তথ্য। ওই বছরের জুন থেকে মাসভিত্তিকের পাশাপাশি দৈনিক প্রতিবেদনও বিআরটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ শুরু হয়। তবে ২ আগস্টের পর থেকে সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের দাবি, পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মূলত দুর্ঘটনার প্রতিবেদনগুলো তৈরি হয়। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের সঙ্গে প্রতিবেদন তৈরির কাজে বিআরটিএ সমন্বয় করতে পারছে না। এ কারণে দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। এখন পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিয়মিতভাবে দুর্ঘটনা প্রতিবেদন প্রকাশে উদ্যোগ নেয়া দরকার বিআরটিএকে। আশা করি, প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে। 

নিরাপদ সড়ক ও স্বাভাবিক মৃত্যু সবারই কাম্য। অথচ সড়কে মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষের নিত্যদিনকার অভিজ্ঞতার অংশ। সড়কে বছরে যে প্রাণহানি হয় যুদ্ধরত অনেক দেশেও এত প্রাণহানি হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন খাতে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দেশের সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটানো যায়নি। চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ি চালানো এবং ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন অবাধ চলাচলের কারণে সড়কে মৃত্যু প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সড়কে বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুর জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষই (বিআরটিএ) অনেকাংশে দায়ী। তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের প্রচলিত আইন যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রতিনিয়ত সড়কে হতাহতের ঘটনা ঘটছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রধান উপার্জনকারীর বিদায়ে অনেক পরিবারকে পথে নামতে হচ্ছে। আবার পঙ্গুত্ব বরণ করা ব্যক্তিরাও পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে মানবেতর ও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। সড়কে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। দিনের পর দিন সড়কে প্রাণহানির মচ্ছব চলছে অথচ মনে হয় তার দায়িত্ব নেয়ার কেউ নেই। 

দেশে ফুটপাত দখল, অদক্ষ চালক ও সহকারী দিয়ে গাড়ি চালানো, মাত্রাতিরিক্ত গতি, গাড়ির ত্রুটি, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করার কারণে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিআরটিএর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস লাইসেন্স প্রদান এবং অদক্ষ চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। বিআরটিএর কর্মকর্তা ও এক শ্রেণীর দালাল মিলে গড়ে তুলেছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ সেবাগ্রহীতাকে পদে পদে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। সিন্ডিকেটের মাধমে অর্থের বিনিময়ে সহজেই সেবা মিলছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিআরটিএকে একটি সেবাবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য বিআরটিএকে সব ধরনের দুর্নীতি ও দালালমুক্ত করতে হবে। অপরাধে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। 

সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে নিরাপদ সড়কের বিকল্প নেই। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের সঙ্গে জড়িত যানবাহন, পরিবহন মালিক, চালক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), ট্রাফিক পুলিশ, আইন প্রয়োগ ও জনগণ। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে এদের সবারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকার প্রয়োজন। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আইনের শাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকার বিকল্প নেই। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনাও কমে আসবে। তাই ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএসহ সব সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। 

চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। গণপরিবহনে বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে গতিসীমার বাইরে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা আর বাড়তি মুনাফার লোভে পরিবহন সংস্থাগুলো চালকদের অনেক বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে চালকের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ে, তাকে বেসামাল হয়ে গাড়ি চালাতে হয়; যা প্রকারান্তরে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লক্কড়-ঝক্কড়, অচল যানবাহনে রঙ লাগিয়ে যেনতেন মেরামত করে রাস্তায় চলাচল করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের সময়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী দূর-দূরান্তে গমনাগমন করে। সড়ক-মহাসড়কে অনেক সময় বাস-ট্রাকের মাদকাসক্ত চালকের গতির লড়াইয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কেউ-বা আবার গাড়ি চালানোর সময় ব্যবহার করেন সেলফোন, যা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, বিরামহীন যানবাহন চালানো, মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং তদারক না করা সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। 

বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কম হয়। যানবাহন ত্রুটিমুক্ত আছে কিনা তা তারা প্রতি বছর যাচাই করে। যানবাহনে ত্রুটি থাকলে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয় না। চালককে লাইসেন্স পেতে হলে তাকে দক্ষতা প্রমাণ করতে হয়। দক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাকে লাইসেন্স দেয়া হয় না। যানবাহনে চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা ও মাদকাসক্ত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চালকরা ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলেন। এসব ক্ষেত্রে বিদেশে দুর্নীতি কিংবা ঘুস কল্পনা করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। যানবাহন চলাচলের প্রতি স্তরেই দুর্নীতি ঘুসের মাধ্যমে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করলেও চালকের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ট্রাফিক আইন অমান্য করলে পুলিশের সঙ্গে রফাদফা করে চালকরা জরিমানা পার পেয়ে যাওয়ারও ঘটনা ঘটছে। আইনের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল নন। এতে চালকরা আরো বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পান। তাই সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে বিদেশের মতো কঠোর আইন প্রয়োগ করলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে যেত। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগ কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে দুর্ঘটনা কমবে না। মালিকদের প্রভাবে চলছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তারা একপেশে ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আইন প্রয়োগে প্রভাবশালীদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। প্রভাবশালী ও সবলদের ওপর আইন প্রয়োগ করছে না পুলিশ। দুর্বলের ওপর আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি, ছোট যানবাহনের আধিক্যের কারণে সড়ক পরিবহন নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ছে। উন্নত দেশে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দেয়া হয়, আর আমাদের দেশে ছোট যানবাহনকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। 

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে—১. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে ২. দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রয়োজনীয় রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন ও জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন ৩. গাড়িচালকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা ৪. পরিবহন খাতে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা ৫. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা ৬. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ৭. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া ৮. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা। 

পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে বিআরটিএর নিয়মিত দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশে উদ্যোগ নেয়া দরকার। সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল চলছে প্রতিদিন তা নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসে। দুর্নীতি রোধ, সুপ্রশিক্ষিত চালক, সড়কে সুব্যবস্থাপনা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যথাযথ নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর ছাড়া এ-জাতীয় ক্ষয় এড়ানো যাবে না। তাই জাতিগত শক্তির নিদারুণ অপচয় রোধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে—সেই প্রত্যাশা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫