অক্টোবরে রেকর্ড রোগী বৃদ্ধির শঙ্কা

বছরজুড়ে ডেঙ্গু সংক্রমণের এক-তৃতীয়াংশ চলতি মাসে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে চলছে। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শনাক্ত ও মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী। এ বছর যত মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশ চলতি মাসে শনাক্ত হয়েছে। এককভাবে পর্যটন জেলা কক্সবাজারে রোগী শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে রোগটির বিস্তার আগামী মাসে আরো দ্রুতগতির হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদরা।

তারা জানান, চলতি বছরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের মতো নয়। তবে আক্রান্তের বিপরীতে মৃত্যুহার প্রায় সমান। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম। যদিও কয়েক বছর ধরে বারো মাসই এ রোগ দেখা যাচ্ছে। আর দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বিষয়ে যথাযথ মনোযোগী হয়নি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। তারা শুধু রুটিন কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি না হওয়ার আগে কোনো রোগের ক্ষেত্রে মনোযোগী না হওয়া স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের একটি অবহেলা। এতে প্রতিরোধ কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অন্তত ১২টি জেলায় বন্যা হয়েছে, এখনো পরিপূর্ণভাবে পানি নেমে যায়নি। একই সঙ্গে অতিবৃষ্টির কারণে এডিস মশার উৎসস্থল বেড়ে গেছে। ফলে ডেঙ্গুর মতো সংক্রামক রোগের বিস্তার দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে, এ আশঙ্কা অযৌক্তিক নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২১ হাজার ৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১১৯ জন। সে হিসাবে শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যুহার দশমিক ৫৫ জন। রাজধানী ঢাকায় শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৪৬৭ জন। আর মারা গেছেন ৮২ জন। রাজধানী ব্যতীত ঢাকা বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬১। মারা গেছেন দুজন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৪২৭ জনের বিপরীতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ৫ হাজার ১২৫ জন রোগীর বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮। খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৫৩৫ জনের বিপরীতে পাঁচজন, রাজশাহীতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭৭ জন, রংপুরে ১৩৭ জন। বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ৩৯ জনের বিপরীতে ১১ জন মারা গেছেন। সিলেট বিভাগে মোট ১১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন বছরজুড়ে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি রোগী দেখা গেছে কক্সবাজারে। সমুদ্র-তীরবর্তী এ পর্যটন জেলায় রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৬৪৪। আর মারা গেছেন পাঁচজন।

কক্সবাজার জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলায় ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে গত জুলাইয়ে। জুলাই ও আগস্টেই সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছিতে পৌঁছায়। জেলাটিতে ডেঙ্গু রোগীর বৃদ্ধির হার জুনের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ। রোগী কমানোর জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, ভারি বর্ষণ, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর তথ্য উপাত্তই পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে বহু রোগী থাকলে তার তথ্য নেই।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্প্রতি কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা গত মাস ও চলতি মাসে দেখা গেছে। আমরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি চাঁদপুরে ডেঙ্গু বাড়তে শুরু করেছে। আমরা যেসব হিসাব পাচ্ছি তা হাসপাতালভিত্তিক। ওষুধ এবং কোনো ব্যবস্থাপনার যেন ঘাটতি দেখা না যায়, তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। বন্যা-পরবর্তী অবস্থায় ডেঙ্গু আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে যেসব স্থানে চিকিৎসক সংকট রয়েছে সেসব স্থানে আমরা পদায়ন করেছি। বিভাগে একশটির বেশি উপজেলা। সব উপজেলার সঙ্গে আমরা সমন্বয় করছি। কক্সবাজারকে এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’

সরকারের হিসাবের বাইরে বড় একটি সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী রয়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা কাজ করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিবেশগত কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু বেশি। চলতি বছর ক্যাম্পগুলোয় অন্তত পাঁচ হাজার ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় ১৮টি সরকারি ও ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে সে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এসব তথ্য ডেঙ্গুবিষয়ক জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করে অধিদপ্তর। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দিচ্ছে সরকার। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারা দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, যার তথ্য নেই সরকারের কাছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জনের বিপরীতে তিনজন, মার্চে ৩২১ জনের বিপরীতে ৫, এপ্রিলে ৫০৪ জানের বিপরীতে ২, মে মাসে ৬৪৪ জনের বিপরীতে ১২, জুনে ৭৯৮ জনের বিপরীতে ৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জনের বিপরীতে ১২, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১ জনের বিপরীতে মারা গেছেন ২৭ জন এবং চলতি মাসে (গতকাল পর্যন্ত) ৮ হাজার ২৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. শেখ দাউদ আদনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সর্বোচ্চ সতর্কতায় কাজ করছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি রাখা হয়নি। আমরা নিয়মিতভাবে দেশের সব জেলা ও উপজেলার সঙ্গে সমন্বয় করছি। কোনো স্থানে হাসপাতালে চিকিৎসার ঘাটতি যেন দেখা না দেয়, তার জন্য আগাম প্রস্তুতিও রয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫